![]() গল্প
পরিবর্তন
শাবলু শাহাবউদ্দিন:
|
![]() আমার সাথেই
মেয়ে টি পড়াশোনা করতো। ক্লাস ওয়ান থেকে এসএসসি পর্যন্ত, পরে ওর আর পড়াশোনা
করা হলো না। মেয়েটির আগ্রহ থাকলেও সে আর পড়াশোনা করতে পাড়লো না। তিন মাইল
হেঁটে এসে বদর মাঝির ঘাট। ঘাট পার হয়ে ভ্যানে করে আরো মাইল পাঁচেক পাড়ি
দিয়েই তবেই পেতাম একটা লক্কর জক্কর মার্কা ছেড়া টিনের হাই স্কুল ঘর। এখান
থেকেই আশপাশ পনেরো থেকে বিশ গ্রামের ছেলে মেয়েরা এসএসসি পাশ করে। কলেজে
পড়তে হলে সেই জেলা শহর ছাড়া আর কোন উপায় নেই । তাই এসএসসি পাশের পড় শতকরা
প্রায় আশি থেকে নব্বই জন্য ছেলে মেয়ের পড়াশোনা থেমে যায়। অর্থাৎ এক থেকে
দুইজন ছেলের কপালে জুটতো শহরের পড়াশোনা । আমার ব্যাচের একমাত্র আমিই কেবল
কলেজে ভর্তি হওয়ার দুর্দান্ত সাহস যোগাড় করতে পেরেছিলাম। সেটা অবশ্যই আমার
সাহস বললে ভুল হবে। সাহস টা ছিল রুনার। আমার যাবতীয় খরচ বহন করতো মেয়েটি।
আমাকে ভালবাসার জন্য কত যে গঞ্জনা মেয়েটি সহ্য করেছে। সেটা ঈশ্বর ছাড়া আর
কেউ জানে না। কখনো মুখের ফাঁসা দিয়েও উচ্চারণ করে নাই। কারণ, আমি জানলে
কষ্ট পাবো বলে। যাইহোক কোন এক সময় রুনার মা-বাবা আমাকে মেনে নেয়। রুনা খরচ
দিলেও মাঝে মাঝে রুনার মা আমাকে খরচ পাঠাতো কাউকে না জানিয়ে, খুব গোপনে।
আমিও চরম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতাম। এইচএসসি পাশের পড় জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। জীবনে চলে আসে পরিবর্তন। সাদাকালো পৃথিবী হয়ে যায়
রঙিন । আসমানি পর্দা নীল থেকে হয়ে যায় লাল । পৃথিবীর লোভ-লালসায় আমি মেতে
উঠি । ভুলে যায় অতীত। হৃদয়ে ধারণ করা রুনা নামের স্মৃতির পাতার পর্দায়
আধুনিকতার কালো ধুলো পরে আমার জীবন থেকে হারিয়ে যায় গ্রামের সহজ সরল মেয়ে
রুনা । রুনার জায়গায় জায়গা করে নেয় ঢাকার শহরের আলতা মডান বড়লোকের বেটি
নিকৃষ্ট নিতম্বধারিণী ছলনাময়ী কল্পনা চৌধুরী সর্ণা । সর্ণা যে আমার জীবনে
দুঃখের বন্যা দিয়ে চলে যাবে সে কথা কে জান তো ! তার আবেগময়ী কথায় আমি মেতে
উঠি । পড়াশোনা শেষ করে আমি সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগদান
করি সাভার শাখায় । সোনালী ব্যাংকে যোগদান করার কয়েক মাসের মধ্যে আমাদের
বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পরে মন্ত্রণালয়ে একটি চাকরি হয় আমার কিন্তু সর্ণা
যোগদান দিতে বাঁধা সৃষ্টি করে । এমন কাজ যে, কেনো করে ছিল তখন না বুঝলেও
পরে অবশ্যই বুঝেছিলাম । আমাকে সর্ণা বুদ্ধি দিলো, আমার ব্যাংক থেকে সে ঋণ
নিয়ে বড় কোম্পানী খুলবে। তার সাথে তার বাবা মা ভাই কাজ করবে । কোম্পানী
ভালো পজিশনে দাড়িয়ে গেলে আমাকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোম্পানীর এমডি পদ নিতে হবে
। আমি ওর কথায় রাজি হলাম না । কথায় আছে, রাজা শাসন করছে রাজ্য , রাজাকে
শাসন করছে রানী । আমিও শাসিত হলাম আমার স্ত্রীর দ্বারা । অবশেষে কর্তৃর
ইচ্ছায় কর্ম হলো। কোম্পানী হলো, ঋণ পাশ হলো । সব হলো । একদিন বাড়ীতে এসে
শুনি আমার স্ত্রী বিদেশে গেছে । সাথে তার বাপ-মা সবাই ।আমাকে ফাঁদে ফেলানো
হয়েছে । পরে দেখি আমার নামে কারিকারি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে ।
অবশেষে সাংবাদিক লেগে গেলো আমার পিছে । আমার বিচার হলো, দশ বছর জেল । দশ
বছর জেল খেটে আমি নিঃস্ব হয়ে কারাগার থেকে বের হলাম । কোথায় যাবো । কী
করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না । অতীতের কথা মনে পরে, নিজেকে খুব অপরাধী
মনে হতে লাগলো । কেমন যেন মনে হলো রুনার সাথে আমি অন্যায় করেছি । ক্ষমা
চেয়ে নিতে হবে । এরপরে বিদায় নিবো এই পৃথিবী নামক অযোগ্য কারাগার থেকে ।
জানি এতদিনে রুনা তার সংসার পেতে বসেছে । আমারই মত হয়তো সেও ভুলে গেছে যে,
তার জীবনে শুফম নামের কোন একজন প্রেমিক পুরুষ ছিল। হয়তো গিয়ে দেখবো, সে তার
বাচ্চা কাচ্চা স্বামীর সংসার নিয়ে খুব ব্যস্ত আছে । আমাকে আর চিনতে পারছে
না । অনেক কথা বলার পরে হয়তো চিনবে । গ্রামের
উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । পশ্চিম আকাশে সূর্য রক্তিম লাল আভা নিয়ে ডুবে যাচ্ছে
। গ্রামের মাটিতে পা রাখলাম । নির্মল মৃদু হাওয়ায় আমার হৃদয় জুড়ে গেলো ।
মনে হচ্ছে এই বুঝি আমি নতুন জীবন ফিরে পেলাম । আমি কৃষক শুফম, মাঠে থেকে
কাজ সেরে বাড়ী ফিরছি । আমার স্ত্রী রুনা আমার গোসলের জন্য টিওবয়েল থেকে
পানি তুলে আমার জন্য অপেক্ষা করছে । কখন আসবে প্রাণের স্বামী, কখন আসবে
প্রাণের স্বামী ! যাই হোক এসব আমার কল্পনা । যা আর কখনো বাস্তবে রূপ নেবে
না । আমাদের সেই সালাসপুর গ্রাম আর সালাসপুর নেই । তার
বুকেও এসেছে পরিবর্তন । কাঁচা মেঠো রাস্তা হয়ে গেছে পাকা । গ্রামে ছোঁনের
ছাওনির ঘরের পরিবর্তে টিনের কিংবা বিল্ডিংয়ের ঘর উঠেছে । পরিবর্তন । সব
পরিবর্তন । আমার পক্ষে আর আহমেদ আলির বাড়ী খুঁজে পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না ।
পথে অনেকের সাথে দেখা হলো , মনে হলো কেউ চিনতে পারে নি । চিনবে কেমনে ! সেই
শুফম আর আজকের শুফমের মধ্যে রাত দিন তফাৎ । দূরে একটি ছোট্ট পিচ্চি ছেলে দেখতে পেলাম, খেলা করছে । ওরে ডাক দিলাম । কাছে আসলো ও । আহমেদ আলির বাড়ি চেনো ? আমি ওরে জিজ্ঞাসা করলাম । কোন আহমেদ আলি ? পিচ্চি আমারে জিজ্ঞাসা করলো । আমি তো অবাক । এখন কী বলি । পাশ
দিয়ে একজন মাঝ বয়সী মানুষ যাচ্ছিল । সে হয়তো আমাদের কথা শুনতে পেয়েছে।
ঐই পিচ্চির মাথায় থাপ্পর দিয়ে বলো, ব্যাংকারের বাড়ি নিয়ে যা । পিচ্চি আগে আগে আর আমি ওর পিছে পিছে চললাম । আহমেদ
আলি আমার দাদা । আমার বাবা মা নৌকা ডুবিতে অনেক অনেক বছর আগেই মারা গেছেন
। বড় হয়েছি দাদার কাছেই । তিনিও মারা গেছেন আমি যখন কলেজে পড়ি।
থাকার মধ্যে ছিল এক সৎ দাদী । জানি না তিনি কেমন আছেন । তার কাছেই যাচ্ছি ।
তার কাছ থেকে রুনাকে খুঁজে বের করে, রুনার ঠিকানায় গিয়ে ক্ষমা চেয়ে মুক্তি
নিবো অযোগ্য এই পৃথিবী থেকে । কিছু দূর হাঁটার পরে পিচ্চি
আমাকে নিয়ে ডুকে পড়লো একটি বাড়ীতে । খালা খালা করে চিৎকার দিয়ে বাড়ীটাকে
মাথায় করে তুললো ছেলেটি । তখন সন্ধ্যার আযান চারিদিকে কলরব সুরে পড়ছে । রান্নাঘরে রান্না ফেলে রেখে একটি মেয়ে বেরিয়ে এসে বললো , কীরে মধনা এত ডাকছিস কেন ? ছেলেটি আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বলো, দেখ তো কাকে নিয়ে এসেছি? আমার
চোখের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি তার চোখের জল আর ধরে রাখতে পাড়লো না । পাহাড়ের
বুক চিরে যেমন ঝর্ণার পানি পড়ে নদীর বুকে ঠিক তেমনি করে তার চোখের জল ঝরতে
লাগলো । একটু কাছে তার এগিয়ে যেতেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাওমাও
করে কেঁদে উঠলো । পাশে দাড়িয়ে থাকা সেই পিচ্চি চিৎকার করে বলে উঠলো, রুনা
খালার স্বামী শুফম ব্যাংকার বাড়ি ফিরছে, রুনা খালা তারে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে । আমিও আবেগ ধরে রাখতে পারলাম না। দুচোখের জলে ভেসে হয়ে গেলাম একাকার । |