/ মতামত / দক্ষতাসম্পন্ন কর্মশক্তি তৈরিতে মনোযোগ দিতে হবে
দক্ষতাসম্পন্ন কর্মশক্তি তৈরিতে মনোযোগ দিতে হবে
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
জুলাই আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। এ আশাই আমরা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর লালন করেছিল মানুষ। এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পুরোনো পদ্ধতি, জ্ঞান ও অনমনীয় মানসিকতা আজকের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারবে না। পুরোনো প্রজন্মের নীতিনির্ধারকেরা এক পরীক্ষার মুখে পড়েছেন। তা হলো নতুন প্রযুক্তিগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা। এ প্রযুক্তি আজ ব্যবসা ও সেবার গতি-প্রকৃতিকে রূপান্তরিত করছে। এ প্রযুক্তিগত অগ্রগতির যুগে ডিজিটাল, ফিজিক্যাল ও জৈবিক ব্যবস্থা একত্র হচ্ছে। আগের শিল্পবিপ্লবগুলোতে বাষ্পশক্তি,বিদ্যুৎ ও ডিজিটাল কম্পিউটিংয়ের মতো বিশেষ কিছু উদ্ভাবন প্রধান চালিকা শক্তি ছিল। আজ চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বিভিন্ন উদীয়মান প্রযুক্তিগুলোর সমন্বয়ে ফিজিক্যাল ও ডিজিটাল জগতের মধ্যে সীমানা মুছে দিয়েছে। এই চতুর্থ বিপ্লব নির্মিত হচ্ছে ডিজিটাল বিপ্লব বা তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের ওপর ভিত্তি করে। এটি আন্তসংযুক্তি ও স্বয়ংক্রিয়তার নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছে। আমাদের জীবনযাত্রা, কাজ ও পারস্পরিক সম্পর্ক মৌলিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব যুগে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কোনো সর্বজনীন মডেল নেই; প্রতিটি দেশকে তাদের স্থানীয় অগ্রাধিকার এবং বৈশ্বিক সুযোগের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে নিজস্ব প্রেক্ষাপটনির্ভর কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। ঘনবসতিপূর্ণ একটি উন্নয়নশীল দেশ ও ক্রমবর্ধমান যুব জনগোষ্ঠীর অধিকারী বাংলাদেশ এমন কিছু স্বতন্ত্র চ্যালেঞ্জ ও সুযোগের মুখোমুখি, যা একটি প্রাসঙ্গিক এবং লক্ষ্যভিত্তিক কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি দাবি করে। যুব জনগোষ্ঠীর এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে কাজে লাগাতে হলে তথ্যপ্রযুক্তি, সাইবার নিরাপত্তা, ডিজিটাল মার্কেটিং, ই-কমার্স, বিজনেস অ্যানালিস্ট, ব্লকচেইন ডেভেলপার,নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও হালকা প্রকৌশলসহ উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী খাতগুলোয় দক্ষতা উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুযোগগুলো কাজে লাগানোর জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছে, যা তাদের নিজস্ব ইতিহাস, সম্পদ ও কৌশলগত অগ্রাধিকারের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের জানা দরকার যে এশীয় দেশগুলো কীভাবে এসব সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে অভিযোজনশীল নীতিমালা গ্রহণ করেছে। সিঙ্গাপুর তার ছোট আকার এবং কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষা, গবেষণা ও উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মশক্তিকে কেন্দ্র করে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলেছে। চীন নির্মাণ শিল্প এবং অবকাঠামোগত আধিপত্য থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও ডিজিটাল ইকোসিস্টেমের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতার দিকে রূপান্তর করেছে। জাপান ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলোকে উন্নত রোবোটিকস এবং স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির সঙ্গে সমন্বয় করে উচ্চ মূল্যের উৎপাদন এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা ধরে রেখেছে। ভারত আইটি ও ডিজিটাল সার্ভিস প্রসারকে শ্রমশক্তির দক্ষতা উন্নয়ন এবং অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পরিচালনা করছে। বর্তমানে কৃষি,খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ,তৈরি পোশাক,আইসিটি, ওষুধ, চামড়াজাত পণ্য, পাটজাত পণ্য এবং হালকা প্রকৌশল খাতগুলো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চালিত করছে। এ শ্রমনির্ভর শিল্পগুলোর উৎপাদনশীলতা বাড়াতে ধীরে ধীরে অটোমেশন অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে আকস্মিক ভাবে কর্মসংস্থান হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা না থাকে। তবে ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলোর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা দেশের দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতাকে সীমিত করে।আমাদের দেশের জন্য জরুরি অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে রয়েছে শিল্প খাতের বৈচিত্র্যকরণ। স্থানীয় গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) এবং সবুজ প্রযুক্তির মতো আধুনিক খাতে স্থানীয় দক্ষতা তৈরি করা। দেশকে এমন উদ্ভাবনী নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে, যা স্থানীয় সমস্যার সমাধানে মনোযোগ দেয়, যেমন টেকসই কৃষি, দুর্যোগ সহনশীলতা ও নগরায়ণ। পুঁজি ও প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে দেশকে ভারী শিল্প উৎপাদন এবং মৌলিক গবেষণার পরিবর্তে প্রয়োগভিত্তিক উদ্ভাবনী গবেষণায় অগ্রাধিকার দিতে হবে। বৃহৎ জনসংখ্যার কারণে একটি উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মশক্তি তৈরির দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে, যা উদ্ভাবনী পরিবর্তন সাধনে এবং আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার দখলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি করতে হলে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে অবশ্যই উন্নত করতে হবে। এর মূল ভিত্তি হবে সেই ধরনের শিক্ষা নির্ধারণ করা, যা কর্মশক্তিকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য কার্যকরভাবে প্রস্তুত করতে সক্ষম। যা শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক, আন্তঃবিষয়ক এবং প্রাসঙ্গিক সম্পৃক্ততাকে গুরুত্ব দেয়। এ কাঠামো শিক্ষার্থীদের জন্য ডিজিটাল সাক্ষরতা, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা, সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি, সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, সহানুভূতি, সহযোগিতা এবং অভিযোজনযোগ্যতার মতো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে।দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই একীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। শিক্ষকদের উচিত পরিবর্তনের প্রতি ঐতিহ্যগত প্রতিরোধের মানসিকতা থেকে সরে আসা এবং উচ্চ শিক্ষায় প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করা, যা উদ্যমী ও প্রাণবন্ত তরুণ প্রজন্মের জন্য উপকারী হবে। দেশ বর্তমানে এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। প্রয়োজনীয় পরিবর্তনে বিলম্ব অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ বাড়িয়ে তুলবে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সম্ভাবনাগুলো হাতছাড়া করার ঝুঁকি তৈরি করবে। ইন্ডাস্ট্রিজে বৈচিত্র্য আনয়ন, শিক্ষার আধুনিকীকরণ এবং উদ্ভাবনের প্রসার ঘটিয়ে বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে ব্যবস্থাকে খণ্ডিতভাবে না বুঝে সামগ্রিকভাবে বুঝতে হয়। কাজেই গ্র্যাজুয়েটদের এমন কর্মশক্তি হতে হবে, যাঁদের রয়েছে গভীর দক্ষতা, আবার যাঁরা অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা করতে সক্ষম। দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমগুলো এমন পদ্ধতি অনুসরণ করে, যা জটিল সিস্টেমগুলোকে বিশ্লেষণের জন্য বিভিন্ন অংশে ভাগ করা হয়। তবে এ পদ্ধতি আজকের আন্তসংযুক্ত বিশ্বের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এখন চাই আরও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত, আন্তসংযুক্ত বিশ্বে বাঁচতে হলে অবিলম্বে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব-চালিত অর্থনীতিকে গ্রহণ এবং উচ্চশিক্ষার রূপান্তর ঘটাতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের হার মাত্র ১৪ শতাংশ, অন্যদিকে উন্নত বিশ্ব এই হার ৬০ শতাংশ। সেহেতু আগামী দিনের বিশ্বব্যবস্থার প্রযুক্তিগত সক্ষমতায় দক্ষ জনশক্তি তৈরির বিকল্প নেই। এজন্য আমাদের দক্ষ জনশক্তিতে বলীয়ান হয়ে বৃত্তের বাইরে এসে চিন্তা করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। আর এজন্য রাষ্ট্র, নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞদের চিন্তার সমন্বয় ঘটিয়ে উক্ত চ্যালেঞ্জের উত্তরণ ঘটাতে হবে।চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে দেশে প্রচুর সেমিনার আর গোলটেবিল বৈঠক হচ্ছে। সবারই একই মত, এই বিপ্লব মোকাবিলায় অনেক কাজ করতে হবে। এআই, আইওটি, বিগ ডেটা, ব্লকচেইনের মতো জনপ্রিয় শব্দ নিয়ে কথা বলা হচ্ছে সেখানে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ নেই। আর কেবল পরিকল্পনা করলেই তো হবে না, অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের মানবসম্পদকেও যথাযথভাবে প্রস্তুত করতে হবে এই পরিবর্তনের জন্য। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |