/ মতামত / জলবায়ু সংকট বর্তমান বিশ্বে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ
জলবায়ু সংকট বর্তমান বিশ্বে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
বৈশ্বিক গ্রিন হাউস নির্গমনের ক্ষেত্রে মাত্র শূন্য দশমিক চার শতাংশ ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও জলবায়ুগত প্রভাবের অভিঘাতে রয়েছে বাংলাদেশ। জলবায়ু বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্যানেলের (আইপিসি) রিপোর্টে উল্লেখিত জাতিসংঘের বিজ্ঞানীদের একটি প্যানেল হুঁশিয়ার করেছে, মানুষের নানা কর্মকাণ্ডের পরিণতিতে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে দ্রুত সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে এবং প্রতিনিয়ত বরফ গলছে। মেরু অঞ্চলের বরফের আচ্ছাদন বিলীন হওয়ার কারণে কার্বণ নিঃসরণের মাত্রাও বেড়ে চলছে। বিভিন্ন জীবজন্তুর আবাসস্থল বদলাচ্ছে।এই শতকের শেষ ভাগে যদি বিশ্বের তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায় তবে তার পরিণতি কী হতে পারে সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।বর্তমান সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বহুল আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। বলাই যায় এটি একুশ শতকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দিন দিন জলবায়ুর পরিবর্তন জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলায় তা আমাদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে গবেষণাও চলছে ব্যাপক হারে।প্রাকৃতিক কারণে জলবায়ুতে স্বাভাবিক ভাবেই কিছু পরিবর্তন হয়।কিন্তু যে মাত্রায় এখন তাপমাত্রা বাড়ছে তার মানুষের কর্মকাণ্ডই প্রধানত দায়ী। মানুষ যখন থেকে কল-কারখানা এবং যানবাহন চালাতে বা শীতে ঘর গরম রাখতে তেল, গ্যাস এবং কয়লা পোড়াতে শুরু করলো সেই সময়ের তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা এখন এক দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। বায়ুমণ্ডলে অন্যতম একটি গ্রিন হাউজ গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ উনবিংশ শতকের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। গত দুই দশকে বেড়েছে ১২ শতাংশ। বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণেও বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন বাড়ছে। গাছপালা কার্বন ধরে রাখে। ফলে, সেই গাছ যখন কাটা হয় বা পোড়ানো হয়, সঞ্চিত সেই কার্বন বায়ুমণ্ডলে নিঃসরিত হয়। যেকোনো অঞ্চলে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য চাই সুস্থ ও নির্মল পরিবেশ। আমাদের সামগ্রিক জীবনের ওপর পরিবেশের প্রভাব অপরিসীম। বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের অবক্ষয় সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত একটি বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, বন্যা, দুর্যোগ, বন উজাড়, নদীভাঙনের মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী কোনো না কোনো অঞ্চল পরিবেশ বিপর্যের সম্মুখীন। দেশে সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজন ও চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়েছে; মূলত ব্যাপক জনঘনত্ব ও ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর বিভিন্ন ধরনের চাপ বাড়ছে, ফলে দেশব্যাপী পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে।যেমন গাছপালা কর্তন, মাটি উত্তোলন ও পাহাড় কাটা, গভীর নলকূপের মাধ্যমে মাটির নিচ থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন, অতিরিক্ত সেচকাজ ইত্যাদি দেশের পরিবেশকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি বৈশ্বিক উষ্ণতা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, খরা,বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা মানবজীবনে বিপজ্জনক প্রভাব ফেলছে। বিশ্বের নানা অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংকটাপন্ন। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদাসীনতা এবং বিশেষত শক্তিধর দেশগুলোর নিষ্ক্রিয়তা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে কপ২৯ সম্মেলন। এতে প্রভাবশালী বিশ্বনেতাদের অনুপস্থিতি এবং এ নিয়ে তাদের উদাসীনতা নানা প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। বিশেষত ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বিশ্বনেতাদের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে নিষ্ক্রিয়তা এবং তাদের বিতর্কিত মন্তব্য এই সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের অভাব স্পষ্ট করে। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে দেশটির জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ঘটনা পরিবেশ আন্দোলনে একটি বড় ধাক্কা, যা বর্তমান বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় সম্ভাব্য বাধা। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর উদাসীনতা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বাস্তব সমাধান খুবই জরুরি। তবে এসবের জন্য দায়ী ধনী ও কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো যেমন: যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জার্মানি, ফ্রান্স থেকে অর্থনৈতিক সহায়তা বা সংকট মোকাবিলায় কোনো সুস্পষ্ট পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এগুলো বিশ্বনেতাদের ব্যর্থতারই প্রমাণ। সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যৌথ প্রচেষ্টা ও দায়িত্বশীলতা অপরিহার্য। চলতি বছর বাকুতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় কিছু অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। উন্নত দেশগুলো জোগান দেওয়ার কথা ছিল ১৩শ বিলিয়ন ডলার, যা বহু দরকষাকষির পর কেবল ৩০০ বিলিয়ন ডলারের আশ্বাস দেওয়াটা সত্যিই হতাশা জনক। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এখানে সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় অঞ্চল এবং নদীভাঙনে হাজার হাজার বাড়িঘর তলিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না হলে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে সংকট আরও গভীরতর হতে থাকবে।অতীতে বাংলাদেশে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় যে অর্থ এসেছে, তার ব্যবহারে কোনো স্বচ্ছতা দেখা যায়নি। বরং অনেক সময় দুর্নীতি ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে এসব অর্থ তেমন কার্যকর ফল দেয়নি। বন্যার তীব্রতা বৃদ্ধি, খাদ্য ও পানি সংকট এবং উপকূলীয় জনগণের ব্যাপক বিপর্যয় এর প্রমাণ। গত এক দশকে বাংলাদেশে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু তহবিল থেকে এসেছে, কিন্তু তার কোনো স্পষ্ট হিসাব নেই। এই অর্থ যদি সঠিকভাবে ব্যবহৃত হতো, তাহলে দেশের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের মানুষদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পেত। বিশেষত উপকূলীয় ও পার্বত্য অঞ্চল গুলোতে সমুদ্রের উচ্চতা ও ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বাড়ছে। এ ছাড়া রয়েছে পানি ও খাদ্যের অভাব, ভাঙন, খাদ এবং ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়া। এসব অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পর্যাপ্ত পদক্ষেপ বা অর্থের সঠিক ব্যবহার ঘটেনি। ফলে জনগণের জীবনযাত্রার মান আরও খারাপ হয়েছে। যদি জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বরাদ্দকৃত অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হতো, তাহলে এ সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যেত। আমাদের দেশে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ কার্যকর হয়নি।এসব পদক্ষেপ প্রায়ই জনগণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নয় এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের বাইরে। সরকার যেসব প্রকল্প বা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তা মূলত শহর-উপশহরের জন্য বেশি প্রযোজ্য। এগুলো গ্রাম, উপকূলীয় ও পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যা যথাযথভাবে মোকাবিলা করছে না। ফলে উপকূলীয় এলাকার ভাঙন, পার্বত্য অঞ্চলের খাদ্য ও পানি সংকট এবং বন্যাজনিত সমস্যা রয়ে যাচ্ছে। সাবেক সরকারের উদ্যোগ প্রায়ই বড় বড় প্রকল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।যেগুলো সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় কোনো প্রভাব রাখতে পারেনি।জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় যা কিছু পদক্ষেপ, অভিযোজন, সহনশীলতা ও স্থানীয় উদ্যোগ,তার সবই মূলত ভুক্তভোগী মানুষের একান্ত নিজস্ব চিন্তাশক্তির ফসল। জনগণের প্রচেষ্টা কাঙ্ক্ষিত ফল দিচ্ছে না। একদিকে সরকারের কার্যকর উদ্যোগের অভাব; অন্যদিকে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা বাংলাদেশে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবসৃষ্ট এ সমস্যা মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগ জনগণের কল্যাণে আনতে হবে এবং দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, শিল্প বিপ্লব শুরুর আগে বিশ্বের যে তাপমাত্রা ছিল তার থেকে বৃদ্ধির মাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা গেলে বড় ধরণের বিপদ এড়ানো যাবে। তা না পারলে বিপজ্জনক হয়ে পড়বে প্রকৃতি, পরিবেশ এবং মানুষের জীবন। অনেক বিজ্ঞানীর আশঙ্কা যে ভয়ঙ্কর এই পরিণতি ঠেকানোর আর কোনো উপায় নেই এবং চলতি শতকের শেষে গিয়ে বিশ্বের তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। তা হলে এর প্রভাব বিশ্বের একেক জায়গায় একেক রকম হবে। বাংলাদেশের সমগ্র নগর এলাকাগুলোর জন্য পরিকল্পিত নগরায়ণ ও নগরনীতি বাস্তবায়ন এখন সময়ের অন্যতম দাবি।একই সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় গুলোর জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের এবং তাদের মধ্যে বাজেট বরাদ্দের সমন্বয় সাধন করা অতি প্রয়োজনীয়, যাতে স্থানীয়ভাবে কোন খাতে কত বরাদ্দ দরকার, তা অনুধাবন করা যায়। এর থেকে পরবর্তীকালে বুঝতে পারব যে আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে কতটুকু এগোতে পেরেছি।আমাদের আরো দেখতে হবে,তরুণদের কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আরো গভীরভাবে সম্পৃক্ত করতে পারি। পরবর্তী প্রজন্মই জলবায়ু পরিবর্তনের মূল শিকার হতে চলেছে। সবশেষে বলা যায়, ২০৩০ সালের ভেতর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও প্রতিকারের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সামগ্রিক পরিকল্পনা, অর্থায়ন, বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |