/ জাতীয় / দাবি নিয়ে ব্যস্ত গতিহীন প্রশাসন
দাবি নিয়ে ব্যস্ত গতিহীন প্রশাসন
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
জনপ্রশাসনে অস্থিরতা কাটছেই না। নিজেদের নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে ব্যস্ত কর্মকর্তারা। অতীতে বঞ্চিত বা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন এমন দাবি করে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত অনেকে। এ অবস্থায় নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার চার মাস পরও শৃঙ্খলা ফেরেনি মাঠ প্রশাসনে। কাটেনি স্থবিরতা। অনেকটা গতিহীন অবস্থায় চলছে মাঠ প্রশাসন। এতে সেবাবঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। প্রশাসনের মূল কেন্দ্র সচিবালয়ে বিরাজ করছে এক প্রকার বিশৃঙ্খলা। সব দাবির গন্তব্য যেন এখন জনপ্রশাসনে। বঞ্চিতের নামে আন্দোলনের মৌসুম বুঝে দাবি নিয়ে শামিল হচ্ছেন জনপ্রশাসনে। অভিযোগ উঠেছে, অতীতে গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্তরাও নিজেদের ‘বঞ্চিত’ দাবি করে চাপ তৈরির মাধ্যমে পদোন্নতি বাগিয়ে নিচ্ছেন। মন্ত্রণালয়ে নজিরবিহীনভাবে সভা-সমাবেশ করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অতীতে দাবি আদায়ে এমন দৃশ্য কখনো দেখা যায়নি। ওদিকে বৈষম্য দূর ও শৃঙ্খলা ফেরানো এবং জনবান্ধব প্রশাসন গড়তে সরকার যে সংস্কার উদ্যোগ নিয়েছে তা বাস্তবায়নের আগেই বাগড়া তৈরি করেছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। সংস্কার প্রস্তাবের বিপক্ষে প্রতিবাদ সভা আহ্বান করা হয়েছে এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে। এই সভায় সাবেক কর্মকর্তাদেরও দাওয়াত দেয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে জনপ্রশাসনে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়া শুরু হয়। আগেই অবসরে যান এমন কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে দায়িত্ব দেয়া হয়। সর্বশেষ জনপ্রশাসনের ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে একসঙ্গে পদোন্নতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একের পর এক দাবি পূরণ হওয়ায় দাবি পূরণের এই মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। এতে প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জনপ্রশাসনে এই চরম অস্থিরতা সাধারণ মানুষ ভালোভাবে দেখছে না। সচিব থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসন পর্যন্ত একই অবস্থা। গত সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনকারী সরকারি কর্মকর্তারা রয়েছেন বদলি এবং ওএসডি আতঙ্কে। আর এতদিন পদোন্নতি অথবা পদায়ণবঞ্চিতরা মরিয়া ওই সব পদে আসতে। মূলত এ নিয়েই তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নানা দাবি-দাওয়া তুলছে বিভিন্ন পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠন। রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে, এমনকি কেপিআইভুক্ত সচিবালয়ের ভেতরে-বাইরে কর্মসূচি পালন করছেন তারা। প্রশাসনকে এসব নিয়ে ব্যতিব্যস্ত রাখছেন তারা। জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া এ ব্যাপারে বলেন, প্রশাসনে অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ পরিস্থিতিতে কখনো কাজের গতি ঠিক থাকতে পারে না। কাজের গতি অনেক কমে গেছে। এমনকি রুটিন ও জনস্বার্থের কাজগুলোও করতে পারছে না। তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে প্রশাসনে দ্রুত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। একসঙ্গে তো সবকিছু করা যাবে না। কাজের অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে ভেবে-চিন্তে। এ ছাড়া সবাইকে খুশি করতে গেলে লেজেগোবরে হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, রাতারাতি কোনো কিছুর পরিবর্তন সম্ভব নয়। আগস্ট থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি উইংয়ে জড়ো হচ্ছেন বিভিন্ন ব্যাচের বঞ্চিত কর্মকর্তারা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরাও দাবি-দাওয়া নিয়ে সমাবেশ করেন সচিবালয়ে। প্রধান ফটকের সামনে বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করেন গ্রাম পুলিশ, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্য এবং পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায় চাকরিচ্যুত বিজিবি সদস্যরা। এর বাইরে রাজধানীর হেয়ার রোড, প্রেস ক্লাব, সচিবালয় এলাকায় মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলের (ম্যাটস) শিক্ষার্থীরা দুর্নীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেন। এদিকে ২২শে ডিসেম্বর সকালে সচিবালয়ের তিন নম্বর ভবনের সামনে জড়ো হন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। উপ-সচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের কোটা কমাতে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সামনে অবস্থান নেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। কয়েকশ’ কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস- উর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দাবি-দাওয়া পেশ করেন। ১৭ই ডিসেম্বর সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী জানান, উপ-সচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের ৫০ শতাংশ এবং অন্য সব ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ কোটা রাখার সুপারিশ করবেন তারা। ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের কাছে এই কমিশনের প্রতিবেদন দেয়ার কথা রয়েছে। তবে বর্তমান বিধিমালা অনুযায়ী, উপ-সচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের ৭৫ শতাংশ এবং অন্য সব ক্যাডারের ২৫ শতাংশ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়। কমিশনের সুপারিশের মধ্যে রয়েছে জনপ্রশাসনের উপ-সচিব ও যুগ্ম সচিব পদে পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি; উপ-সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য ৫০ শতাংশ ও অন্য ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ বরাদ্দ করা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত না রেখে আলাদা রাখা। কমিশনের সুপারিশের বিষয়গুলো সামনে আসার পরই এ ব্যাপারে প্রশাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। একই দিন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের জেলা শাখা সভাও করেছে। পদাধিকারবলে জেলা প্রশাসকরা এই সংগঠনের জেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। জেলা প্রশাসকরা সচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের কাছে কার্যবিবরণী পাঠিয়ে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরছেন। প্রশাসন ক্যাডার উপ-সচিব থেকে সচিব পর্যন্ত সব পদে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদায়ন চায়। অন্যদিকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাদের ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত না রাখার সুপারিশের বিপক্ষে। মানে তারা ক্যাডারেই থাকতে চান। এরই মধ্যে ২৫টি ক্যাডার নিয়ে গঠিত ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ শনিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় একটি সভা করে। সভায় পরিষদের সঙ্গে পরিষদভুক্ত ২৫টি ক্যাডারের পৃথক সংগঠনের নেতাদের মতবিনিময় হয়। সভা থেকে প্রতিটি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দিয়ে পরিচালনা ও কোটামুক্ত উপ-সচিব পুলের দাবিতে কলমবিরতিসহ আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে জনপ্রশাসন সংস্কারকে ভিন্নপথে পরিচালিত করে দেশকে অস্থিতিশীল করার গভীর ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত এবং কর্মরত কর্মকর্তাদের যৌথ প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন। যা আজ ২৫শে ডিসেম্বর রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে হওয়ার কথা রয়েছে। এদিকে, জনপ্রশাসনে সর্ষের মধ্যে থাকা ভূত তাড়াতে জনগণই একমাত্র ভরসা বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্যরা। ২৩শে ডিসেম্বর সকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় কমিশন সদস্যরা এ কথা বলেন। কমিশনের সদস্যরা বলেন, জনপ্রশাসনকে একটি সুন্দর কাঠামোর ওপর দাঁড় করানো সকলের দায়িত্ব। জনগণের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবং প্রশাসন ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার জন্য জনপ্রশাসন কাজ করবে। সেবা প্রদানকারী সরকারি কর্মচারীদের কাজ স্বচ্ছ রাখতে এবং নাগরিকদের সেবা পাওয়ার সমস্যা সমাধানের জন্য জনগণের মতামত জরুরি বলে তারা জানান। |