/ নারী / চিরকুমারী: যে নারীরা কোন দিন বিয়ে করেননি , কেমন তাদের জীবন
চিরকুমারী: যে নারীরা কোন দিন বিয়ে করেননি , কেমন তাদের জীবন
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
ঢাকার ধানমন্ডিতে এমন এক বাড়িতে গিয়েছিলাম যে ধাঁচের পুরনো ভবন ইদানীং এই শহরে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। দরজার বেল বাজাতেই ধীর গতিতে বের হয়ে এলেন সত্তরের কাছাকাছি বয়সী ফাতেমা যোহরা। মনে হল সাথে করে যেন নিয়ে এলেন এক ধরনের নির্ঝঞ্ঝাট আবহ।
পরিপাটি বসার ঘরে আসবাবের অনেকগুলোর বয়স তারই সমান। কথা শুরু হতেই হাসিমুখে জানালেন চিরকুমারী জীবন কেমন চলছে তার। "আমি খুবই, খুবই সুখী এখন পর্যন্ত। মাঠে যাই, এনজয় করি। বড় পুকুরের পাশে বসে থাকি। পুকুরে মাছের পোনা ছাড়ি। যখন যেখানে যেতে চাই চলে যাই। বিয়ে না করার সবচেয়ে বড় এক্সাইটিং পার্ট হল আমার কোনা বাইন্ডিংস নাই। আমার কোন চিন্তা নাই। আমার একটা লিবার্টি আছে যে আমাকে কেউ বলছে না তুমি এটা করছ না কেন? এটা করছ কেন? বা এটা করবে না", বলছিলেন ফাতেমা যোহরা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সকল সমাজে একজন নারী নির্দিষ্ট একটি বয়সে বিয়ে করবেন, সংসারী হবেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্ম দেবেন এটাই প্রচলিত নিয়ম। পশ্চিমা বিশ্বের নানা দেশ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এমন অনেক দেশে অবশ্য নারীদের একটি অংশ এখন ভিন্নভাবে চিন্তা করছেন। বাংলাদেশেও রয়েছেন এমন অনেক চিরকুমারী যারা নিজের ইচ্ছায় অথবা পারিপার্শ্বিক কোন কারণে কখনোই বিয়ের পিঁড়িতে বসেননি। কেমন তাদের জীবন? সমাজ তাদের কিভাবে দেখে? কেন বিয়ে করেননি? উনিশশো পঁচাত্তর সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পাশ করার পর থেকে পেশাগত জীবনে ব্যাপক সফলতা পান ফাতেমা যোহরা। বছর কয়েক আগ পর্যন্ত দেশি বিদেশি বহু উন্নয়ন সংস্থায় গবেষণার কাজ করেছেন। এখন পুরাদস্তুর কৃষক। পরিবারের জমিতে ফসল ফলান, মাঝ চাষ করেন। বছরের বড় সময় কাটান গ্রামের বাড়িতে। কেন কখনো বিয়ের পিঁড়িতে বসা হল না সেই গল্প করছিলেন ফাতেমা যোহরা। "প্রথম আমার মনে হয়েছিল যে আমি সেটল ম্যারেজ করবো না। মা-বাবা আমার জন্য খুব ভাল একটা প্রস্তাব এনেছিলেন। আমি তখন প্রতিবাদ করলাম যে না তোমরা তো আমাকে জিজ্ঞেস করো নি। যে কটা প্রস্তাব এসেছে সবগুলোই ভাল ছিল। "আমি পরিবারের খুব বাধ্য মেয়ে ছিলাম। আমি যে কখনো মা বাবার অবাধ্য হবো তাদের ধারনাই ছিল না। এর মধ্যে মাস্টার্সের রেজাল্ট বের হল। তখন আমি চাকরিতে ঢুকে গেলাম। এরপর যখনই বিয়ের প্রস্তাব আসছে, আমি পিছিয়ে যাচ্ছি। তখনই আমার মধ্যে একটা জিনিস ঢুকে গেল যে আমার স্বাধীনতা থাকবে না।" যে সময়ের কথা তিনি বলছেন সেই সময়ে বিয়েতে এমন সরাসরি না বলা ছিল ঔদ্ধত্যের মতো। উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া, শিক্ষা ও পেশায় তার পরিবারের অবস্থানের কারণে তিনি উৎরে গেছেন। তার মা-বাবা কখনোই তাকে চাপ দেননি। তবে বিয়ে না করার সিদ্ধান্তে কষ্ট পেয়েছেন, বলছিলেন তিনি। অমসৃণ চলার পথ ঢাকার আরেক প্রান্তে দেখা হল কোনদিন বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এমন আর একজনের সাথে। বাবার-মায়ের মধ্যে দীর্ঘদিনের তিক্ত সম্পর্ক দেখে বৈবাহিক জীবন সম্পর্কে ভীত হয়ে ওঠেন তিনি। সবে পঞ্চাশ পূর্ণ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার করার পর থেকে বড় যৌথ পরিবারে থাকছেন। বয়স্ক মা ও নানীর দেখাশোনা করেন। ভাগ্নে, ভাস্তিদের সাথে সময় কাটান। ঔষধের ব্যবসা করেন। কিন্তু বাংলাদেশে তার মতো চিরকুমারী নারীর চলার পথ সবসময় মসৃণ নয়। সবচেয়ে বেশি হজম করতে হয় আত্মীয়দের কথার চাপ। সেটি তার বর্ণনা করে তিনি বলছিলেন, "দেখা যায় পারিবারিক প্রোগ্রামে গেলে আত্মীয় স্বজনরা প্রত্যেকবার জিজ্ঞেস করে। তখন আমার পরিবার বিব্রত বোধ করে। কোন না কোন ভাবে তাদেরকে দোষ দেয়া হয় যে তারা চেষ্টা করে নাই বা তারা কি করছে। "এই কারণে আমার আত্মীয়দের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। চাচীর পরিচিত ডাক্তারের কাছে গেছি। সে আমাকে বলছে আমি বিয়ে করিনি তাই আমার বোনের বিয়ে হচ্ছে না। এটা শুনে খুব খারাপ লেগেছিল। আমি কিন্তু ভাল জায়গায় পড়াশুনা করেছি। কারোর উপর নির্ভর করতে হয় না। কিন্তু আমাকে শুনতে হয়। ভবিষ্যতে আমাকে কে দেখে শুনে রাখবে যেহেতু বিয়ে করে ছেলে মেয়ে না নেই।" তিনি বলছেন, বাংলাদেশে মানুষজন খুব সহজেই ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে। "পাড়ার সবজিওয়ালা, বাড়ির কাজের লোক যেকোনো কেউ জিজ্ঞেস করে ফেলে স্যার কি করে, বাচ্চা কয়জন? এই সেদিনও আম্মাকে নিয়ে হাসপাতালে গেছি। নার্সরা যখন শুনেছে বিয়ে করিনি তখন জিজ্ঞেস করা শুরু করলো কেন করি নাই, এখনো করা উচিৎ, পরে কি হবে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও থেকে শুনি। যেটা খুব বিরক্তিকর, বিব্রতকর। বিষয়টা ব্যাখ্যা করলেও আসলে তারা বোঝে না।" বিব্রত আরো বেশি হতে হয় যখন ব্যাখ্যা না জেনেও চারপাশে গুঞ্জন চলে। চেহারার কারণে বিয়ে হয়নি, নিশ্চয়ই কোন সমস্যা আছে অথবা ছ্যাঁকা খেয়েছে। যখন আইবুড়ো সম্বোধন শুনতে হয়, চরিত্র নিয়ে সন্দেহের মুখে পড়তে হয়। পুরুষ প্রতিবেশী, সহকর্মী, বন্ধুদের কাছ থেকে অশোভন প্রস্তাব আসে। যেমনটা বলছিলেন, একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী একজন। " আমাকে আমার এক সহকর্মীর স্ত্রী সন্দেহ করতো। কোনভাবেই আমি বোঝাতে পারতাম না যে তার স্বামীর প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই। সহকর্মীদের কেউ কেউ ধরেই নেয় যে আমার সাথে চাইলেই কিছু করা যাবে। বাসায় কোন পুরুষ সহকর্মী বা বন্ধু বেড়াতে এসেছে। দেখা গের তখন বাড়িওয়ালা বা দারোয়ান প্রশ্ন করছে।" তিনি বলছেন, তার সম্প্রদায় খুব ছোট হওয়াতে মনের মতো কাউকে তিনি কখনোই পাননি। "বাংলাদেশে কয়জন খ্রিষ্টান আছে বলুন? খ্রিষ্টানদের মধ্যেও আবার সেক্ট আছে। এর মধ্যে থেকে আমার বয়সী পাত্র কয়জন আছে? আমার পরিবার আমার জন্য যাদের নিয়ে এসেছে তাদের কাউকে মনে হয়নি তাদের সাথে আমি জীবন কাটাতে চাই"। "এই কয়টা খ্রিষ্টান ছেলের মধ্যে আমি ভালোবাসার মতো কাউকে পাইনি। আমি যে পর্যায়ে উঠেছি পেশাগত জীবনে সেদিকে দিয়েও আমার ধারে কাছে কেউ নেই। ভালবাসা না থাকলে আমার চেয়ে কত অযোগ্য পুরুষকে আমি বিয়ে করতে পারি?" অবিবাহিত এমন নারীদের বাড়ি ভাড়া করতে গিয়ে প্রায়শই বাড়িওয়ালাদের না শুনতে হয়। তাই বাধ্য হয়েই অনেকে পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে থাকেন। বিয়ে না করলে গ্রামীণ নারীদের আরও বেশি সমস্যার মুখে পড়তে হয়। বিয়ে না করার কারণে অপয়া বলা হয়, পরিবারের অনুষ্ঠান থেকে দুরে রাখা হয় এমন ঘটনাও ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্বের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন বলছেন, বিয়ে না করে জীবন কাটানো নারীদের সমাজ অবাধ্য মনে করে। তিনি বলছেন, স্বাধীনচেতা নারীকে সমাজ খারাপভাবে দেখে। কারণ সে কাঙ্ক্ষিত নারী চরিত্র থেকে বাইরে যাচ্ছে। এসব কারণে সমাজ ও পরিবার তার প্রতি বিরূপ আচরণ করতে থাকে প্রশ্ন করতে থাকে। তার ভাষায়, "নারী বিয়ে না করলে সে অনেকভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। নারীকে পরিবার সবচেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণের রাখতে চায়। বিয়ে না করলে পরিবার মনে করে সে কথা শুনছে না। বিয়ে করে যৌনতার বস্তু হওয়া, সন্তান ধারণ এবং একটি উত্তরসূরি দেবার যন্ত্র হওয়া, এগুলো সে করছে না। পুরুষের বাধ্য হচ্ছে না। সমাজ তাকে যেভাবে দেখতে চায়, বিয়ে না করলে সে সমাজ নির্ধারিত খোপের মধ্যে ঢুকছে না।" এমন নারীরা প্রায়শই পরিবারেই অসম্মান, অবহেলা, নিগ্রহের শিকার হন। তবে সমাজের কথার ঝাঁঝ, বাঁকা দৃষ্টি পরোয়া করেন না ফাতেমা যোহরার মতো অনেকেই। তিনি বলছেন, "আমি কোনদিন কিছু গায়ে মাখিনি। যখন কেউ একদিন বলছে, দুইদিন বলছে, তারপর যখন দেখছে কোন সাড়া নেই, তখন তারা আপনা আপনি চুপ হয়ে গেছে। আমার গ্রামের মানুষজন আমাকে অসম্ভব সম্মান করে।" |