![]() ‘পক্ষে গেলে শুভকামনা, বিপক্ষে গেলে হুমকি’
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
![]() সম্প্রতি জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার পাটহাটি মোড় এলাকায় সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হয়ে গোলাম রব্বানি নাদিম নামে এক সাংবাদিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ার পর মফস্বল সাংবাদিকতার ঝুঁকির বিষয়টি আলোচনায় আসে। নিহত রব্বানি নাদিম কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের জেলাপ্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর তুলনায় জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত সংবাদকর্মীদের ঝুঁকি বরাবরই বেশি ছিল এবং এখনো আছে। যা ঘটেছিল জামালপুরে জামালপুরের বকশীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সোহেল রানা বলেন, ১৪ই জুন রাতে এই হামলার ঘটনা ঘটে। মারপিটের খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। সেখানে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে যে, আহত অবস্থায় রব্বানিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। “হাসপাতালে গিয়ে দেখি তার বাম চোখের এখানে আঘাত, রক্ত পড়ছেি,” বলেন সোহেল রানা। তিনি জানান, হাসপাতালে গিয়ে আহত গোলাম রব্বানির সাথে কথা বলতে না পারার কারণে তারা অনুসন্ধানে নামেন। এর জের ধরে পৌরসভার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেন। এই ফুটেজ দেখে কয়েক জনকে চিহ্নিত করে পুলিশ। এখনো পর্যন্ত এ ঘটনায় ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে এখনো কোন মামলা দায়ের করা হয়নি। বকশীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সোহেল রানা বলেন, “ক্যামেরার ফুটেজে কিছু ব্যক্তির ছবি আছে, প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য অনুযায়ী আর কিছু ব্যক্তি ফুটেজের পিছনে ছিল। আমরা প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথেও কথা বলেছি।” পুলিশ জানায়, তাদের উদ্ধার করা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করে দেয়। যেটি দেখে আত্মগোপনে যায় জড়িতদের অনেকে। তবে এদেরকে খুঁজে বের করা হবে বলেও জানিয়েছে পুলিশ। একইসাথে গোলাম রব্বানির পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ দায়ের করা হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানানো হয়। “যারা আমাদের হেফাজতে আছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি।” যা আছে ফুটেজে পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে ভিডিও ফুটেজটি ভাইরাল হয়েছে সেখানে দেখা যাচ্ছে যে, ওই ভিডিওটি ১৪ই জুন ২০২৩ তারিখে রাত ১০টা ১৭ মিনিট ১৬ সেকেন্ডের সময় রেকর্ড করা হয়। ভিডিওটির দৈর্ঘ্য ৪২ সেকেন্ডের মতো। এতে দেখা যায়, দুটি মোটর সাইকেল এক সাথে একটি রাস্তার মোা পার হচ্ছিলো। এর মধ্যে একটি মোটরসাইকেলের আরোহীকে দৌঁড়ে গিয়ে পেছন থেকে টেনে ধরেন এক যুবক। এতে করে মোটরসাইকেল আরোহী রাস্তায় পড়ে যান। তখন রাস্তার আশেপাশে থাকা আরো ৬-৭ জন গিয়ে তাকে ঘিরে ধরে মারতে থাকে। মারতে মারতে তাকে টেনে রাস্তার অপর পাশে অর্থাৎ সিসিটিভি ক্যামেরা যে পাশে সেখানে নিয়ে আসা হয়। এরপরে ক্যামেরায় আর কিছু দেখা যায়নি। গোলাম রব্বানির স্ত্রী মনিরা বেগমের সাথে এ নিয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে কথা বলতে রাজি হননি। তিনি জানান, স্বামীকে কবর দেয়ার পর এক দোয়ায় অংশ নেয়ার অপেক্ষা করছিলেন তিনি। ‘মারধরের ঘটনা খুবই স্বাভাবিক’ বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতন, হয়রানি বা হত্যার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, দেশে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে শুরু করে মে মাস পর্যন্ত ১০১ জন সাংবাদিককে হয়রানি করা হয়েছে। এরমধ্যে ১৪ জন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য বা তার সহযোগীদের কাছ থেকে হুমকির শিকার হয়েছেন। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে থেকে হয়রানির শিকার হয়েছেন ২১ জন। প্রকাশিত খবরের কারণে মামলা হয়েছে ২০ জনের বিরুদ্ধে, সন্ত্রাসীদের হাতে নির্যাতন, হামলা, হুমকি, হয়রানি বা বোমা নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ১৮ জন। ‘এখন টেলিভিশন’ এর রংপুর জেলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নাজমুল ইসলাম নিশাত বলেন, জেলা পর্যায়ে কাজ করার সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হচ্ছে, শক্তিশালী কোন পক্ষের বিরুদ্ধে কোন সংবাদ প্রকাশ করা হলে তখন তারা বিভিন্নভাবে হয়রানি করার চেষ্টা করেন। উদাহরণ হিসেবে নাজমুল ইসলাম বলেন, কিছু দিন আগে মাধ্যমিক স্কুলের অনিয়ম নিয়ে খবর প্রকাশের জেরে তিনিসহ আরো কয়েক জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মানববন্ধন, সড়ক অবরোধ এমনকি তাদেরকে এলাকা ছাড়া করার হুমকি পর্যন্ত দেয়া হয়েছিল। “আমাদের বিরুদ্ধেই ডিসির কাছে, বিভাগীয় কমিশনারের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে বেড়াচ্ছে। এবং পুরো শহরে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করলো যে আমরা অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি এবং শহরেই চলাফেরা করা মুশকিল এমন একটা ব্যাপার।” “সম্প্রতি আমরা দেখলাম যে একজন সাংবাদিককে হত্যা করা হলো এবং এটা কিন্তু নতুন কিছু না। সাংবাদিককে মারধরের ঘটনা কিন্তু খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা হয়ে গেছে।” এর একটি বড় কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন বিচারহীনতাকে। নাজমুল ইসলাম বলেন, হয়রানির শিকার হওয়া কোন সাংবাদিক নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে কতটা সহায়তা পাবেন তা নির্ভর করে ওই সংবাদ মাধ্যমটি কতটা প্রতিষ্ঠিত তার উপর। তার মতে, দেশের শীর্ষ সংবাদ মাধ্যমগুলোতে কাজ করলে হয়রানি বা নির্যাতনের ক্ষেত্রে যে সহায়তা পাওয়া যায়, সেরকম সহায়তা আসলে জেলা পর্যায়ে প্রকাশিত কোন সংবাদ মাধ্যমে কাজ করে পাওয়া যায় না। উল্টো অনেক সময়, সাংবাদিকদেরকেই এ ধরণের পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা হয়। ‘পক্ষে গেলে শুভকামনা, বিপক্ষে গেলে হুমকি’ খুলনার সাংবাদিক দিদারুল আলম বলেন, জেলাটিতে কাজ করা অত্যন্ত দুরূহ। কারণ জেলাটিতে গত ২০ বছরে অন্তত ৪ জন সাংবাদিককে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এদের মধ্যে প্রেস ক্লাবের দুই জন সভাপতিসহ আরো দুই সাংবাদিক রয়েছেন। “প্রতিনিয়তই এখানে সাংবাদিকদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়, কখনো যারা সরকারি দল তাদের লোকের হাতে, কখনো বিরোধী দলের লোকের হাতে। পক্ষে গেলে শুভকামনা, বিপক্ষে গেলে বিভিন্নরকম হুমকি থাকে।” দিদারুল আলম বলেন, মফস্বল এলাকায় জমিজমা বা দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করতে গেলেই কেউ না কেউ শত্রু হয়ে যাবে এবং প্রতিশোধ নিতে চাইবে। “প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তারা যেকোন কিছু কাজ করতে পারে। এর মধ্য দিয়েই আমাদের কাজ করতে হয়, বলেন তিনি। তিনি বলেন, “সমালোচনা সহ্য করা যায়, কিন্তু নির্যাতন সহ্য করা যায় না। যখনই নির্যাতন আসে তখন আসলে আমাদের করার কিছু থাকে না।” মফস্বল সাংবাদিকতার হুমকি আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত যে শতাধিক সাংবাদিক হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাদের মধ্যে অন্তত ১০ জন গ্রাম বা জেলা শহরে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বা কাউন্সিলরদের কাছ থেকে হয়রানির শিকার হয়েছেন। এই মানবাধিকার সংস্থাটির সিনিয়র সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবীর বলেন, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রভাবশালী মহল, রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন নিবর্তন মূলক আইনের কারণে হয়রানির শিকার হতে হয়। এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে এবং এখনো অব্যাহত আছে।” ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে তিনি বলেন, “এ ধরণের আইনের কারণে আসলে তাদের জন্য ঝুঁকিটা বেড়ে যাচ্ছে। অনেক সময় তাদেরকে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হতে হচ্ছে, তাদেরকে প্রাণ দিতে হচ্ছে। সাংবাদিকদের জন্য এই আইনটা এক ধরণের ভীতি সঞ্চার করছে।” গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ড. এস এম শামীম রেজা বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে যারা সাংবাদিকতা করেন তারা আসলে সব সময়েই বেশি ঝুঁকির মধ্যেই ছিলেন। ৯০ এর দশকে মফস্বল সাংবাদিকদের যে ধরণের ঝুঁকি ছিল এখনো সেগুলো রয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো আরো বেড়েছে। “আগে টেলিফোনে হুমকি হতো, এখন হুমকিগুলো প্রকাশ্যে হচ্ছে, এটা কোন কোন ক্ষেত্রে মৌখিকভাবে হুমকি দেয়া হয়, কখনো গোষ্ঠীগতভাবে তাদের হুমকি দেয়া হয়, কখনো রাজনৈতিক পক্ষ থেকে তারা হুমকি পান। নানা রকম চাপের মধ্যে তারা থাকেন,” বলেন শামীম রেজা। স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক, সামাজিক ও ব্যবসায়িক শক্তি অনেক সুসংগঠিত যারা সাংবাদিকদের জন্য প্রতিকূল অবস্থা তৈরির জন্য দায়ী বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের ডিজিটাল নিরাপত্তা ও আইসিটি আইন। এই আইনের আওতায় হাজার হাজার মামলা হয়েছে। এর একটা বড় অংশ হয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে। “কোন কিছু ঘটলে সাংবাদিকে সঙ্গে এই মামলাগুলো করে দেয়া হচ্ছে। তার মানে স্থানীয় শক্তির সাথে এই আইনের একটা ভীতি কিন্তু সেখানে তৈরি হয়েছে।” প্রেসক্লাবের মতো সাংবাদিক সংগঠনগুলোতে রাজনৈতিক ও আদর্শিক কারণে বিভক্তি, নাগরিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও দুর্বলতার কারণেও সাংবাদিকদের ঝুঁকি বেড়েছে বলে মনে করেন সাংবাদিকতার এই শিক্ষক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেতন ও চাকরী সংক্রান্তও একটা ঝুঁকি রয়েছে মফস্বল সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে। জীবন জীবিকার জন্য মফস্বল সাংবাদিকদের আরো নানা ধরণের কাজের সাথে যুক্ত হতে হয়। কারণ তারা যে ধরণের বেতন পান, সুযোগ সুবিধা পান সেটা দিয়ে তার জীবন যাপন করাটা সম্ভব হয় না। এটা উপজেলা পর্যায়ে খুবই বড় বাস্তবতা। এর নিচের পর্যায়ে এই বাস্তবতা আরো প্রখর। ড. রেজা বলেন, “এটা না থাকার কারণে অনেক ধরণের কাজের সাথে হয়তো যুক্ত হতে হয়, যা তার অন্যান্য বিষয়ের সাথে ঝুঁকির মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দেয়।” |