/ শিক্ষা / ডাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘিরে উত্তেজনা
ডাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘিরে উত্তেজনা
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বেই আগস্টের ছাত্র-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। এরপর থেকে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর ধরে বন্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন (ডাকসু) আয়োজনের দাবি জানিয়ে আসছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তবে এই ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট মতপার্থক্য দেখা গেছে বিভিন্ন বড় ছাত্র সংগঠনগুলোর মাঝে। প্রক্রিয়া, সম্ভাব্য সংস্কার ও নির্বাচনের সময় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছে ছাত্রসংগঠনগুলো। এ নিয়ে বিরোধ, পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, প্রতিবাদ মিছিলে সরগরম হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস। কোনো পক্ষ দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বললেও অন্য পক্ষ যাবতীয় সংস্কার ও উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতের পরেই নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রক্রিয়ার পক্ষে। এনিয়ে গত কয়েক মাসে নানা বক্তব্য ও বিতর্কের মধ্যেই বৃহস্পতিবার রাতে পরিস্থিতি হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সেদিন আওয়ামীপন্থি সদস্যদের নিয়েই সন্ধ্যা ছয়টা থেকে শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের মিটিং। প্রতিবাদে ছাত্রদলসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা সিনেট ভবনে উপস্থিত হয়ে প্রতিবাদ জানায়। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীসহ সব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফরমের অনেক সমন্বয়কের অভিযোগ সিন্ডিকেটের মিটিংয়ে ছাত্রদল ইলেকশন ‘বিলম্বের’ জন্য ভিসি ও প্রক্টরকে ‘হেনস্তা’ করেছে। এ নিয়ে মধ্যরাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিবাদ মিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী সাকিব আহমেদ বলেন, গণতান্ত্রিক ডাকসুর যারা বিরোধিতা করেন, তাদের জায়গা এই ক্যাম্পাসে হবে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক মাহিন সরকারও সেই সমাবেশে ডাকসু নিয়ে বিরোধিতার প্রতিবাদ জানিয়ে দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানান। তবে ডাকসু ইলেকশন প্রভাবিত করার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর চাপ প্রয়োগের অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেছে ছাত্রদল। এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তারা নিজেদের অবস্থানও স্পষ্ট করেছে। যদিও সেদিন রাতে সিনেটে উপস্থিত বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মীকে শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে সংগঠনটি। শৃঙ্খলাভঙ্গের নোটিশ পাওয়া মহসিন হল শাখা ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক মনসুর রাফি বলেন, মূলত ক্যাম্পাসে আমাদের একটি ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা চলছিল। সেটির কার্যক্রম রেখে এবং বিশ্ববিদ্যালয় সেক্রেটারি-সভাপতিকে না জানিয়ে সিনেটে উপস্থিত হওয়া ও ব্যক্তিগতভাবেই দলীয় অবস্থান তুলে ধরায় এ কারণ দর্শানের নোটিশ দেয়া হয়েছে। ভিসি-প্রক্টরের সঙ্গে অশালীন আচরণের অভিযোগ অস্বীকার করেন এই ছাত্রদল নেতা। শুধুমাত্র ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সিনেট সদস্যদের মিটিংয়ে উপস্থিত হওয়ার প্রতিবাদ জানাতেই সিনেটে গিয়েছিলেন বলে জানান তিনি। ডাকসু এ নিয়ে দলীয় অবস্থান জানতে চাইলে ঢাবি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক শিপন হাবিব বলেন, ছাত্রদল একমাত্র সংগঠন যারা গত ১৫ বছর প্রকাশ্যে ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করে গেছে। ছাত্রদল নিয়ে স্পষ্ট মিথ্যাচার করছে একটি পক্ষ। আমরা সব সময় ডাকসুর পক্ষে ছিলাম। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতো ছাত্রদল চায় সব সংস্কারের পরেই গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। সর্বশেষ ২০১৯ সালে যেই নির্বাচন হয়েছিল সেটিতে ছাত্রলীগকে জেতানোর জন্য গঠনতন্ত্র ইচ্ছেমতো সংশোধন করা হয়েছিল। ফলে সেই গঠনতন্ত্রের পুরোপুরি সংস্কার করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সিন্ডিকেট আওয়ামী লীগের দোসর ছিল। তাদের পরোক্ষ মদদেই ১৫ই জুলাই শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়। ফলে এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এটি অবিলম্বে ভেঙে দিয়ে নতুন সিন্ডিকেট গঠন করতে হবে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় একটা ‘মবের’ কালচার চলছে। ডাকসু ইলেকশনের আগে এই কালচার বন্ধ করে উপযুক্ত পরিবেশও সৃষ্টি করতে হবে। এ ব্যাপারে ঢাবি শাখা ছাত্রশিবিবের নতুন সেক্রেটারি মহিউদ্দিন খান মানবজমিনকে বলেন, আমরা সব সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির পক্ষে। প্রয়োজনীয় সংস্কার আমরাও চাই। তবে শুধু দাবি তুললেই হবে না, সংস্কারের প্রক্রিয়া দ্রুত প্রশাসনের কাছে তুলে ধরতে হবে ছাত্র সংগঠনগুলোকে। এই দাবি করে কালক্ষেপণের সুযোগ নেই। আমরা শিগগিরই আমাদের প্রস্তাবনাগুলো তুলে ধরবো। যত দ্রুত সম্ভব সব সংস্কার শেষ করেই ডাকসু ইলেকশনের তারিখ ঘোষণা করা উচিত। এ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা আশা করি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের মত ও আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দিবে। যত দ্রুত সম্ভব যাবতীয় সংস্কার প্রক্রিয়া শেষ করে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে এবং সব পক্ষকে নিয়ে ডাকসু ইলেকশন অনুষ্ঠিত হতে হবে। ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, আমরা চেয়েছিলাম জানুয়ারির শেষে অথবা ফেব্রুয়ারির শুরুতে যাতে ডাকসু নির্বাচন হয়। তবে এই সময়ে নির্বাচন করার জন্য যে ধরনের কার্যকর পদেক্ষপ নেয়া দরকার সেটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এখনো নিতে দেখিনি। তবে কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গঠনতন্ত্র সংস্কার না করে দ্রুত সময়ে ডাকসু নির্বাচন দেয়া উচিত হবে না। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি (একাংশ) রাগিব নায়িম বলেন, আমরা যে ছাত্র আন্দোলন করেছি সেটাকে সফল করার জন্য অবশ্যই ডাকসু নির্বাচন দিতে হবে। ডাকসু নির্বাচনের আগে প্রশাসনকে ক্যাম্পাসের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে হবে। একটু সময় নিয়ে ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কার করা দরকার বলে আমি মনে করি। এদিকে আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে শিক্ষার্থীদের একটি দল। শিক্ষার্থীদের দাবি, এই রোডম্যাপের মধ্যেই প্রয়োজনীয় সংস্কারের সময় নির্দিষ্ট করতে হবে। যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা করা না হয়, তাহলে তারা কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করবেন। শুক্রবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদ এ স্মারকলিপি গ্রহণ করেন। এদিকে ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কারের জন্য ইতিমধ্যেই একটি কমিটি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বৃহস্পতিবারের সিনেট মিটিংয়ে সেই কমিটি অনুমোদন দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিয়াশীল সব সংগঠনকে চিঠি দিয়ে সংস্কারের ব্যাপারে তাদের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে। আগামী ৮ই জানুয়ারির মধ্যে ছাত্র সংগঠনগুলোকে তাদের মতামত দিতে হবে। ৯ই জানুয়ারি এ নিয়ে আলোচনায় বসবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদ বলেন, গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্য নেয়া এই উদ্যোগও রোডম্যাপেরই অংশ। প্রশাসন ইলেকশনের ব্যাপারে আন্তরিক। সবপক্ষ আমাদের আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করলে দুই মাসের ভেতরই একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে পারবো বলে মনে করি। এদিকে গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যম্পাসে এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন নিয়ে অত্যন্ত আশাবাদী। আমরা চাই, সবার মধ্যে নির্বাচন নিয়ে ঐক্য তৈরি হোক। সবার মধ্যে এ ব্যাপারে যেন চুক্তি বা সমঝোতার মতো কিছু হয়। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক মুক্ত ও প্রাণবন্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এই পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে এক আনন্দমুখর পরিবেশে নির্বাচন আয়োজন করতে চাই। এটি সফল করতে আমরা সকল পক্ষের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করছি, যেন সবার অংশগ্রহণে একটি উদাহরণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা যায়। |