/ ফিচার / ৭ই মার্চ জাতীয় দিবস বাতিল নিয়ে বিতর্কের জায়গাগুলো কী
৭ই মার্চ জাতীয় দিবস বাতিল নিয়ে বিতর্কের জায়গাগুলো কী
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
সম্প্রতি আটটি জাতীয় দিবস বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলছেন, আওয়ামী লীগ আমলে “বিভিন্ন দলীয় দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তো, সেগুলা এবং যে দিবসগুলোকে অগুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, সেই দিবসগুলোকে বাতিল করা হয়েছে।” তবে আটটি দিবসের মাঝে ৭ই মার্চ জাতীয় দিবস বাতিল করায় বিতর্ক তৈরি হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ৪ঠা নভেম্বরের সংবিধান দিবস নিয়েও আলোচনা হয়েছে। যদিও শেখ মুজিবুর রহমানসহ বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ কামাল, শেখ রাসেলের জন্মদিনের দিবস এবং স্মার্ট বাংলাদেশ দিবসের বিষয়ে ততটা বিতর্ক দেখা যায়নি। প্রধান উপদেষ্টার সরকারি ফেসবুক পেজে জাতীয় দিবস বাতিলে বিষয়ে করা পোস্টেের কমেন্টের অনেকেই সেগুলোকে ‘পরিবারতন্ত্র দিবস’ হিসেবে উল্লেখ করছেন। ৭ই মার্চ যেভাবে দিবস ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ অনেক জনপ্রিয় হলেও ২০২০ সালের আগ পর্যন্ত দিনটিকে কোনও দিবস হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ থেকে ৭ই মার্চকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করে এক মাসের মধ্যে গেজেট জারির নির্দেশ দেয়া হয়। একই সাথে মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে সব জেলা ও উপজেলায় ‘বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল’ স্থাপনের নির্দেশও দেয়া হয়। ২০১৭ সালে এ নিয়ে আদালতে রিট আবেদন করা হয়েছিল। সে বছরই ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে দিনটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করে পরিপত্র জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। দিনটিতে সরকারি ছুটি না থাকলেও জাতীয় পতাকা উত্তোলন, দেশজুড়ে ভাষণ প্রচার, স্কুল-কলেজে নানা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, উপাসনালয়ে প্রার্থনা, শেখ মুজিবের বায়োপিকসহ বিভিন্ন প্রদর্শনী, মন্ত্রণালয়ের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, জেলা-উপজেলা প্রশাসন বা ইউনিয়ন পরিষদের উদযাপন, এমন নানা ধরনের কর্মসূচি বড় পরিসরে পালন শুরু হয় ২০২১ সাল থেকে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ৭ই মার্চ ঘিরে কর্মসূচি আগেও থাকতো, কিন্তু দিবস ঘিরে নানা আড়ম্বরের শুরুটা ২০২১ থেকেই বলা যায়। এ কারণে এ দিবসটি বাতিল হওয়ার পর সমালোচনার প্রেক্ষিতে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন যে ২০২১ সালের আগে ৭ই মার্চ জাতীয় দিবস বলে পালিত হতো না, এখন সেটা বাতিল হলে কেন এতটা প্রতিক্রিয়া হবে। পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক এসব দিবস বাতিলের ঘোষণার পর পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন মত দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে আওয়ামী লীগের তরফ থেকেও। যদিও সামাজিক মাধ্যমে যারা দিবস বাতিলের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন তাদের সবাই যে বিগত সরকারের অনুগত তেমনটাও পুরোপুরি বলা যায় না। যেমন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের ছেলে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ স্ট্যাটাস দিয়েছেন, “৭ই মার্চ এবং ১৫ই অগাস্ট জাতীয় শোক দিবস বাতিল ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ এবং নিন্দা জানাচ্ছি I একেকজন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসবে আর ইতিহাসকে বিকৃত করবে আড়াল করবে অথবা নতুন করে লিখবে তা হতে পারে না।” মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা সত্ত্বেও তাজউদ্দীন আহমদকে অনেকটা পাশ কাটানো হয়েছিল শেখ মুজিবের সরকারের সময় এবং তাকে ঘিরে তেমন কোনও দিবসের আয়োজন হয়নি। যেসব দিবস বাতিল করা হয়েছে সেগুলো আওয়ামী লীগের ভেতরে পরিবারতন্ত্রের সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিল বলেও মত রয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও অ্যাকটিভিস্ট আনু মুহাম্মদও এই দিবস বাতিলের বিপক্ষে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। ৭ই মার্চকে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন “শেখ মুজিব রাজনৈতিক চরিত্র, তার সমালোচনা পর্যালোচনা অবশ্যই হবে কিন্তু ইতিহাস মোছার চেষ্টা চলবে না।” তিনি বলেন, “জাতীয় দিবস ঘোষণা করাটা আওয়ামী লীগের নিজস্ব রাজনীতির অংশ, কিন্তু জাতীয় দিবস ঘোষণার পরে বাতিল করাটা তাৎপর্যপূর্ণ। এটা বার্তা দেয় যে ৭ই মার্চের যে অবস্থান বা গুরুত্ব সেটা এই সরকার স্বীকার করছে না বা গ্রহণ করছে না।” জনগণের উত্থান থেকেই এই ভাষণের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে যেটা একা শেখ মুজিবের মালিকানাধীন বিষয় না এবং এটা বাতিল করার তেমন প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন না তিনি। যদিও শেখ হাসিনা ও তার পরিবারকেন্দ্রিক দিবস নিয়ে বাড়াবাড়ি হয়েছে বলেই মনে করেন তিনি। তার মতে, দিনগুলো দলীয় বা পারিবারিক, কিন্তু ৭ই মার্চে জনগণের অংশীদারিত্ব আছে। আবার এমন মতও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রয়েছে যে দ্রব্যমূল্য, যানজট, দখলদারিত্ব, আইনশৃঙ্খলা এমন দিকে অগ্রগতি তেমন দেখা না গেলেও এমন দিবস পালন বা বাতিলে কিছু আসে যায় কি না। অবশ্য দিবস বাতিলের পক্ষে মতও কম নেই। লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান ভিডিও পোস্টে উল্লেখ করেন “মাফিয়া সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় কী চরম নোংরামি করেছে এই দিবসগুলো তার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ।” শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট পরিবারকেন্দ্রিক দিবস থাকা, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মীয় শেখ ফজলুল হক মণিকে ঘিরে তেমন দিবস না থাকার বিষয়টিও তুলে ধরেন তিনি। সামাজিক মাধ্যমে দিবস বাতিলের পক্ষে যারা বলছেন তাদের বেশিরভাগই উল্লেখ করছেন যে এই দিবসটি স্বাধীনতার পর থেকে ৫০ বছরে ‘দিবস’ হিসেবে পালন হয়নি, এমনকি আওয়ামী লীগের আমলেও না। লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ নিজ চোখে দেখা অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বিবিসি বাংলাকে বলেন, ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চেই জনগণ রাস্তায় নেমে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিল এবং মার্চের দুই তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো দেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। “এখানে শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল না” বলে মন্তব্য করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে সেই পতাকা উত্তোলনের পেছনে ছিলেন তৎকালীন ডাকসুর ভিপি আ স ম আব্দুর রব, তৎকালীন জিএস আব্দুল কুদ্দুস মাখন, ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ। “সাত তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য তার উপর চাপ ছিল, এবং এটা নিয়ে শেখ হাসিনা নিজে, আমি শুনেছি বলতে যে সিরাজুল আলম খান চাপ দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা করাতে চেয়েছিল কিন্তু তার আব্বা সেই ফাঁদে পা দেন নাই। উনি তো স্বাধীনতার ঘোষণা করতে চান নাই। তিনি যেটা করেছিলেন পাকিস্তানিদের সাথে নেগোসিয়েশনের (মূলামূলি) জন্য চার দফা আপোষ ফর্মুলা দিয়েছিলেন,” বলছিলেন মহিউদ্দিন আহমদ। তার মতে, “শেখ মুজিবুর রহমানের আসল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানিদেরকে চাপে রেখে চার দফা আদায় করে ক্ষমতা নেয়া যেটা মার্চের ২৪ তারিখ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।” একটি পরিবারকে ঘিরে বহু ধরনের দিবস পালনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “দিবস আওয়ামী লীগ পালন করতেই পারে, কিন্তু সরকারিভাবে জনগণের টাকা খরচ করে এখানে হইচই করা হয়েছে।” দিবস ঘিরে বিগত সরকারের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি প্রতিনিয়ত মানুষকে বিরক্ত করেছে বলে মনে করেন তিনি। অবশ্য তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এটি জাতীয় দিবস হওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ না বলে মনে করেন তিনি। আওয়ামী লীগই শেখ মুজিবর রহমানের প্রতিচ্ছবিসহ অনেক দিবসকে নষ্ট করে ফেলেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের গুরুত্বকে ইতিহাস থেকে নাই করে দিচ্ছি না যেটা আওয়ামী লীগ করেছিল। ইতিহাসের অংশ হিসেবে নির্মোহভাবে থাকতে পারে, কিন্তু দিবসের প্রয়োজনীয়তা নেই।” সামনেও গুরুত্বের বিবেচনায় দিবস বাতিল বা নতুন দিবস যুক্ত হতে পারে বলে জানান তিনি। |