/ মতামত / গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী যে পরিবর্তনের অঙ্গীকার
গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী যে পরিবর্তনের অঙ্গীকার
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
বাংলাদেশের মানুষ আর আগের ব্যবস্থায় ফেরত যেতে চায় না; এ কারণেই তারা সংস্কার চায়। কিন্তু সংস্কার কীভাবে করা যায়, কীভাবে করা হলে তা টেকসই হবে রাজনৈতিক পরিসরের তর্কবিতর্ক, বিশ্লেষণের মধ্যে আগে থেকে এ বিষয় উপস্থিত ছিল না। আমাদের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল, দলের নেতা-কর্মী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও শিক্ষকদের অনেকেরই এ বিষয়ে অস্পষ্টতা আছে। ফলে যাঁর যা ইচ্ছা, তেমন করে সমস্যার সমাধান দিয়ে যাচ্ছেন, যার অধিকাংশই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। বর্তমান পরিস্থিতি যে সমস্যার সমাধান দাবি করছে, তা আমাদের সমাধান বের করতে হবে এবং সে সমাধান অধিকাংশ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। গত বছরের ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পলায়নের পর বাংলাদেশের রাজনীতি এক নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে। অভ্যুত্থানের আগে স্লোগান ছিল-রাষ্ট্র সংস্কার লাগবে। অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কার যে লাগবে, এ বিষয়ে ক্রিয়াশীল সব রাজনৈতিক দলই একমত। প্রায় প্রতিটি সক্রিয় দল, দলনিরপেক্ষ বিভিন্ন সংস্থা ও বিশিষ্ট নাগরিকেরা সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে সংস্কারবিষয়ক প্রস্তাব জমা দিয়েছেন, মতামত দিচ্ছেন। সংবিধানের কোন কোন অংশ বদলাতে হবে, কী বাদ দিতে হবে, কী যোগ করতে হবে-এসব নিয়ে বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে মতভিন্নতা আছে। কিন্তু সংবিধানের সংস্কার যে করতে হবে, তা নিয়ো কোনো মতপার্থক্য নেই বললেই চলে। ৫ আগস্টের আগে সংবিধান সংস্কারের দাবি ছিল একটি অগ্রসর আকাঙ্ক্ষা বা প্রত্যাশা। কিন্তু বর্তমানে সেই দাবি আর প্রত্যাশার স্তরে নেই; এটি এখন বাস্তবায়নের পর্বে প্রবেশ করেছে। দেশ স্বাধীনের পর থেকে রাষ্ট্র পরিচালনায় যে দল বা জোট এসেছে, তারা কেউই জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় নেয়নি। এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যন্ত এমনভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রীয় কর্মচারীরা জনগণের শাসক ও শোষকে পরিণত হয়েছেন। নতুন প্রজন্মের একটি বড় অংশ যাঁদের বয়স ত্রিশের নিচে, তাঁরা এখন পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। আওয়ামী লীগ প্রায় ১৬ বছর যাবৎ আইন করে, ভয় দেখিয়ে, কৌশলে দেশে অগণতান্ত্রিক এক পরিবারকেন্দ্রিক দুর্নীতিগ্রস্ত জবাবদিহিহীন দখলদারত্বের ধারাকে পাকাপোক্ত করেছে, যা সাধারণ মানুষ এবং নতুন প্রজন্মকে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করেছে। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে। কেবল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পুলিশ-বিজিবির নির্বিচার গুলিবর্ষণ, শিশুমৃত্যু, সামাজিক মাধ্যমে উঠে আসা নৃশংসতার চিত্র মানুষকে পয়েন্ট অব নো রিটার্নে নিয়ে গিয়েছে। কারফিউ, ইন্টারনেট শাটডাউন মানুষকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি, বরং ঐক্যবদ্ধ করেছে। সরকার কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের গ্রেপ্তার করেও আন্দোলনকারীদের মনোবল ভাঙতে পারেনি।জেল-জুলুম-নির্যাতন কোনো কিছুই আন্দোলনকে দমাতে পারেনি। এই আন্দোলনে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অভূতপূর্ব ঐক্যবোধ ও সংহতি তৈরি হয়েছিল। বিশ্বাসের পার্থক্য, রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্য, ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা, শ্রেণিগত পার্থক্য-সবকিছু ছাপিয়ে তারা একটি উদ্দেশ্যে মিলিত হয়েছিল। এ কৃতিত্ব একক কোনো রাজনৈতিক দলের নয়। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের ব্যানারে ন্যায্য এই আন্দোলনে ক্রমে বিভিন্ন শক্তি, রাজনৈতিক দল একাত্ম হয়ে ভূমিকা রেখেছে। গণ-অভ্যুত্থানের পরেই কোনো কোনো রাজনৈতিক দল এ আন্দোলনের ফসল আত্মসাতের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। কেউ কেউ আওয়ামী কায়দায় বাজারঘাট, স্টেশন, নদী, সিন্ডিকেট দখলের কাজে যুক্ত হয়ে পড়েছে। জনগণ এসব কর্মকাণ্ড ভালো চোখে দেখছে না। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে একদল লোক মন্দির-মাজারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আক্রমণ করেছে। যা মোটেও কাম্য নয়। যেকোনো সফল অভ্যুত্থানে সম্ভাবনা যেমন তৈরি হয়, তেমনি পদে পদে ঝুঁকিও থাকে। গত জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রেও সে কথা একইভাবে প্রযোজ্য। তবে এ আন্দোলনের সফলতা ও ন্যায্যতা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা গেলে জনগণের দ্বিধাদ্বন্দ্ব যেমন দূর করা সম্ভব, একই সঙ্গে ঝুঁকি মোকাবিলা করাটাও সহজসাধ্য হবে। ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান যে বিষয়গুলো মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, সেগুলো হচ্ছে: নির্বাচনের নামে প্রহসনের মাধ্যমে বাংলাদেশে হাসিনার যে একদলীয় ও এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক লুটেরা স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই লুটেরা স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে। এই অভ্যুত্থান সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্র ও সমাজে জেঁকে বসা দুর্নীতি, লুটপাট, দখলদারত্ব, অর্থ পাচার, বিচারহীনতা ও ঋণখেলাপি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এবং রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি উত্থাপিত হয়েছে। সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা দ্বিদলীয় ধারার বাইরে নতুন রাজনৈতিক পরিসর বিকশিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। অনেকেই এ আন্দোলনকে কালিমা লেপন করতে একে মুক্তিযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বিতর্ক জুড়ে দিয়েছেন। যা মোটেও গ্রহণযোগ্য প্ল্যাটফর্ম নমস্কার নয়। এবারের গণ-অভ্যুত্থান চরিত্রগতভাবে বৈষম্যবিরোধী ও গণতান্ত্রিক চেতনার বার্তা সামনে নিয়ে এসেছে। এর সঙ্গে ৭১-এর গণচেতনার কোনো বিরোধ নেই। মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ শহীদের আত্মদানের পেছনে যে স্বপ্ন ছিল, সেটা আবার বাস্তবায়নের সুযোগ তৈরি হয়েছে।গণ-অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য কেবল হাসিনা রেজিম চেঞ্জ করা নয়, একই সঙ্গে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে সঞ্চারিত করা। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বৈষম্য বিরোধী চেতনার উন্মেষ ঘটেছে। আন্দোলনের সময় ও আন্দোলনের পর কয়েক লাখ দেয়ালচিত্র এঁকেছে শিক্ষার্থীরা। প্রতিটি দেয়ালচিত্রে ফুটে উঠেছে গণ-অভ্যুত্থানের গল্প, নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন, ধর্মীয় ও জাতিগত সহাবস্থানের আকাঙ্ক্ষা। স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে এ বিজয় সংহত করতে হবে। বিজয় অর্জন যতটা সহজ, তাকে সংহত করে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া ততটাই কঠিন। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। রাষ্ট্রের এমন কোনো বিভাগ নেই যেখানে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা নেই। সরকার পরিচালনার বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অতীতের স্বৈরাচারী সরকারের সহযোগী ও সুবিধাভোগী প্রশাসনকে নিয়েই সরকার চালানো। প্রধান উপদেষ্টা ইতিমধ্যে উদার, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছেন। সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্দেশে ১০টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। সংস্কারের জন্য দেশপ্রেমিক সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, এই সুযোগ আর আসবে না। বিগত সময়ে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় থাকার হিসাব-নিকাশ কষে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও দলকে সঙ্গে নিয়েছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার বিশেষ করে এবারের অন্তর্বর্তী সরকারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের রাজনৈতিক দলের পরামর্শ যেমন নিতে হবে, তেমনি গণ-অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্যকেও মনে রাখতে হবে। চাপ এলেই নতিস্বীকার সরকারকে টালমাটাল করে দিতে পারে। সুতরাং সংস্কারের উদ্দেশ্যে গঠিত কমিশনকে কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। এ ক্ষেত্রে কোনো দুর্বলতা বা ভুল ভবিষ্যতে ভয়াবহ বিপদের কারণ হতে পারে। সে কথাও মাথায় রাখতে হবে। বর্তমান বিপদ কেবল দেশে নয়, গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসনের পতনের ঘটনায় আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি, সে কথা প্রতিমুহূর্তে মনে রেখে গণ-অভ্যুত্থানের ধারাকে তার লক্ষ্য অভিমুখে পরিচালিত করা অপরিহার্য কর্তব্য। শহীদদের আত্মত্যাগ কোনোমতেই যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। বর্তমান সরকারকে এসব ক্ষেত্রে আন্তরিকতা ও দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে। জাতীয় স্বার্থে এবং বিশেষ করে গণতন্ত্র, সুশাসন কিংবা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এখন আমাদের আবার যুদ্ধকালের মতো একযোগে কাজ করতে হবে। না হলে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হারানোর আশঙ্কা আরো জোরদার হবে। স্বাধীনতার পর থেকে কাঠামোগত পরিবর্তনের ব্যাপারে কোনো সরকার উদ্যোগ নেয়নি। উল্টো গত ১৫ বছরে অবস্থার অবনতি হয়েছে। ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন সুবিধাভোগী শ্রেণী রাষ্ট্র ও সমাজে জায়গা করে নিয়েছে। এসব ভেঙে দিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দিতে হবে। যদি এসবের সংস্কার হয়, তবেই গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্য বাস্তবায়ন হবে, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে। এজন্য আইনের পরিবর্তন যেমন লাগবে তেমনি জনসাধারণের মানসিকতারও পরিবর্তন দরকার। রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে অন্যান্য সংগঠনের নীতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে। সর্বোপরি বিদ্যমান অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে হবে।এসব পরিবর্তন রাতারাতি আনা সম্ভব নয় বিধায় সময়ের প্রয়োজন।ছাত্রবিদ্রোহ থেকে সৃষ্ট এ গণ-অভ্যুত্থানের পূর্ণ সুফল পেতে এবং সম্ভাব্য ফ্যাসিবাদকে রুখতে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সংস্কার অতীব জরুরি। করপোরেট গ্রুপ, ধনিক শ্রেণী, বহুজাতিক গোষ্ঠী, স্বৈরাচারের দোসরদের হাত থেকে রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের হাতে আনতে হলে পুরো গণতান্ত্রিক রূপান্তর দরকার। মনে হতে পারে অনেক কাজ; কিন্তু না। রাষ্ট্রের সব উদ্যোগের কেন্দ্রে জনগণকে রাখলেই সংক্রিয়ভাবে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এতদিন কেন্দ্রে ছিল বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং সামরিক ও বেসামরিক আমলারা। এসব কারণে রাষ্ট্রে অগণতান্ত্রিক, নিপীড়নমূলক ও জবাবদিহিহীন ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। এদের দাপট কমাতে পারলে গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্ভব। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |