/ মতামত / ভারতের অসহযোগিতা আর আমাদের গাফিলতি এবং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা
ভারতের অসহযোগিতা আর আমাদের গাফিলতি এবং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে এক দীর্ঘমেয়াদী অমিমাংসিত ইস্যু। দু'দেশের মধ্যে ১৯৯৬ সালে একমাত্র গঙ্গা নদীর পানির বণ্টনের চুক্তি স্বাক্ষর হলেও তিস্তাসহ আলোচনায় থাকা ৮টি নদীর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। গঙ্গা চুক্তির পর আলোচনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারটি। ২০১১ সালে দু'দেশের মধ্যে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে সব প্র্রস্তুতি নেয়া হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতায় তা সম্পন্ন করা যায়নি। বাংলাদেশ এবং ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত আন্তঃসীমান্ত নদী বা অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪টি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বৈঠক হয়েছে, অভিন্ন ৬টি নদীর পানি বণ্টনে একটি কাঠামো চুক্তি কীভাবে করা যায়, সে ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। এই নদীগুলো হচ্ছে, মনু ও মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার। মূলত ছয়টি নদীর পানি বন্টন নিয়ে আলাপ হলেও তিস্তা এবং ফেনী নদীর প্রসঙ্গও চলে এসেছে। এই ছয়টি নদী ভারতের যে রাজ্য গুলোর উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সেই রাজ্যগুলোর সরকারও যেন আলোচনা বা চুক্তির প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকে, সেটা বাংলাদেশও চায়। তিস্তার পানি বন্টনের ক্ষেত্রে একটি চুক্তি নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা হয়েছিল।পরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের আপত্তির কারণে তা এগুতে পারেনি।উল্লেখ্য যে, এই ছয়টি নদী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ,আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্য থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দুই দেশের পানি বণ্টনের মীমাংসা শুধু দ্বিপাক্ষিক বিষয় নয়, এক্ষেত্রে ভারতের রাজ্য সরকারের স্বার্থ এবং সম্মতির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিরও এখানে প্রভাব রয়েছে।তারা বলেছেন,বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে থেকে রাজনৈতিক উচ্চপর্যায়ে যে ধরনের সংলাপ বা আলোচনার প্রয়োজন, সেটি যথাসময়ে করা সম্ভব হয়নি, এছাড়া সবপক্ষের অংশগ্রহণও নিশ্চিত করা যায়নি।যে কারণে অভিন্ন নদীর পানি সংক্রান্ত ছোটখাট বিষয়ে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও দীর্ঘ সময় ঝুলে থাকতে দেখা যায়। বাংলাদেশ-ভারত পানি নিয়ে আমাদের সমস্যার মধ্যে রয়েছে? গরমকালে আমরা পানি একেবারেই পাচ্ছি না। আবার বর্ষায় অতিরিক্ত পানি আমাদের বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে। এটা ঠিক, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের সব থেকে বেশি ভুক্তভোগী আমরা। সঙ্গে আছে পাশের দেশ ভারতের নজিরবিহীন অসহযোগিতা। আর আমাদের নিজেদের গাফিলতি তো আছেই। এভাবে যদি দেশ চলতে থাকে, তাহলে বন্যা বা খরার কারণে দাঁড়াতেই পারবে না বাংলাদেশ। আমাদের এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রতিবছর গড়ে খরায় ক্ষতি ২ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। এবং বন্যায় গড়ে প্রতিবছর ক্ষতি হয় ৩০ হাজার কোটি টাকা। যা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে দুই বছর আগেই। তার সাথে প্রাণহানির কথা তো আছেই। আর এসব ক্ষতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ভারতের অভিন্ন ৫৪ নদীর ৫৩টিতেই দেওয়া বাঁধ অনেক বেশি ভূমিকা রাখছে। নদী গবেষকেরা বলছেন, ষাটের দশকে সাড়ে ৭০০ নদী ছিল বাংলাদেশে। বর্তমানে এ সংখ্যা কমে মাত্র ২৩০-এ দাঁড়িয়েছে। গত ৫২ বছরে হারিয়ে গেছে আমাদের ৫২০টি নদী। যা বাকি আছে তাতেও ভারতের উজানে বাঁধ দেওয়ার জন্য আমাদের নদীগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে লবণাক্ততা।ইতিমধ্যে দেশটির ২৯ রাজ্যের ২২টিতেই নদী অববাহিকায় নির্মাণ করা হয়েছে ৪ হাজার ৩০০টি বাঁধ। আরও অনেকগুলো বাঁধ পাইপলাইনে আছে। জিবিএম অববাহিকার দেশগুলোর পরিকল্পনাধীন বাঁধের সংখ্যা ৪১৪। এর মধ্যে নেপালে ২৮৫টি, ভারতে ১০৮, ভুটানে ১২, চীনে ৮ ও বাংলাদেশে একটি যা গত বছরের এপ্রিলে প্রকাশিত হয়েছে সংবাদ মাধ্যমে। ব্রহ্মপুত্র নদের চীনা অংশ ইয়ারলুং স্যাংপো থেকে পীত নদীতে বছরে ২০ হাজার কোটি ঘনফুট পানি সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে চীনের। অন্যদিকে ন্যাশনাল রিভার লিংকিং প্রজেক্টের (এনআরএলপি) আওতায় ৯ হাজার ৬০০ কিলোমিটার খাল খননের মাধ্যমে নিজ সীমানার ৪৪টি নদীকে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের যা দুই হাজার আঠারো সালের ৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে দ্য হিন্দু পত্রিকায়। এসব বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে হলে আমাদের যা করতে হবে,তা হচ্ছে-আন্তর্জাতিক,প্রযুক্তি ও সক্ষমতা বৃদ্ধি। আন্তর্জাতিক নদীর ব্যবহার সম্পর্কে ১৮১৫ সালের ভিয়েনা সম্মেলন, ১৯২১ সালে দারিপুর নদী কমিশন কর্তৃক প্রণীত আইন, আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ, ১৯৭৩ সালে সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব যার অধীন কোনো রাষ্ট্র এমন কিছু করবে না, যা তার এখতিয়ারের বাইরের কোনো অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। ১৯৭২ সালে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ মানব পরিবেশসংক্রান্ত সম্মেলন কর্তৃক গৃহীত নীতিমালা, যেখানে বলা হয়েছে যে এক দেশের কার্যক্রম অন্য দেশের পরিবেশ বিপন্ন করতে পারবে না; ১৯৯২ সালের ডারলিন নীতিমালার ২ নম্বর নীতি, প্রতিটি ক্ষেত্রে ভাটির দেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ-সংক্রান্ত কনভেনশন যা এখন আইন।শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও, বাংলাদেশ এখনো এই জাতিসংঘের কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। তবে অবিলম্বে করতে হবে। কারণ, ভারত আমাদের সঙ্গে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক আইন ভেঙেছে। তারা অনুমতি ছাড়া বাঁধ দিয়েছে, আমাদের ন্যায্য পানির হিস্যা দিচ্ছে না, তারা এই বাঁধের কারণে যে আয় করছে, তার ভাগও আইনমতো আমরা পাই।এ ছাড়া তারা নোটিশ ছাড়া পানি ছেড়ে দেওয়া, এ কারণে যে ক্ষতিপূরণ ও পরিবেশ নষ্ট হওয়ার দায়ও এই আইনে আছে। আমরা যদি ন্যায্য হিস্যা না পাই, আন্তর্জাতিক আদালতে এসব বিচারের দাবি করতেই পারি। এই আন্তর্জাতিক আইন ৭২ সালে প্রতিষ্ঠা হলেও যৌথ নদী কমিশন আসলে ব্যর্থ। এখন পর্যন্ত তারা শুধু গঙ্গা চুক্তি করলেও সেখানে নেই গ্যারান্টি ক্লজ। এ কারণে কম পানি দিলেও ভারতকে ধরা যাচ্ছে না। তাদের দিকে অভিযোগ, পানি কম থাকলেও কাগজে-কলমে বেশি দেখানো হয়। এখন যে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি দেওয়ার কথা, সেটা কতটুকু বোঝানোর জন্য শুধু বলি আমাদের কাপ্তাই বিদ্যুৎকেন্দ্র যদি পুরা শক্তিতে চলে তাহলেও ৩০ হাজার কিউসেক পানি লাগে,যার সক্ষমতা মাত্র ২৩০ মেগাওয়াট। তাই বিশেষজ্ঞ দিয়ে এই কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে এবং অবশ্যই এর মধ্যে একজন প্রকৌশলী থাকতে হবে, যিনি বাঁধের কারিগরি বিষয় বুঝতে পারবেন। সিন্ধু নদীতে পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে যে চুক্তি, তা ৬৫ বছরেও ঠিকমত পালন হচ্ছে না শুধু আমাদেরই।প্রকৌশলগত সক্ষমতায় দেশের নদীর সমস্যার জন্য দুটি প্রজেক্ট পুরোই প্রস্তুত। এখন দরকার উদ্ধার করা। আমাদের সব মেগা প্রজেক্ট বাদ দিয়ে এখন এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।যেমন গঙ্গা ব্যারাজ, তিস্তা মহাপ্রকল্প এবং খাল খনন। তাই নতুন ভাবে সব সরকারি অফিস গঠনের মাধ্যমে সব নদীর ড্রেজিং নিশ্চিত করতে হবে এবং খাল উদ্ধার করতে হবে। আমাদের সরকারি কর্মচারীদের তাদের ব্যর্থতার দায় নিতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আর একটা কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষাক্রমে উদ্ধারকাজ প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এটা শুধু বন্যা নয়,যেকোনো দুর্যোগের জন্যই প্রয়োজন। আমাদের ফায়ার সার্ভিসকে আরও দক্ষ এবং লোকবল বাড়ানো দরকার। আমার বিশ্বাস সব কটি কাজের সক্ষমতা বাংলাদেশেরই আছে। আর সরকার যদি চায়, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই আমাদের নদী বা পানি নিয়ে যাবতীয় সমস্যা সমাধান সম্ভব। আর এ ব্যাপারে কাজ করার জন্য দক্ষ জনবল আমাদের দেশের মধ্যেই আছে, শুধু দরকার সদিচ্ছা। আন্তর্জাতিক চুক্তি, দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক অববাহিকা চুক্তি ও নীতিগুলো নিয়ে গঠিত। আন্তর্জাতিক আইন পানির বিরোধ এড়াতে বা নিষ্পত্তি করার জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া এবং পদ্ধতি প্রদান করে। এই আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে বেশ কয়েকটি সার্বজনীন নীতি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, যুক্তিসঙ্গত এবং ন্যায়সঙ্গত পানি ব্যবহারের নীতি,উল্লেখ যোগ্য ক্ষতি না করার বাধ্যবাধকতা এবং পরিবেশগত ব্যবস্থায় সহযোগিতা ও রক্ষা করার দায়িত্ব নিহিত করা। জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক শিকার এবং তাৎপর্যপূর্ণ পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা ভারত ও দেশের জন্য পানি বণ্টন ব্যবস্থার জন্য এগুলো প্রয়োজনীয়। সুতরাং,দেশের এই আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করাও জরুরি।এছাড়াও বাংলাদেশকে অবশ্যই উদ্ভূত সমস্যার ঘরোয়া ও স্বকীয় সমাধান অনুসরণ করতে হবে। পানি বণ্টনে ভারতের অকার্যকারিতা কিংবা অনীহার কারণেই বাংলাদেশ তিস্তা নদীর বৃহৎ অংশে বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং নদীপৃষ্ঠ ড্রেজিং করার চৈনিক প্রস্তাব বিবেচনা করা শুরু করে। কিন্তু ভারতের অপারগতা ও উদ্বেগের কারণে বাংলাদেশ চীনের প্রস্তাব বাতিল করে বাংলাদেশ। এ রকমটা তৎকালীন সরকার রাজনৈতিক বিবেচনাতেই করে। বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক গভীর এবং বিস্তর অর্থনৈতিক বাণিজ্যের ওপর অধিষ্ঠিত। যেহেতু, এখন আর রাজনৈতিক স্বার্থ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় স্বার্থই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রমের প্রধান পথপ্রদর্শক, তাই বাংলাদেশের আবারও চীনের প্রস্তাব বিবেচনা করা উচিত। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা কোনোভাবেই উপরিল্লিখিত আলোচনার লক্ষ্য নয়। দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক এবং সংযোগ অকাট্য সত্য এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ পরিক্রমায়ও এর প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ।ভারতকে কেন্দ্র করে বিদ্যমান ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-কৌশলগত, ভূ-অর্থনৈতিক, আঞ্চলিক এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য একটি বাস্তবতা যা বাংলাদেশ কখনই উপেক্ষা করতে পারে না। বাংলাদেশের এখন প্রয়োজন সেই দৃষ্টিভঙ্গি বাদ দিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ দ্বারা এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পরিক্রমা অতিক্রম করা। ভারতকে বুঝতে হবে যে বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সমস্যা সমাধানের জন্য চিরকাল অপেক্ষা করবে না বরং অন্য বিকল্পের সন্ধান করবে। এটাই ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা। আর এই বাস্তবতার নিরিখেই বাংলাদেশ তার গতিতেই মানুষের নিরাপত্তার জন্য কাজ করবে এটাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশা। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |