/ মতামত / আধুনিক প্রযুক্তির বিশ্বে বদলে যাচ্ছে চাকরির বাজার
আধুনিক প্রযুক্তির বিশ্বে বদলে যাচ্ছে চাকরির বাজার
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
গত এক দশক আগেও বিশ্বে চাকরির বাজার যেমন ছিল, এক দশক পরে এসে বর্তমানে সেখানে আমূল পরিবর্তন এসেছে। এর মূলে প্রধান প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে প্রযুক্তি। এক সময় দেশের চাকরির বাজারে ছিল করপোরেট খাতের গৎবাঁধা কাজ কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানের নথিভিত্তিক নটা-পাঁচটার চাকরি। সেখানে এখন শুধু প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে গোটা চেহারাটাই বদলে গিয়েছে। নিকটতম ভবিষ্যতে চাকরি এবং দক্ষতার উপর ম্যাক্রো প্রবণতা এবং প্রযুক্তি প্রবণতার প্রভাব দিয়ে শুরু করতে চাই। সমীক্ষাটি দেখায় যে আরও বেশি সংখ্যক ব্যবসা নতুন এবং সীমান্ত প্রযুক্তি গ্রহণ করবে এবং তাদের ডিজিটাল অ্যাক্সেস প্রসারিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং বর্ধিত ডিজিটাল অ্যাক্সেস জরিপ করা কোম্পানিগুলির ৫০% এরও বেশি চাকরির বৃদ্ধিকে চালিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশ্বের আরও আইটি বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন প্রযুক্তি শুধুমাত্র আমাদের কাজের পদ্ধতিই পরিবর্তন করছে না, কিন্তু এটি দ্রুত কাজের বিষয়বস্তু এবং চাওয়া-পাওয়া দক্ষতাও পরিবর্তন করছে। এবং প্রযুক্তিগুলি ঠিক কীভাবে শ্রমবাজারকে প্রভাবিত করবে তা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে লোকেরা আগামীকালের চাকরিতে রূপান্তর করতে পারে কিনা তা নির্ধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অদূর ভবিষ্যতে বর্তমান সময়কার অনেক চাকরির অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাবে। এই পরিবর্তনের পেছনে প্রধান দুটি কারণের কথা ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সমীক্ষায় উঠে এসেছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, নতুন প্রযুক্তির উত্থান এবং সবুজ ও টেকসই অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাওয়া। বুদ্ধিমত্তার এই নতুন নতুন প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি শ্রম বাজারে আমূল পরিবর্তন আনবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব নতুন প্রযুক্তি সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহায্য করবে। এতে একদিকে যেমন অনেক কর্মসংস্থানের খাত তৈরি হবে তেমনি অনেক কর্মসংস্থান ধ্বংসও হয়ে যাবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গবেষকরা বলছেন, আগামী পাঁচ বছরে বর্তমান চাকরির বাজার প্রায় এক-চতুর্থাংশ বদলে যাবে। সুতরাং একটি ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে সফল হতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন দক্ষতা শিখে সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। কারিগরি জ্ঞান হলো এমন এক প্রধান দক্ষতা যা নতুন চাকরির প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার জন্য অবশ্যই অর্জন করতে হবে। এরপর যে বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে মনোযোগ দিতে হবে তা হলো অ্যানালিটিকাল থিংকিং বা বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাভাবনা। বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাভাবনা বিকাশের জন্য আপনাকে আপনার জ্ঞানার্জনের ক্ষমতাকে ঘষেমেজে উন্নত করতে হবে। যেন আপনার মন এবং মনন একটি বিষয়ের ভিন্ন ভিন্ন প্যাটার্ন বা বিভিন্ন ব্যাখ্যা লক্ষ্য করতে পারে। অ্যানালিটিক্যাল স্কিলস বা বিশ্লেষণধর্মী দক্ষতার মধ্যে রয়েছে কৌতূহল এবং প্রতিনিয়ত নিজেকে স্বশিক্ষিত করে তোলার বিষয়টি। এভাবে ক্রমাগত নিজেকে উন্নত করতে এবং শিখতে, আপনাকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে ফোকাস ধরে রাখা আয়ত্ত করতে হবে। এ ছাড়া সৃজনশীলতাও বেশ জরুরি। বিজ্ঞান, প্রকৌশল, নকশা বা শিল্পে, যে ব্যক্তি প্রযুক্তিগত দক্ষতার সঙ্গে সৃজনশীলতাকে এক করতে পারবেন তারই পদোন্নতি পাওয়ার সুযোগ বেশি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগে যোগাযোগ এবং সহানুভূতি অত্যন্ত মূল্যবান দুটি দক্ষতা। যন্ত্র যত দ্রুত বিকাশ লাভ করুক না কেন, মানুষের সবসময়েই আরেকজন মানুষের প্রয়োজন হবে এবং মানুষের প্রতি মানুষের মনোযোগ, সবাই মিলে কাজ করা, একজন আরেকজনের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা, গল্প করা, পাশে থাকা এবং সহানুভূতির মূল্য দিন দিন বাড়তেই থাকবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিকাশের পাশাপাশি মেশিন লার্নিং-দক্ষতা অনেক আকর্ষণীয় সব সুযোগ তৈরি করবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল পেশাগুলোর মধ্যে একটি হলো প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ারিং। এরা মূলত যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ যারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মডেলগুলোর সাহায্যে এই যোগাযোগের কাজটি করে থাকে। এআই সম্পর্কিত অন্যান্য সম্ভাব্য চাকরির মধ্যে রয়েছে এথিসিস্ট বা নীতিবিদ, সিকিউরিটি ইঞ্জিনিয়ার বা নিরাপত্তা প্রকৌশলী এবং ডেভেলপার্স যারা মানুষ এবং যন্ত্রের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য ইউজার ফ্রেন্ডলি ইন্টারফেস তৈরি করে। সম্ভাবনার আরেকটি ক্ষেত্র হলো অ্যানালাইসিস অব বিগ ডেটা অর্থাৎ বড় বড় তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষণ। নেটফ্লিক্সের মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে শুরু করে হ্যাড্রন কোলাইডার বা কন্ট্রোল সিস্টেমের মতো বিভিন্ন ধরনের বিশাল বিশাল তথ্য বিশ্লেষণের দক্ষতা অর্জন বেশ জরুরি। অন্যদিকে সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের জন্য অবশ্যই কাজের কোনো অভাব হবে না, কারণ প্রতিনিয়ত সংবেদনশীল তথ্যের হার বাড়তেই থাকবে। সে জন্য নিরাপত্তার প্রয়োজনও বাড়বে। এ কারণে আর্থিক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, বিজনেস অ্যানালিস্ট বা ব্যবসা বিশ্লেষক এবং ব্লকচেইন সিস্টেম ডেভেলপারদেরও প্রয়োজন হবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ফিউচার অব জবস রিপোর্ট ২০২৩ অনুসারে, সব ধরনের খাত এবং শিল্পে সবুজ চাকরির চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সবুজ রূপান্তরের কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী তিন কোটি কর্মসংস্থান তৈরি হতে পারে এবং এই কর্মসংস্থান তৈরি হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, অল্প শক্তি ব্যবহার করে বেশি উৎপাদন এবং কম নির্গমন প্রযুক্তি এই তিনটি খাতে। সবুজ শক্তি এবং টেকসই উন্নয়নে নতুন চাকরির সুযোগের ক্ষেত্রে আপাতত যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে পশ্চিমা দেশ এবং জাপান। অবশ্য চীনও ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। এই কাজগুলো ব্যবসা, বিজ্ঞান, রাজনীতি বা সরাসরি পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে।তারা মূলত ওই পেশায় থেকেই পুনরায় নবায়ন যোগ্য শক্তির ব্যবহার বা শক্তির নতুন উৎসের সন্ধান এবং ব্যাটারির উন্নয়নে কাজ করতে পারে, বিপন্ন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে পারে, ব্যবসায়িক পরামর্শ দিতে পারে। এ ছাড়া সামনের দিনগুলোয় স্মার্ট হোম প্ল্যানার, আর্কিটেক্ট, ডিজাইনার এবং নির্মাতাদের প্রয়োজন হবে। বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু যত বাড়ছে ততই বাড়ছে বার্ধক্যে উপনীত জনসংখ্যার হার। এই বয়স্ক মানুষদের যত্ন এবং চিকিৎসার প্রয়োজন ক্রমেই বাড়বে।অতএব, অদূর ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের কাজের চাহিদা অনেক বেশি থাকবে। বিশেষ করে সেই সব স্বাস্থ্যসেবা পেশাদার প্রয়োজনীয়তা বেশি বাড়বে যারা রোগীদের শুধু ওষুধই নয় বরং নৈতিক সমর্থন দেওয়ারও দক্ষতা রাখেন। চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞদের ক্রমাগত শিখতে হবে।আগামীতে মেকানিক, মেরামতকারী, ইলেকট্রিশিয়ান বা বিল্ডারদের মতো ম্যানুয়াল চাকরিতে পেশাদারদের প্রয়োজন বাড়বে। কিছু ছোট ছোট সুনির্দিষ্ট কাজ রয়েছে যা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বেশ প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে মানুষের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সবসময় সবার চেয়ে এগিয়ে থাকতে এবং সবার চাহিদার মধ্যে থাকার জন্য এই বিশেষজ্ঞদের ক্রমাগত তাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান উন্নত করতে হবে এবং নতুন স্মার্ট টুলগুলো ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কৃষিতে নতুন পেশার চাহিদাও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশ্বের জনসংখ্যা বাড়ছে এবং প্রত্যেকের বেঁচে থাকার জন্য খাবারের প্রয়োজন। তারপরও যদি তুলনা করা হয় কৃষক ও প্রকৌশলীর মধ্যে তা হলে এটি বলতেই হবে যে কৃষকদের চেয়ে দক্ষ প্রকৌশলীর চাহিদাই বেশি হবে। বিশ্বের বৃহত্তম পেশাদার নেটওয়ার্ক লাইকদিন দ্বারা পরিচালিত সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা পরবর্তী বছরের মধ্যে বৃদ্ধির পূর্বাভাসিত সবচেয়ে জনপ্রিয় চাকরির ক্ষেত্রগুলির সাথে আমাদের আপ-টু-ডেট রাখতে গবেষণাটি 'জবস অন দ্য রাইজ' নামে পরিচিত, এটি ১০০টি ক্ষেত্র বর্ণনা করে যা গত চার বছরে সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষণায় স্পষ্টভাবে দেখায় যে দ্রুততম ক্রমবর্ধমান ভূমিকাগুলি প্রযুক্তি, ডিজিটালাইজেশন এবং স্থায়িত্ব দ্বারা চালিত হয়। নবায়ন যোগ্য শক্তি প্রকৌশলী এবং সৌর শক্তি প্রকৌশলীও অত্যন্ত চাহিদাসম্পন্ন হয়ে উঠছে কারণ অনেক শিল্প নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে সরে যাচ্ছে। এটি লক্ষণীয় যে দ্রুততম-পতনশীল ভূমিকাগুলিও প্রযুক্তি এবং ডিজিটালাইজেশন দ্বারা চালিত হয়। জ্ঞানীয় দক্ষতা এবং সৃজনশীল চিন্তাভাবনাকে দ্বিতীয় মূল দক্ষতার তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে, যার পরে স্থিতিস্থাপকতা, নমনীয়তা এবং তত্পরতা সহ স্ব-কার্যকারিতা দক্ষতা। যদিও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা, ব্যস্ততার দক্ষতা এবং প্রযুক্তির দক্ষতা স্ব-কার্যকারিতার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়, তবুও তারা ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ব্যবসায়িক প্রত্যাশার কথা বলতে গেলে, এটি লক্ষণীয় যে জ্ঞানীয় দক্ষতাগুলি 'উত্থানের দক্ষতা' তালিকার শীর্ষে রয়েছে৷ কোম্পানিগুলি এমন কর্মচারীদের সন্ধান করবে যারা কার্যকরভাবে কর্মক্ষেত্রে জটিল সমস্যার সমাধান করতে পারে। জরিপ করা ব্যবসাগুলিও রিপোর্ট করে যে সৃজনশীল চিন্তাভাবনাও বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাভাবনার চেয়ে সামান্য দ্রুত গুরুত্ব পাবে। যাইহোক, প্রযুক্তির সাক্ষরতা হল তৃতীয়-দ্রুত ক্রমবর্ধমান মূল দক্ষতা। কোম্পানিগুলো নতুন কর্মী নিয়োগের সময় কাজের অভিজ্ঞতাকে সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করতে থাকবে।ইতিবাচকভাবে, আরও কোম্পানি এখন রিপোর্ট করেছে যে তারা প্রার্থী বাছাই করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ৪৫ % মনোযোগ দেওয়ার পরিবর্তে দক্ষতা মূল্যায়ন ৪৭% ব্যবহার করবে। তদুপরি, জরিপ করা কোম্পানিগুলির প্রায় ২০% স্বেচ্ছায় এমন কর্মচারী নিয়োগ করবে যারা শর্ট কোর্স সম্পন্ন করেছে বা অনলাইন সার্টিফিকেট পেয়েছে। শেষ পর্যন্ত, চাকরির ভবিষ্যত প্রতিবেদনে বর্ণিত বিভিন্ন কারণের কারণে প্রযুক্তি এবং আইটি খাত দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। নতুন এবং সীমান্ত প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান গ্রহণ আগামী পাঁচ বছরে কাজের বৃদ্ধিকে চালিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে চাকরির সংকট যে তৈরি হচ্ছে না তাও বলা যাবে না। এক কথায়, আধুনিক প্রযুক্তির যুগে বিশ্বজুড়ে চাকরির বাজার আগের চেয়ে অনেক দ্রুত বদলে যাচ্ছে। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |