/ পরামর্শ / উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই
উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই
অধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্:
|
উন্নত বাংলাদেশ। একুশ শতকের স্বপ্ন, অঙ্গীকার ও চ্যালেঞ্জ। বর্তমান সরকার এ মহান স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছেন। এদেশের দক্ষিণাঞ্চল উক্ত স্বপ্ন পূরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। আশার কথা এই যে, সরকার দক্ষিণাঞ্চলের দিকে ইতিমধ্যে নজর দিয়েছেন এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করেছেন।
এদেশের দক্ষিণাঞ্চল বলতে আমি কেবল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারকে বোঝাচ্ছিনা। একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবন ও টেকনাফকেও বোঝাচ্ছি। এ সকল জেলার যে পর্যটন আকর্ষণ, সম্পদ ও যোগাযোগের পরিবেশ, তার সাথে রয়েছে এদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রাণের সম্পর্ক। আমি এখন বিশদভাবে তা তুলে ধরার চেষ্টা করবো। প্রথমেই আসি যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে। দেশের উন্নয়নের জন্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার ভূমিকা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরাকান রোড থেকে টেকনাফ পর্যন্ত চলমান ছয় লেইনের কাজটি যতো দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করতে হবে। এছাড়া, কর্ণফুলী নদীর টানেলের কার্যক্রম শেষ হবার আগেই আনোয়ারা, বাঁশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া ও মহেশখালী হয়ে কক্সবাজারের খুরুস্কুল পর্যন্ত আঞ্চলিক মহাসড়ককে ছয় লেইনে উন্নীত করতে হবে। এতে করে প্রয়োজনীয় মালামাল পরিবহন, আঞ্চলিক যোগাযোগ ও ব্যবসায়িক সুবিধা অর্জনের পথ সুগম হবে। এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এগিয়ে যাবে জ্যামিতিক প্রগতিতে। আবার, মীরেশ্বরাই থেকে কর্ণফুলীর পাড় ঘেঁষে আনোয়ারা, বাঁশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া ও মহেশখালী হয়ে কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভের সাথে চার লেইনের সংযোগ ঘটাতে পারলে পর্যটন শিল্পের অসাধারণ বিকাশ ও প্রসার ঘটবে, কেননা, ট্যুরিস্টদের জন্যে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এতে করে সুগম ও সহজ হবে। বাকখালী নদীর দু’পাড়ে চারলেনের রাস্তা নির্মাণ করে বিমান বন্দর পর্যন্ত সম্প্রসারণ করলে এবং বিমান বন্দরের পার্শ্বে বাস টার্মিনাল নির্মাণ করলে কক্সবাজারে ট্রাফিক জ্যাম অনেকটাই কমে যাবে এবং পর্যটকদের জন্য অধিকতর উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হবে। এছাড়া, বাকখালী নদীর দু’পাশে ব্লক বসিয়ে ভাঙ্গন রোধ করতে হবে এবং খননের মাধ্যমে গভীর করে নৌ বন্দর স্থাপন করা যাবে। এতে করে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো যাবে। কক্সবাজার সদর উপজেলার পাশ দিয়ে চারলেনের সড়ক নির্মাণ করে মেরিন ড্রাইভের সাথে সংযুক্ত করলে এবং উত্তরণ হাউজিং-এর একটু আগে থেকে এর পেছন দিক দিয়ে মেডিকেল হয়ে লিংক রোডের সাথে সংযুক্ত করলে কেবল ট্রাফিক জ্যামই কমবে না, পর্যটকদের যাতায়তেও খুব সুবিধা হবে। আবার, ঘুমধুম সীমান্ত থেকে বার্মা হয়ে চীন ও থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশের সাথে সংযোগ সড়ক স্থাপন করলে বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটবে এবং বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত চলমান রেল লাইনের কাজটি এখনো শেষ হয়নি। দ্রুত এই কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। এই রেলপথ এদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখবে। কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরটি নামে আন্তর্জাতিক, কাজে নয়। কক্সবাজারের পর্যটন আকর্ষণকে কাজে লাগিয়ে এদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে হলে এই বিমান বন্দরকে সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে উন্নীত করতে হবে। এছাড়াও, ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত চকরিয়া বিমান বন্দরকে পুনরায় স্থাপিত ও চালু করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত এই বিমান বন্দরটি বর্তমানে অস্থায়ী আর্মি ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হলে মহেশখালীর মাতারবাড়ি টার্মিনাল বন্দর ছাড়াও সোনাদিয়া ডিপ সী-পোর্টকে দ্রুত বাস্তবায়িত করতে হবে এবং সোনাদিয়ার সাথে মহেশখালীর সংযোগ ঘটাতে হবে। এছাড়াও, মহেশখালীর সাথে কক্সবাজারের চারলেন ব্রিজের মাধ্যমে সংযোগ ঘটাতে হবে। এতে করে বৈদেশিক সম্পর্ক ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অভাবনীয় অগ্রগতি সাধিত হবে। এজন্য মগনামা-পেকুয়ার সাথে কুতুবদিয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করে কুতুবদিয়াকেও উক্ত স্থল বন্দরের সাথে সংযুক্ত করতে হবে। কক্সবাজার জেলার অন্তর্ভুক্ত উপজেলা কক্সবাজার সদর, কুতুবদিয়া, টেকনাফ, মহেশখালী, চকরিয়া ও পেকুয়ায়, চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও আনোয়ারায় এবং বান্দরবন, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটানোপূর্বক উন্নত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। টেকনাফ স্থল বন্দরের আধুনিকীকরণ অতীব জরুরি, কেননা, বৈদেশিক বাণিজ্য জোরদারের ক্ষেত্রে এটিও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারবে। এছাড়াও, পর্যটকদেরকেও এটি অতিমাত্রায় আকৃষ্ট করতে পারবে। কালুরঘাট থেকে মীরেশ্বরাই পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণ করলে দেশীয় ও বৈদেশিক বাণিজ্যের সুবিধা অনেকগুণ বেড়ে যাবে এবং দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য এই বন্দর আরো বেশি আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হবে। বাংলাদেশে যে সম্পদ রয়েছে তার সঠিক ও সময়োচিত ব্যবহার করে এদেশকে অতি সত্বর উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা সম্ভব। বঙ্গোপসাগরকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে এদেশের মৎস্য সম্পদের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। বাঁশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, কক্সবাজার ও টেকনাফের মৎস্য ঘেরগুলোর উন্নতি সাধন করে মৎস্য ক্ষেত্রে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানির ব্যবস্থা করতে হবে। লবণ চাষ এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। সুদূর অতীত থেকেই এটি এদেশবাসীর গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সম্পদ হিসেবে কাজ করে আসছে। দক্ষিণাঞ্চলের মহেশখালী ও পেকুয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় দীর্ঘকাল ধরে লবণ চাষ অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হলেও ইদানিং কমে গেছে এর অর্থমূল্য। তাই লবণ চাষীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে দেশে লবণের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানির ব্যবস্থা করতে হবে। এদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে হলে এদেশের বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। একইভাবে বনজ শিল্প ও রাবার চাষের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানির ব্যবস্থা করতে হবে। ফলজ বাগানের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে ফলমূলের ব্যাপক উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। পাম অয়েল এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই এর উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। এদেশের দক্ষিণাঞ্চল চিংড়ি চাষের সর্বপ্রধান ক্ষেত্র এবং জাতীয় অর্থনীতিতে এর অবদান অপরিসীম। এ অঞ্চলের কাঁকড়া, ব্যাঙ, কুমির ও কচ্ছপও এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করতে পারে, কেননা, বিদেশে এগুলোর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই আমাদেরকে চিংড়ি চাষের পাশাপাশি কাঁকড়া, ব্যাঙ, কুমির ও কচ্ছপ চাষেরও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে হলে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে চট্টগ্রামকে কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং এজন্য প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সৈকত নগরী কক্সবাজারকে পর্যটন রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং এজন্য এটাকে সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত করতে হবে। বস্তুত, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উন্নয়নের সাথে বাংলাদেশের সব ধরনের উন্নয়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এছাড়াও, এদেশের দক্ষিণাঞ্চলকে গুরুত্ব দিয়ে আরো বেশি শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে শিল্পাঞ্চলগুলোতে গ্যাস লাইনের সংযোগ ঘটাতে হবে। আন্তর্জাতিক মানের সেমিনার হল, হোটেল, মোটেল ইত্যাদির ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক পর্যটন আকর্ষণের জন্যে বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বক্ষেত্রে উন্নত মানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলবৎ ও জোরদার করতে হবে। দুর্যোগ মোকাবেলায় পর্যাপ্ত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মেরিন ড্রাইভকেন্দ্রিক স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে। যুগোপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের সুবিধার্থে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করতে হবে। সরকার পরিচালনার সুবিধার্থে রেল, সড়ক ও নৌ মন্ত্রণালয় থাকতে পারলে সমুদ্র মন্ত্রণালয় আলাদাভাবে গঠন করতে সমস্যা কোথায়? এতে করে এদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি অধিকতর ত্বরান্বিত হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মান বৃদ্ধি ও পরিবেশ উন্নয়নের লক্ষ্যে কক্সবাজারে উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জোন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পরিশেষে বলবো, উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে হলে এদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের সোনালি উজ্জ্বল ভবিষ্যত লুকিয়ে আছে এই দক্ষিণাঞ্চলে। সরকারকে ধন্যবাদ এই দক্ষিণাঞ্চলে নজর দেয়ার জন্যে এবং কিছু কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্যে। আশা করি, এই নিবন্ধে প্রদত্ত আমার মতামতগুলো সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে এবং দেশ ও জাতির উন্নয়নে কাজে লাগবে। অধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্ :অধ্যক্ষ, মেরন সান স্কুল এন্ড কলেজ; চেয়ারম্যান, মেরিট বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন; চেয়ারম্যান, চিটাগাং ফিজিক্যাল এডুকেশন কলেজ, চট্টগ্রাম। |