/ মতামত / মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতার নেপথ্যে কী আছে
মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতার নেপথ্যে কী আছে
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এতদিন চলে আসা মধ্যপ্রাচ্যের শক্তি-ভারসাম্যের সমীকরণ আমূল বদলে দিয়েছে। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর থেকে ওই অঞ্চলের শক্তি-ভারসাম্য দেশটির দিকে হেলে ছিল বলে মনে করা হতো। কোনো আরব রাষ্ট্র এককভাবে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামলার শক্তি অর্জন করতে পারবে-পশ্চিমা নীতিনির্ধারকরা বিশ্বাস করতেন না। ফলে ইরানের হামলা তাদের বিস্মিত করেছে। ইসরায়েল ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিম বিশ্বের যে প্রভাব; ইরান আরও শক্তিশালী হয়ে উঠলে তা ধরে রাখা সম্ভব হবে কিনা-সে প্রশ্ন তাদের ভাবিত করছে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা এটিকে প্রভাব হিসেবে দেখলেও মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকরা একে দেখেন নব্য-উপনিবেশবাদের সম্প্রসারণ হিসেবে, যার সূত্রপাত ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে। তবে শুধু পশ্চিমা দুনিয়াই নয়; সামরিক শক্তি হিসেবে ইরানের উত্থান নিয়ে চিন্তিত সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ। ইরানের হামলার মধ্যদিয়ে ইসরায়েলের সামরিক শক্তির দুর্বলতাও প্রকাশ পেয়েছে। ইসরায়েল দাবি করেছে, কয়েকটি বাদে প্রায় সব ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রকে ইসরায়েলে প্রবেশের আগেই ভূপাতিত করা হয়েছে। তবে এসব ভূপাতিত করতে সহায়তা নিতে হয়েছে বিশ্বের তিন পরাশক্তি আমেরিকা, ফ্রান্স,ব্রিটেন সেই সঙ্গে প্রতিবেশী জর্ডানের। এর থেকে অনুমেয়, এসব রাষ্ট্র সহায়তা না করলে ইসরায়েলের পক্ষে ইরানের প্রতীকী হামলা ঠেকানো সম্ভব হতো না।ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন ত্যাগ করাতে আরব সরকার গুলোকে কয়েক দশক ধরে রাজি করানোর চেষ্টা করছে ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ৭ অক্টোবর নেতানিয়াহুর নৃশংস প্রতিক্রিয়া সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে। একেবারে শুরু থেকেই নেতানিয়াহু ও হামাসের নতুন নির্বাচিত নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারের অত্যন্ত স্পষ্ট কৌশল আছে। দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর নেতানিয়াহুর উদ্দেশ্য ছিল-জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা; ফিলিস্তিন ও লেবাননের সব প্রতিরোধ গোষ্ঠীকে ধ্বংস করা; ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচী শেষ করা এবং তার প্রতিরোধের অক্ষকে দুর্বল করা; এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ইসরাইলসহ অঞ্চলটিকে নিজেদের মতো করে ঢেলে সাজানো।খুব অল্প সময়েই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে নেতানিয়াহুর জিম্মিদের দেশে ফিরিয়ে আনার কোনো ইচ্ছা ছিল না। তিনি ইসরাইলের নাগরিকদের বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছিলেন যে হামাসকে চাপ দিলে জিম্মিদের দ্রুত মুক্তি নিশ্চিত হবে। এটা ছিল নিতান্ত বাজে কথা। কারণ, অধিকাংশ জিম্মি ইসরায়েলের ফেলে দেওয়া বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রের কারণে মারা গেছে। গাজায় এখনো আছে মাত্র ১০১ জন। আর জীবিত জিম্মিরা যদি ফিরে আসে তাহলে,জিম্মিদের জীবন নিয়ে একটা ডানপন্থী সরকারের ফায়দা লোটার অপরাধে নেতানিয়াহুকে লম্বা মেয়াদে কারাবাস করতে হতে পারে। হামাসকে ধ্বংস করতে নেতানিয়াহু ব্যর্থ হয়েছে। তাই নতুন গতিতে লেবানন এবং হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেছে। হামাস এখনো গাজার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বারবার চেষ্টা করেছে ইসরায়েল, কিন্তু সেখানে হামাসের বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো বিশ্বাসযোগ্য শক্তি আবির্ভূত হয়নি। নেতানিয়াহুর চতুর্থ লক্ষ্য হলো ইসরায়েলকে মাথায় রেখে এই অঞ্চলকে পুনরায় সাজানো। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা কেবল মার্কিন সাংবাদিকদেরকে জানাতে খুব পছন্দ করেন যে ‘মধ্যপন্থী সুন্নি’ আরব নেতারা ইসরায়েলের আঞ্চলিক আধিপত্যের এজেন্ডাকে কেমন করে সমর্থন করছেন। মধ্যপন্থী বলতে তাঁরা পশ্চিমাপন্থী বলে বোঝানো হয়েছে। তাঁদের সবই চরম রকমের একনায়ক। কিন্তু, এখানে আবার ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একই ভুল করে। সেই দেশগুলোর ধনী শাসকদের মৌখিক সমর্থন আর সেই দেশগুলোর জনগণ এক কথা নয়। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে তারা ইচ্ছাকৃত ভাবে ভুল করে উদ্ধৃত করে তাদের দাবির সমর্থনে। আঞ্চলিক সংকটের সময়ে স্বৈরাচারী এই শাসকদের ফিলিস্তিন ইস্যুতে প্রতি জনগণের ক্ষোভের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে হচ্ছে। এই তাঁদের দুর্বলতম জায়গা। সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান আল-সৌদ ঘোষণা করেছেন যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরেই তাঁরা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবেন। আর সেই অদূর ভবিষ্যতে সেই সম্ভাবনা বাস্তব হবে বলে মনে হয় না।সিনওয়ারের মূল লক্ষ্য এক কথায়-দখলদারিত্বকে ইসরায়েলের জন্য আরও ব্যয়বহুল করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিরোধকে সব রকমে বাড়াতে হবে। দখলদারি কর্তৃপক্ষের দখলদারির ব্যয় বাড়িয়ে দিতে হবে। এই হচ্ছে আমাদের জনগণের মুক্তি এবং প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্য অর্জনের একমাত্র উপায়।’ আরেক বক্তৃতায় ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা মেনে নিতে বাধ্য করার কথা বলে বলেছেন, ‘হয় আমরা বিশ্বের সঙ্গে মিলে তাদের এই জিনিসগুলো করতে তাদের বাধ্য করব অথবা, আমরা এই দখলদারিত্বকে পুরো আন্তর্জাতিক ইচ্ছার সঙ্গে প্রবলভাবে বিরোধপূর্ণ করে একে বিচ্ছিন্ন করব। আর তা এমনভাবে করব, যেন তারা এই অঞ্চলে এবং সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে এক হতে না পারে। হামাস নিশ্চিত রূপেই ইসরায়েলের দখলদারিকে আরও ব্যয়বহুল করে তুলতে পেরেছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ১,৬৬৪ ইসরায়েলি নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ৭০৬ জন সৈন্য। ১৭,৮০৯ জন আহত হয়েছে। প্রায় ১৪৩,০০০ ইসরায়েলি নাগরিককে তাদের বাড়িঘর থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ইসরায়েল থেকে টাকা বাইরে পাঠানো শুরু হয়ে গেছে। ইকোনমিস্ট-এর প্রতিবেদন মতে, গত মে-জুলাই-এর মধ্যে দেশের ব্যাংক থেকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানে টাকা পাঠানো গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। ইসরায়েলের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকরা সংঘাত শুরু হওয়ার সময় এতটা উদ্বিগ্ন ছিলেন না। এখন তাঁরা বেশি চিন্তিত। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে যে সিনওয়ারের কৌশল বেশি কাজ করছে বলে মনে হয়। সিনওয়ার বেঁচে থাকুন বা ইসরায়েলের হামলায় মারা যান, তাঁদের উদ্দেশ্যের নিজস্ব একটা অপ্রতিরোধ্য গতি আছে। বাইডেনের দুর্বলতা বা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাব্য আগমনে উৎসাহিত হয়ে নেতানিয়াহু সম্ভবত বোকার মতো ভাবছেন যে তিনি উত্তর গাজা এবং দক্ষিণ লেবানন দখল করতে পারবেন। এই সম্ভাব্য নতুন দখলের মধ্যে পশ্চিম তীরের বেশিরভাগ অংশ যে থাকবে, তা প্রায় নিশ্চিত।কিন্তু নেতানিয়াহু গাজা, লেবানন বা পশ্চিম তীরে যা করতে পারবেন না, তা হলো, তিনি যা শুরু করেছেন, তা শেষ করা। যা অ্যারিয়েল শ্যারনকে গাজা থেকে সরে যেতে বাধ্য করেছে বা লেবানন থেকে এহুদ বারাককে; তা গাজা ও লেবাননে নেতানিয়াহুর জন্যও প্রযোজ্য হবে। এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। নেতানিয়াহুর যুদ্ধ স্বল্পমেয়াদি ও কৌশলগত।সিনওয়ারের যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি।ইসরায়েলকে বুঝতে হবে যে শান্তি চাইলে দখলকৃত ভূমি তাকে ছাড়তে হবে।নেতানিয়াহুর যুদ্ধ এক বছরের পুরোনো।গাজা, দক্ষিণ লেবাননের মতো ধ্বংসযজ্ঞ তিনি চালিয়ে যেতে পারেন।তাঁর কোনো রিভার্স গিয়ার নেই।আর সিনওয়ারের যুদ্ধ মাত্র শুরু হয়েছে। কে জিতবে এই যুদ্ধে? তা নির্ভর করে নির্যাতিতদের সহনশীলতার মাত্রার ওপর। যুদ্ধের এক বছর পরে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের মনোবল আরও বেড়েছে। এই লড়াই কেবলমাত্র শুরু।এসব কিছুই নেতানিয়াহুর দক্ষিণপন্থি সরকারকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। নেতানিয়াহুর ওপর একদিকে যেমন বিরোধী দলগুলোর চাপ রয়েছে, তেমনি তাঁর সমর্থক চরম দক্ষিণপন্থিরা চাপ দিয়েছে ইরানে পাল্টা আক্রমণ চালানোর। এখন ইসরায়েল যদি পাল্টা হামলা চালাতে না পারে, তাহলে একদিকে নেতানিয়াহু তাঁর দেশের জনগণের কাছে দুর্বল হিসেবে প্রতিভাত হবেন। অন্যদিকে আরব বিশ্বে শক্তির ভারসাম্য ইরানের অনুকূলে বলে প্রতিভাত হবে। আবার ইসরায়েল হামলা চালালে ইরানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া সামলানো যাবে কিনা, এসব চিন্তা নেতানিয়াহু সরকারকে পেয়ে বসেছে। সব মিলিয়ে ইসরায়েলের অবস্থা হয়েছে শাঁখের করাতের মতো। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব ইসরায়েলকে ইরানের ওপর পাল্টা হামলা চালাতে নিষেধ করেছে। ইরান ইতোমধ্যে নানা মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে, ইসরায়েল যদি প্রতীকীভাবেও ইরানে অথবা তার মিত্রদের ওপর হামলা চালায়, এবার ইরানের জবাব হবে ভয়াবহ। নাইন-ইলেভেন পরবর্তী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় থেকে বর্তমানে বিশ্বরাজনীতির ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটেছে। বিশ্বে সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়া, চীনের পাশাপাশি উঠে এসেছে ভারত, উত্তর কোরিয়া ও ইরান। এখন ইরানের মতো শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে জড়ালে এটি রাশিয়াকে সামরিক ভারসাম্যে সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউক্রেন বা ইরানের মতো সমকক্ষ শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। যেসব রাষ্ট্রেরসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে জড়িয়েছে-ইরাক, আফগানিস্তান, হাইতি, ভিয়েতনাম-সবাই ছিল সামরিক দিক থেকে খুব দুর্বল ধরনের রাষ্ট্র। তদুপরি ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়ায় মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতার পর অর্থনৈতিক চাপে থাকা। বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি যুদ্ধে জড়াতে চাচ্ছে না। উল্লেখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের যুদ্ধে জড়ালে সেটি বাইডেনের নির্বাচনী ফলাফলেও প্রভাব ফেলতে পারে। কেননা, উগ্র দক্ষিণপন্থি ছাড়া বেশির ভাগ মার্কিন জনগণ আরেকটি যুদ্ধে জড়ানোর পক্ষপাতী নয়। বিশ্বের প্রায় ৫০ ভাগ বাণিজ্য হয় হরমুজ প্রণালি দিয়ে। যুদ্ধের ফলে ইরান এ প্রণালি বন্ধ করে দিলে তার নেতিবাচক প্রভাব বিশ্বের পাশাপাশি মার্কিন অর্থনীতিতেও পড়বে। সর্বোপরি ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যে বড় আঞ্চলিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হলে বর্তমান মার্কিন কেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। আর এসব সমীকরণের ফলে যুক্তরাষ্ট্র কোনো অবস্থাতেই ইসরায়েল যাতে ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়, সে ব্যাপারে তৎপর। এসব বিবেচনায় বলাই যায়, মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার সমীকরণ আসলেই বদলে গেছে,কিন্তু তা ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূলে নয়। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |