![]() ছোট গল্প
নীলকন্যা
আজমেরী খান
|
![]() চাকরিটা শোভার দরকার। যে করেই হোক দরকার। -ম্যাম, চা খাবেন? -না, কিছু লাগবে না। -চা খান, পেপার পড়ুন। স্যারের আসার প্রায় সময় হয়ে গেছে। অফিসটা ছোট। ১৫ তলার ওপর থেকে রুমটাকে ভাসমান মনে হচ্ছে। টেবিলের গাছটা ক্যাকটাস। ক্যাকটাস পছন্দ করতাম। মা রাখতে দেন নি। অসুখ নাকি সারে না। দেয়ালে তিনটা পেইন্টিং আছে। বিশেষ কিছু না। রং চংয়ে ভরা। অফিসে কেউ মনে হয় পেইন্টিং এর হাইপোথেটিকাল থট নিয়ে ভাবতে ইচ্ছুক না। চাকরি হলে কি এই অফিসে ডিউটি থাকবে? নাকি অন্য কোন ব্রান্চে? সেই অফিসে কি আহমেদ সাহেব মাঝেমাঝে আসবেন ? -ম্যাম, স্যার বলেছেন কাগজপত্র রেখে যেতে। পারিবারিক একটা কাজে আটকে গেছেন। ঘন্টা দুয়েক দেরি হবে। - সমস্যা নেই । আমি অপেক্ষা করছি। ব্যাগে গল্পের বই থাকলে ভালো হত। সময় কাটত। আগে সময় কাটানো ব্যাপার ছিল না। এখন পাঁচ মিনিটেই অস্থিরবোধ হয়। ![]() -ফাইলটা রাখুন। স্যার আসলে দিবেন। আমার জরুরি কাজ পড়ে গেছে। -জ্বি, ম্যাম। অবশ্যই। আমি দিয়ে দিব। -থ্যাংকস। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি। ছাতা খুলছে না। ইরার বান্ধবীর বাসা কাছেই। হেঁটে যেতে বেশি সময় লাগার কথা না। -শোভা, শুভ জন্মদিন। আহমেদ সাহেব। ছাই রংয়ের ফুলহাতা শার্ট। সাদা স্ট্রাইপ। একটুও বদলান নি। চশমার ফ্রেম বদলেছেন। ফ্রেমের জন্যই বোধ হয় বয়স বেশি লাগছে। -জ্বি,আমি কাগজপত্র রেখে এসেছি। -আসো, কফি খেয়ে যাও। -আজ না, একটু তাড়া আছে। -আচ্ছা। আমি যোগাযোগ করব। লিফটে উঠে গেলেন। কালো রংয়ের গাড়িটা মনে হয় উনার। আগের গাড়ির রং কি ছিল মনে নেই। তবে মনে আছে ৩ বছর আগে উনার জীবনে কেউ হওয়াটা জরুরি হয়ে গিয়েছিল। এমন কেউ যে মধ্যরাতে আবদার করে বলতে পারে 'বাইরে বৃষ্টি। চা খাবে?' -আপা, থাম। কোনদিকে যাচ্ছিস? ছাতা কোথায় তোর? - ওহ, তোর কাজ শেষ, ইরা? -হ্যা। জন্মদিনের দিন প্যাঁচার মত মুখ করে আছিস কেন ? -মাথা ধরেছে, ইরা। বাসায় চল। -দেখা হয়েছে তোর আহমেদ সাহেবের সাথে? কি বললেন ? -না, হয় নি। রিক্সা নে। বাসায় যাব। ইরা রিকশা ঠিক করছে। পাঁচ টাকা নিয়ে দর কষাকষি করবে। দু'চারটা রিক্সা বিদায় করবে। একসময় অর্থহীন মনে হত। এখন মনে হয় করুক। পাঁচ টাকা তো কম না। বাসায় ফিরতে দেরি হল। সারারাস্তা ইরার ঘনঘনানি। ইরার কলেজের কোন এক বান্ধবী ওদের হুজুর স্যারের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। সেই মেয়ের আবার বিয়ে ঠিক হয়েছে। হুজুর স্যারকে না পেলে সে মেয়ে নাকি ফিনাইল খেয়ে আত্মহত্যা করবে। একসময় আহমেদ সাহেবকে দিনের সব কথা বলা জরুরি ছিল। প্রকৃতি একটা খেলা খেলে। সময় সময় খেলা। এ খেলায় সময়ের সাথে সব বদলায়। একসময় খুঁটিনাটি বলা মানুষটার সাথে সাধারণ কথা বলতে অসস্তি লাগে। মনে হয় দুইজনের গলার স্বরের চেয়েও একটা শব্দ বেশি জোরে শোনা যাচ্ছে। অভিযোগের শব্দ। -আপা, চা খাবি? চিনি নেই কিন্তু। -না, তুই খা। -তুই আহমেদ সাহেবকে এত পছন্দ করিস কেন বল তো? -কই, না তো! -না আবার কি? পাশ করার পর প্রথম চাকরির জন্য উনার কাছেই গেলি। -উনি পরিচিত আর অফিসটা কাছে! -সেটা বুঝলাম। কিন্তু টিপ পড়ে কাউকে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যেতে দেখি নি। -আমার জন্য চা নিয়ে আয়। বারান্দায় বসলাম। বারান্দাটা ছোট। এক কোনায় বেলি ফুলের গাছ রাখায় আরও ছোট হয়ে গেছে। দুজন বসলে জায়গা থাকে না। ইলেকট্রিসিটি নেই। বাইরে বৃষ্টি। অন্ধকারে সব চাপা ক্ষোভ একসাথে মনে পড়ে। আহমেদ সাহেবকে একবার প্রশ্ন করেছিলাম তিনজনের নাম বলুন যারা হারিয়ে গেলে আপনি খুঁজবেন। -একটা তুমি, বাকি দুইটা বলব না। সেদিন মনে হয়েছিল এই মানুষটার সাথে আমি থাকব। প্রচন্ড আবেগ এবং ভালোবাসা নিয়েই থাকব। কিছু কথা কানে কানে না বললেও নাকি বোঝা যায়? উনিও হয়ত বুঝেছিলেন। কিন্তু আমার হারিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল না। উনি হারিয়েছিলেন। সব দর্শনকে ভুল প্রমানিত করে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলাম। একবার ইচ্ছা হয়েছিল উনি কথা রাখেন কি না পরীক্ষা করার জন্য হারিয়ে যাই। সুযোগ হয় নি। আহমেদ সাহেব পরীক্ষা দেয়ার মানুষ না। যারা মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ দুই পিঠের যুক্তি জানেন তারা কখনো পরীক্ষা দেন না। -আপা, রাগ করেছিস? -হ্যা -রাগ করলে তোকে খুব বিশ্রী লাগে। -জানি -আমার কি মনে হয় জানিস? আহমেদ সাহেব যদি তোকে এখন বলে "শোভা, তোমাকে ছাড়া বাকি জীবন আমার ব্যর্থ মনে হবে! " তুই উনাকে খুশিমনে বিয়ে করবি! -আমি না পেলে ব্যর্থ হওয়ার মত কোন মেয়ে না, ইরা! - কঁচু জানিস তুই। কালো টিপে তোকে কত সুন্দর লাগে জানিস? আহমেদ সাহেব যতটা বলেছেন তার চেয়েও সুন্দর লাগে। -বাজে বকিস না তো ইরা! -আমি বাজে বকি। তুই মিথ্যা বলিস। কাটাকাটি । -কখন মিথ্যা বললাম? -আহমেদ সাহেবের সাথে তোর দেখা হয়েছে। ইরা বড্ড বেশি চালাক হয়েছে। ইলেকট্রিসিটি এসেছে। ভেতর থেকে সন্দীপন রায়ের কিন্নর কন্ঠ শোনা যাচ্ছে "আমার একলা আকাশ থমকে গেছে তোমার কাছে এসে, শুধু তোমায় ভালোবেসে।" -আপা, নে। তোর প্রিয় গান ছেড়ে দিলাম। এটা তোর জন্মদিনের গিফট। একসময় গানটা দিনে আট দশবার শোনা হত। আহমেদ সাহেবের ঝুল বারান্দায় জোছনা দেখার শখ ছিল। এখনো আছে? নাকি মন পাল্টেছেন? কোন ডেজার্ট আইসল্যান্ডে জোছনা দেখতে চান। পরিস্থিতি অনুযায়ী উনি মন পাল্টাতে পারেন। অসাধারণ ক্ষমতা। আচ্ছা কেমন আছেন উনি ? জিজ্ঞেস করা দরকার ছিল। ভালোই আছেন হয়ত। উনার মত মানুষরা ভালোই থাকেন। ফোন বাজছে। আহমেদ সাহেব ফোন করেছেন। "হ্যালো শোভা !" শোভার নিজের নাম পছন্দ না। কিন্তু আহমেদ সাহেব ডাকলে ভালো লাগে। একই সাথে তীব্র যন্ত্রণা এবং প্রবল আনন্দ হয়। |