/ স্বাস্থ্য / ক্যান্সার হাসপাতালে রেডিও থেরাপি বন্ধ, দুর্ভোগ
ক্যান্সার হাসপাতালে রেডিও থেরাপি বন্ধ, দুর্ভোগ
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
নাসরিন আক্তার। দীর্ঘদিন ধরে জরায়ুর মুখ ক্যান্সারে ভুগছেন। গতকাল ছিল তার রেডিওথেরাপি নেয়ার দিন। তাই সকাল সকাল মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান থেকে এসেছিলেন রাজধানীর মহাখালীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ডি-ব্লকে। ১১৪ নম্বর রুমের সামনে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর যান ১৫২ নম্বর রুমে। জানতে পারেন হাসপাতালটিতে রেডিওথেরাপি দেয়ার সব কয়টি মেশিনই নষ্ট। আপাতত রেডিওথেরাপি দেয়া বন্ধ রয়েছে। কবে মেশিন ঠিক হবে বা কবে থেকে আবারো রেডিওথেরাপি দেয়া শুরু হবে তাও কেউ বলতে পারছেন না। তাই কোথায় যাবেন? কী করবেন? কোন জায়গা থেকে চিকিৎসা নেবেন এসব নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন নাসরিন ও তার স্বামী সিদ্দিক মিয়া। নাসরিন আক্তার বলেন, আমরা মুন্সীগঞ্জ থেকে এসেছি। ঢাকায় আমাদের কোনো থাকার জায়গা নেই। আমরা এখন কোথায় যাবো? তিনি বলেন, এই হাসপাতালের ঘাটে ঘাটে দালাল। যখন প্রথম এখানে ভর্তি হতে আসি তখনই দালালদের টাকা দিয়ে ভর্তি হই। এরপর রেডিওথেরাপির কার্ড করাতে এসে চার মাস পার হয়ে যায়। কোনো সিরিয়াল পাচ্ছিলাম না। পরে দালালদের ৭ হাজার টাকা দিয়ে অনেক কষ্টে সিরিয়াল পাই। এখন এসে শুনছি- মেশিন নষ্ট। রেডিওথেরাপি সেবা দেয়া বন্ধ রয়েছে। দালালরা বলছে, বেশি টাকা দিলে বাইরে থেকে রেডিওথেরাপি নেয়ার ব্যবস্থা করে দিবে। কিন্তু ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে গিয়ে আগেই অনেক ধারদেনা করে ফেলেছি। আর টাকা কোথায় পাবো। কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই ক্যান্সারের রোগী বলেন, সরকারি হাসপাতালে এসে আমাদের সাধারণ মানুষের এইসব ভোগান্তি ও দালালদের দুর্নীতি কারও কি চোখে পড়ে না! আমরা না পারি দেশের বাইরে যেতে না পারি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিতে। তাহলে কী আমরা মারা যাবো? নাসরিনের মতোই গতকাল মহাখালীর ক্যান্সার হাসপাতালে স্ত্রীর রেডিওথেরাপি দেয়াতে এসেছিলেন নরসিংদীর সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, একজন রোগীকে নিয়ে ঢাকায় আসতে কী ভোগান্তি পোহাতে হয় তা শুধু যে নিয়ে আসে সেই জানে। গতকাল সারারাত ঘুমাইনি। ফজরের সময়ে রওনা হয়েছি। সকালে এসে শুনি গত ২০দিন ধরে রেডিওথেরাপি দেয়া বন্ধ রয়েছে। কবে শুরু হবে কেউ জানে না। তিনি বলেন, আগে আসলে বলতো শুধু দুটো মেশিন চলে, আজকে সিরিয়াল পাবেন না। কিন্তু দালালকে টাকা ধরিয়ে দিলে আবার সিরিয়াল পাওয়া যেতো। কিন্তু এখন শুনছি পুরোপুরি বন্ধ, বাইরে থেকে রেডিওথেরাপি নিতে হবে। সাইফুল ইসলাম বলেন, আমি গরিব মানুষ। দিন আনি দিন খাই। তাই সরকারি হাসপাতালে স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে এসেছিলাম। কিন্তু এখান থেকে বলছে-বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে। কিন্তু এখন থেকে আমার স্ত্রীর একবার চিকিৎসা করিয়েছি। এখন অন্য কোথাও গেলে আবারো নতুন নতুন টেস্ট দিবে। নতুন করে আবার চিকিৎসা শুরু হবে। আর বেসরকারি হাসপাতালে গেলে তো সব শেষ। তাই ভাবছি স্ত্রীকে নিয়ে কি বাড়িতে ফেরত যাবো, নাকি দালালদের মাধ্যমে বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যাবো? এদিকে চিকিৎসাসেবা না পেয়ে গতকাল সকাল থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত হাসপাতালের সিঁড়ির ওপর ব্যাগপত্র নিয়ে বসে ছিলেন স্তন ক্যান্সারের রোগী সামিরা খাতুন। তার ভাই মো. মিজানুর রহমান বলেন, আমার আপা অনেক অসুস্থ। হাঁটাচলা তেমন করতে পারে না। ওকে নিয়ে আমরা এই হাসপাতালের গাইনি বিভাগে প্রায় দুই মাস চিকিৎসা করিয়েছি। হাসপতালের চিকিৎসা শেষে এখন রেডিওথেরাপি নেয়ার কথা। তিন মাস ঘুরে আজ সিরিয়াল পেয়েছিলাম। কিন্তু এসে দেখি মেশিন নষ্ট। রেডিওথেরাপি দেয়া বন্ধ। কিন্তু আমার আপাকে চিকিৎসা না দিলে ও মারা যাবে। বাড়িতে কথা বললাম, দালাল ১০ হাজার টাকা চেয়েছে বাইরে থেকে রেডিওথেরাপি দেয়ার জন্য; টাকা পাঠাতেও বললাম। কিন্তু তারা টাকা কোথা থেকে দিবে? তাই এখানে বসে আছি। তিনি বলেন, দিনের পর দিন এভাবে ক্যান্সারের মতো সেনসেটিভ রোগীদের চিকিৎসাসেবা বন্ধ থাকার পরও এই ডাক্তার, হাসপাতালের পরিচালকসহ দায়িত্ববানেরা কীভাবে রাতে ঘুমাতে পারেন। স্বাস্থ্য উপদেষ্টার দায়িত্ব কী? গতকাল দুপুরে জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতালের ডি-ব্লকের রেডিওথেরাপি চিকিৎসা ইউনিটে গিয়ে বেশির ভাগ রুমের দরজাতেই তালা ঝুলতে দেখা যায়। এমন কী রেডিওথেরাপি তথ্যের জন্য টানানো ফোন নম্বরও ছিল বন্ধ। সেখানকার দায়িত্বরত আনসার সদস্য মো. হানান্ন বলেন, সাধারণত এই ক্যান্সার হাসপাতালের ডি-ইউনিটে শুক্রবার বাদে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ক্যান্সার রোগীদের রেডিওথেরাপির সেবা দেয়া হয়। যার খরচ জনপ্রতি আনুমানিক ১৫০০-১৭০০ টাকা। কিন্তু বর্তমানে হাসপাতালের সব কয়েকটি মেশিন নষ্ট। তাই আপাতত রেডিওথেরাপি সেবা দেয়া বন্ধ রয়েছে। রেডিওথেরাপি বিভাগের বাইরে নোটিশও টানিয়ে দেয়া হয়েছে। হাসপাতালের পক্ষ থেকে আমাদের বলতে বলা হয়েছে, মেশিন চালু হলে পর্যায়ক্রমে রোগীদের ধার্যদিন হিসাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। এ বিষয়ে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. জাহাঙ্গীর কবির বলেন, আমাদের হাসপাতালের ৬টি রেডিওথেরাপি মেশিনই বর্তমানে বিকল হয়ে গেছে। তাই আপাতত রেডিওথেরাপি সেবা দেয়া বন্ধ রয়েছে। আমরা দ্রুত এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। |