/ সারাদেশ / উপকূলের জেলে পল্লীতে নেই ঘূর্ণিঝড় আতঙ্ক
উপকূলের জেলে পল্লীতে নেই ঘূর্ণিঝড় আতঙ্ক
নতুন বার্তা, পটুয়াখালী:
|
বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস—এই শব্দগুলো উপকূলের মানুষের খুবই পরিচিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে থাকতে ভয় কেটে গেছে উপকূলের অনেক মানুষের। তবুও ঘূর্ণিঝড়ের নাম শুনলেই সবার আগে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন জেলে পল্লির বাসিন্দারা। তবে এবার জেলে পল্লীগুলোতে নেই কোনো আতঙ্ক, কারণ সকল প্রকার সামুদ্রিক মাছ শিকারে চলছে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। বর্তমানে সমুদ্রে নেই কোনো ট্রলার বা নৌকা, আর তাই স্বস্তিতে জেলে ও তাদের পরিবার।
বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) কলাপাড়া উপজেলার বিভিন্ন জেলে পল্লীর খবর নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবার ঘূর্ণিঝড় বা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সময় জেলে পরিবারগুলো থাকে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠায়। কারণ জেলে পরিবারের অধিকাংশ পুরুষরাই থাকে সমুদ্রে মাছ শিকারে। আর সেজন্যই প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর পেলেই দিশেহারা হয়ে যান তারা। কুয়াকাটা ৮০ ঘড় জেলে পল্লীর জেলে মো. ফারুক মাঝি বলেন, বাবার হাত ধরে ৯ বছর বয়সে সমুদ্র মাছ শিকারের যাত্রা শুরু করেছি। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ৪০ বছর ধরে এই পেশাতেই আছি। ঝড়বন্যা আর সমুদ্রের ভয়ংকর রূপ দেখতে দেখতেই জীবনের এতটা পথ পাড়ি দিয়েছি। কত শতবার সমুদ্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলা করে টিকে আছি তা কোনো ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। তবুও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরিবারের কথা চিন্তা করে পরিশ্রম করে যাচ্ছি। তবে বর্তমানে সমুদ্রে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা থাকায় কোনো জেলেই সমুদ্রে নেই। তিনি আরও বলেন, আমাদের মতো গরিব জেলেরা চাইলেও এই পেশা ছেড়ে যেতে পারবেন না। কারণ দাদনের বেড়াজালে আটকে আছে আমাদের জীবন। জেলে পেশা ছাড়তে হলে মহাজনদের থেকে নেওয়া সব টাকা পরিশোধ করতে হবে। তাই আমরা না পারছি দাদনের টাকা পরিশোধ করতে না পারছি এই পেশা থেকে মুক্তি পেতে। কুয়াকাটার এই জেলে পল্লীর এক জেলের স্ত্রী শাহিনুর বেগম বলেন, আমার স্বামী যখন সমুদ্রে ১২ থেকে ১৪ দিনের জন্য মাছ শিকারে যান তখন ছোট ছোট দুটি ছেলে-মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। সারাক্ষণ ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে চেয়ে থাকি সমুদ্রের দিকে। এটা ভেবেই সময় চলে যায়, যদি আমার স্বামী ওই সমুদ্র থেকে আর কোনোদিন ফিরে না আসে তাহলে ছোট এই সন্তানদের কাছে কি জবাব দেবো। তবে এবার ঘূর্ণিঝড়ের খবরে কোনো টেনশন বা ভয় নেই। কারণ মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা থাকায় আমার স্বামী বাড়িতেই আছেন। সমুদ্রে ট্রলার ডুবে নিখোঁজ হওয়া জেলে মিলনের মা খাদিজা বেগম বলেন, ১৮ বছর ধরে আমি আমার ছেলের অপেক্ষা করছি কিন্তু আজও আসেনি আমার ছেলে। ওই বঙ্গোপসাগর আমার ছেলেকে নিয়ে গেছে। ২০০৭ সালের সিডরের সময় ট্রলার ডুবে নিখোঁজ হয় আমার ছেলে, এরপর আজ পর্যন্ত আর খোঁজ মিলেনি তার। সেজন্য ঘূর্ণিঝড় বা বন্যার কথা শুনলেই কলিজা কেঁপে ওঠে আমার, আবার না কোনো মায়ের কোল খালি হয়। তবে এবারের ঘূর্ণিঝড়ের খবরে টেনশন করি না, কারণ কোনো জেলেরাই সাগরে নেই বর্তমানে। কুয়াকাটা আশার আলো জেলে সমিতির সভাপতি নিজাম শেখ বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে ও বিপদে থাকে সমুদ্রগামী জেলেরা। আবহাওয়া অফিসের সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই ঘাটে চলে আসতে পারে আর যারা নেটওয়ার্কের বাইরে থাকে তারা বিপদের সম্মুখীন হয়। এতে নিঃস্ব হয়ে যায় শত শত জেলে পরিবার। বছরে পাঁচ থেকে সাতবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপকূলের জেলেদের এখন নিয়মিত সঙ্গী। যদিও এবার সেই ভয়টা নেই, কারণ সমুদ্রে কোনো জেলে নেই। উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, গভীর সমুদ্রগামী জেলেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সারা বছরই সমুদ্রে মাছ শিকার করেন। শুধু বছরে দুইবার মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা দেয় মৎস্য অধিদপ্তর। এর বাইরে বছরের পুরো সময়টাতে মাছ শিকার করেন জেলেরা। তবে সরকারি নিষেধাজ্ঞার বাইরেও প্রাকৃতিক নিষেধাজ্ঞায় পরেন অনেক সময় জেলেরা। এবার মা ইলিশ রক্ষায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সমুদ্রে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় দানার কোনো প্রভাব পড়বে না জেলেদের গায়ে। কারণ জেলেরা এই মুহূর্তে সমুদ্রে নেই। |