/ মতামত / জনগণকে সম্পৃক্ত করার উপযুক্ত সময় এখনই
জনগণকে সম্পৃক্ত করার উপযুক্ত সময় এখনই
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
বাংলাদেশকে একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে রাষ্ট্র সংস্কার অপরিহার্য। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের প্রবল আগ্রহ দেখা দিয়েছে জনসাধারণের মধ্যে। অন্তর্বর্তী সরকার ছয়টি কমিশনও ঘোষণা করেছে। কমিশন ইতোমধ্যে তাদের কাজও শুরু করেছে। বাংলাদেশে এর আগে যতগুলো আন্দোলন হয়েছে তার মধ্যে এবারের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন অন্যতম। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ততা ও ব্যাপক অংশগ্রহণ। এ অভ্যুত্থান রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে ঘটেনি, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে বটে, কিন্তু অভ্যুত্থানটি ঘটেছে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে। আন্দোলন দমনে এমন নৃশংসতা আগে কখনো দেখা যায়নি। মানুষের প্রতিরোধও ছিল অসামান্যরূপে ঐক্যবদ্ধ ও দুঃসাহসী। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সুযোগের পাশাপাশি দায়িত্বও আছে দেশের শাসনব্যবস্থাকে অংশগ্রহণকেন্দ্রিক অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার।বিশ্বের সেরা উদাহরণগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে সেগুলোকে এ দেশের স্থানীয় প্রেক্ষাপটে খাপ খাইয়ে বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে পারে যে তার গণতন্ত্র স্থিতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। চলতি বছরে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের সময় পুরো জাতি একত্র হওয়ার অন্যতম চালিকা শক্তি ছিল জনগণের অংশগ্রহণ। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আশা নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ওই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁরা। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় ওই সব সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস হওয়ার পর চারদিকে কেমন যেন হতাশা কিংবা অস্থিরতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আন্দোলনের সময় সাধারণ জনগণের মধ্যে যে আবেগময় সংযোগ ও সংহতি তৈরি হয়েছিল, তা ক্রমেই ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে।সাধারণ জনগণ নিজেদের দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের প্রক্রিয়া থেকে ক্রমে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করছেন। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে আন্দোলনের সময় সবার অংশগ্রহণের যে সুযোগ তৈরি হয়েছিল কিংবা অংশগ্রহণের যে গুরুত্ব ও চাহিদা ছিল, তা এখন কার্যত আর নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্রমবর্ধমান জনবিচ্ছিন্নতা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও দেশের অনেক সাধারণ মানুষ এখন নিজেকে উপেক্ষিত মনে করছেন। তাঁরা মনে করছেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া দিন দিন সরকারকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে এবং জনগণের মতামত দেওয়ার পথগুলো আস্তে আস্তে সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। খুব দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে অন্তর্বর্তী সরকার ও সাধারণ জনগণের মাঝে সৃষ্টি হওয়া এই দূরত্বের কারণে জনগণের মধ্যে উদাসীনতা ও হতাশা সৃষ্টি হতে পারে, যা সরকারের সংস্কার প্রচেষ্টাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। জনগণের ভেতরের হতাশা কিংবা অস্থিরতার বিষয়টি স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে উন্নয়নমুখী রাজনৈতিক জনসংযোগ (পিসিডি) বিষয়ক একটি চলমান জরিপে। এখন পর্যন্ত ফলাফল থেকে দেখা যায়, জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রায় ৭৫ দশমিক ৪ শতাংশ মনে করেন, সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের অংশগ্রহণের আরও বেশি সুযোগ থাকা উচিত। শুধু ৬ দশমিক ৭ শতাংশ সরকারে তাঁদের অংশগ্রহণের সুযোগ নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ছিল সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ। ওই আন্দোলন পরবর্তী সময়ে সেখানকার সরকার ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন করে ‘গণশুনানি’-র মতো উদ্যোগের মাধ্যমে নাগরিকদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এই অংশগ্রহণ তাঁদের জাতি হিসেবে বর্ণবাদের কারণে সৃষ্ট ক্ষত কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁরা বর্ণবাদভিত্তিক নিপীড়ন থেকে অন্তর্ভুক্তি মূলক গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে পেরেছিলেন। ২০০৮ সালের কেনিয়ার নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার পর তৈরি হওয়া সাক্ষ্য একটি ক্রাউডসোর্সিং টুল, যা সাধারণ জনগণের কাছ থেকে সহিংসতার তথ্য সংগ্রহ ও রিপোর্ট তৈরি করার কাজে ব্যবহার করা হয়। এই প্ল্যাটফর্ম সরকারে স্বচ্ছতা ও নাগরিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশও অনুরূপ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরাসরি জনগণের মতামত সংগ্রহ করার পাশাপাশি সরকারি প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে তাদের যুক্ত করতে পারে। ‘ওপেন গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপ’একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ, যার মাধ্যমে স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণ মূলক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। এর সদস্যদেশগুলো জনগণের পরামর্শের ভিত্তিতে সরকারি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ উদ্যোগের সঙ্গে আমাদের দেশকে সম্পৃক্ত করে জনগণের অংশগ্রহণকে প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যেতে পারে।দেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে কিছু কৌশল বিবেচনায় রাখতে পারেন। যেমন: জনগণের অংশগ্রহণে আইনি কাঠামোতে- বিদ্যমান আইনের সংস্কার করা, যার মাধ্যমে নীতি প্রণয়নে জনপরামর্শ বাধ্যতামূলক হবে। এর মাধ্যমে নাগরিকদের অংশগ্রহণ শুধু রাজনৈতিক ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে না। এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান গুলোকে বাস্তবসম্মতভাবে ক্ষমতায়ন করা। এর মাধ্যমে জনগণ তাঁদের উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মতামত দিতে পারেন ও সিদ্ধান্ত নিতে পারার পাশাপাশি জবাবদিহিও নিশ্চিত করতে পারেন। অথবা ই-গভর্ন্যান্স প্ল্যাটফর্ম সহজে এবং সবার ব্যবহারের উপযোগী অনলাইন পোর্টাল তৈরি করা। এখানে নাগরিকরা নীতিমালা সম্পর্কে তাঁদের মতামত দিতে পারবেন, যেকোনো সমস্যা সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারবেন এবং নির্বিঘ্নে সব সরকারি সেবা পাবেন। দেশে বর্তমানে ১৯ কোটি সচল মুঠোফোন রয়েছে।যেকোন জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মুঠোফোন ব্যবহারকারীদের মতামত সংগ্রহ করার জন্য এসএমএস-ভিত্তিক জরিপ পরিচালনা করা যেতে পারে। এমনকি অংশীজন সংলাপের মাধ্যমে সখ্যালঘু, নারী, প্রান্তিক সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা এবং তাদের সঙ্গে পরামর্শ করার মাধ্যমে বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। সম্প্রতি যাঁরা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের অংশগ্রহণের জন্য দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যাতে তাঁরা জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। আমাদের মনে রাখতেই হবে, সাম্প্রতিক আন্দোলনে সফলতার মূল চালিকা শক্তি ছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। সবার মধ্যে প্রত্যাশা ছিল নিজের এবং নিজের সন্তানের, তথা দেশের জন্য ভালো কিছু করা। সেই আবেগের জায়গাকে পুনরুজ্জীবিত করার মাধ্যমে জনগণকে পুনরায় সরকারি নীতিনির্ধারণে যুক্ত করা শুধু প্রক্রিয়া ও নীতিমালার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না; সরকারকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা নাগরিকদের মতামতকে মূল্য দেয় এবং সে অনুযায়ী কাজ করে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারকে এখনই সতর্ক হওয়া দরকার। আরব বসন্ত চলাকালে যে বিপ্লবী উদ্দীপনা সবাইকে একত্র করে চূড়ান্ত সফলতা এনে দিয়েছিল, বিপ্লব পরবর্তী সময়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক বা জনগণের অংশগ্রহণভিত্তিক শাসনের অভাবে সেখানে সামগ্রিক অস্থিতিশীলতার সূচনা হয় এবং তাদের পশ্চাদপসরণ ঘটে। যেমন: মিসরে বিপ্লব পরবর্তী অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনের অভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয় এবং স্বৈরতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন ঘটে। আমাদের দেশের জনগণ যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছে, তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবার অংশগ্রহনের সুযোগ তৈরি করার কোনো বিকল্প নেই,যেমনটি হয়েছে চলতি বছরের আন্দোলনের ক্ষেত্রে। ঐ সময়ের ঐক্য ও সংকল্পকে সরকারের সঙ্গে জনগণের অংশগ্রহনের সুযোগ তৈরি করার সময় এখনই। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক, যেমন অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দান; যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে ও মানুষকে আহত করেছে, সেই অপরাধীদের আইনি ব্যবস্থার অধীন আনা। তা ছাড়া পুলিশ ও র্যাবের হাতে যে অপরিমেয় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, তার লাগাম টেনে ধরা; সম্পদ পাচার, লুণ্ঠন ও দুর্নীতি বন্ধ করা; কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা; দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা; মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চতকরণ, সব ধরনের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া; পুঁজিবাদী উন্নয়নের ধারা পরিহার করে উন্নয়নকে সামাজিক মালিকানার অভিমুখী করার নীতি গ্রহণ। মোটকথা হচ্ছে, এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলছে। মনে হয় অবস্থা অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আর ভীতি বা শঙ্কার ক্ষেত্রে বলব, যারা ভালো কাজ করেছেন, তাদের শঙ্কার কোনো কারণ নেই। কিন্তু যারা দলীয় ক্যাডারের মতো কাজ করেছে, তাদের জন্য কিছুটা এরকম থাকবে। যারা দলদাসের মতো আচরণ করেছে, তারা খেসারত দেবে। কিছুক্ষেত্রে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, সেগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, আরও দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আশা করি দ্রুতই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। আর এতে করেই সংস্কারে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে এটাই জনগণের প্রত্যাশা। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |