/ মতামত / বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক সংকট
বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক সংকট
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
চলতি বছরে বিশ্ব অর্থনীতি ও বাণিজ্যে কী ঘটতে পারে, তা নিয়ে সবারও কৌতূহল থাকা স্বাভাবিক। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পুনর্নির্বাচিত হওয়ায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে কি না, তা নিয়ে মানুষের জল্পনা-কল্পনা আছে। কথা হচ্ছে, ট্রাম্প পূর্ণাঙ্গ শুল্কযুদ্ধ করবেন কি না। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের (এফটি) এক সংবাদে বলা হয়েছে, পূর্ণাঙ্গ শুল্কযুদ্ধের সম্ভাবনা আছে, কিন্তু বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত নয়। শুল্কযুদ্ধ বলতে এফটি বুঝিয়েছে, বছরের শেষ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি করা সব পণ্যে অন্তত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। চীন ছাড়া কানাডা ও মেক্সিকোর পণ্যে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। এই দুই দেশ থেকে মোট আমদানির ৩০ শতাংশ করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। তারাও নানাভাবে ট্রাম্পের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে। কিন্তু অতিরিক্ত শুল্ক প্রাপ্তির কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্প এই শুল্ক লড়াই চালিয়ে যাবেন বলে ধারণা করছে এফটি। ফলে বছরের শেষ নাগাদ এসব শুল্ক প্রত্যাহার করা হবে, এমনটা মনে করেন না ট্রাম্প। এরপর সবচেয়ে গুরুতর উদ্বেগের জায়গা হলো ফেডারেল রিজার্ভের নীতি সুদহার নিয়ে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের পর একাধিকবার নীতি সুদহার কমানো হয়েছে। ফলে কথা হচ্ছে, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের নীতি সুদহার কি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের নীতি সুদহারের চেয়ে কমবে। এফটি মনে করছে, সেটা হওয়ার কথা নয়। কিন্ত বাস্তবতা হলো, ট্রাম্প শুল্কবৃদ্ধি, করপোরেট করহার হ্রাসসহ যেসব নির্বাচনী অঙ্গীকার করেছেন, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে। ফেড এই বিষয়ে সতর্ক থাকবে বলে এফটির সংবাদে বলা হয়েছে, যদিও ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ইংল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার হ্রাসের ধারা অব্যাহত রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত বছরের শেষভাগে বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হলো বিটকয়েনের মূল্যবৃদ্ধি। বিশেষ করে ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর বিটকয়েনের দাম বেড়েছে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি। এই বাস্তবতায় বিটকয়েনের দাম দুই লাখ ডলারে উঠে যেতে পারে বলে ধারণা। ডলারকে দুর্বল করে অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা জোরদার করার উচ্ছৃঙ্খল প্রচেষ্টাও উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং আর্থিক বাজারকে বিপদে ফেলতে পারে। আমেরিকান ফেডারেল রিজার্ভের স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ করার যেকোনো বাস্তব বা হুমকিমূলক প্রচেষ্টাও মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে। ভূ-রাজনৈতিক কারণের প্রভাবও একই ভাবে অনিশ্চিত। ট্রাম্প অর্থনীতি ও বাজারকে প্রভাবিত করে, এমন কিছু ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে পারেন-যেমন রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত।অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্প যদি তার অশুভ পরামর্শযুক্ত অর্থনৈতিক নীতির প্রস্তাবগুলো অনুসরণ করেন, তাহলে তাকে বিপদের সম্মুখীন হতে হবে।২০২৫ সালের যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ভালো হতে পারে। সামগ্রিকভাবে ভালো ধারণাগুলো বিভিন্ন প্রভাবে খারাপ হতে পারে। পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতির ওপর কী প্রভাব ফেলবে? উত্তরটি এখনো পরিষ্কার নয়। কারণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত কিছু নীতির কারণে প্রবৃদ্ধি বাড়বে এবং মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস হবে।ইতিবাচক দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, ট্রাম্প সামগ্রিকভাবে ব্যবসাপন্থি হবেন। এ কারণেই তিনি অশুভ শক্তি থেকে মুক্ত করে অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে উদ্দীপিত করতে পারেন; যা ব্যবসায়িক বিনিয়োগ, উদ্ভাবনকে বৃদ্ধি করবে। তিনি এবং কংগ্রেসের রিপাবলিকানরা যদি ২০২৫ সালে করপোরেট এবং ব্যক্তিগত আয়কর বাড়াতে সফল হন, তাহলে প্রবৃদ্ধিও অনেক বাড়বে। যদি তার নিয়ন্ত্রণহীন এজেন্ডার বাড়াবাড়ি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন, তাহলে আমলাতান্ত্রিক যে জটিলতা, তা দূর হতে পারে। এতে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং দীর্ঘ মেয়াদে দাম হ্রাস হতে পারে। ট্রাম্প প্রতিদিন ৩ মিলিয়ন ব্যারেলের সমতুল্য আমেরিকার তেল ও গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে চান, যা দাম কমাতে সহায়তা করতে পারে। দেশীয় শক্তির খাতগুলোকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলতে পারে। কেউ কেউ মনে করেন পূর্ববর্তী প্রশাসনের বেশির ভাগ ক্ষেত্র ভর্তুকি ছাড়াই সবুজ শক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব। ইলন মাস্ক এবং বিবেক রামাস্বামীর নেতৃত্বে একটি বহিরাগত উপদেষ্টা কমিটি সরকারি দক্ষতা বিভাগ-এর প্রতিশ্রুতিতেও ফেডারেল বাজেট ২ ট্রিলিয়ন ডলার কমানোর কাছাকাছিও আসবে না। যদি সরকারি দক্ষতা বিভাগ ২০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের কাটছাঁটও শনাক্ত করতে পারে, তাহলে তা সরকারি খাতে অদক্ষতা কমাতে পারে।প্রযুক্তিবিদরা ট্রাম্পকে পরামর্শ দেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, অটোমেশন এবং বায়োমেডিকেল গবেষণা থেকে শুরু করে ভবিষ্যতের অনেক শিল্পে আমেরিকা উন্নতি করবে। নতুন প্রশাসনের এই শিল্পগুলোর পথে বসার আশঙ্কাও কম নয়। নিয়ন্ত্রক বা সুশীল সমাজের কাছ থেকে তারা যেকোনো প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে পারেন এবং তা দূর করতে বেগ পেতে হবে। একইভাবে অভিবাসনের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হতে পারে। এতে শ্রমব্যয় বৃদ্ধি এবং মূল খাতগুলোতে শ্রম ঘাটতির ঝুঁকি বাড়বে। যদি ট্যাক্স কমিয়ে দেওয়া হয় এবং অন্য আর্থিক প্রতিশ্রুতিগুলো অর্থ প্রদানের উপায় ছাড়াই কার্যকর করা হয়, তাহলে পরবর্তী দশকে পাবলিক ঋণ প্রায় ৮ ট্রিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেতে পারে। এটিও মুদ্রাস্ফীতিকে আরও বাড়িয়ে তুলবে যা দীর্ঘমেয়াদি সুদের হার বাড়িয়ে দেবে। এতে ভবিষ্যতের বিনিয়োগকে ব্যাহত করবে এবং প্রবৃদ্ধি হ্রাস করবে।ডলারকে দুর্বল করে অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা জোরদার করার উচ্ছৃঙ্খল প্রচেষ্টাও উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং আর্থিক বাজারকে বিপদে ফেলতে পারে। আমেরিকান ফেডারেল রিজার্ভের স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ করার যেকোনো বাস্তব বা হুমকিমূলক প্রচেষ্টাও মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে। ভূ-রাজনৈতিক কারণের প্রভাবও একই ভাবে অনিশ্চিত। ট্রাম্প অর্থনীতি ও বাজারকে প্রভাবিত করে, এমন কিছু ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে পারেন। ট্রাম্প প্রশাসনের মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব তার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক নীতির আপেক্ষিক ভারসাম্যের ওপর নির্ভর করবে। যদি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে ২০২৫-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়, তাহলে ট্রাম্পের অর্থনৈতিক এজেন্ডার প্রভাব প্রবৃদ্ধির জন্য খারাপ হতে পারে। যদিও ফেডারেল রিজার্ভের ২ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যে অর্থনীতির প্রত্যাবর্তনের গতি কমে যাবে। অনুকূল অবস্থায় থাকলে প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনার ঊর্ধ্বে থাকতে পারে। তবে এটি ২০২৪ সালের তুলনায় কম হবে। তবে যতক্ষণ ট্রাম্পের সবচেয়ে উগ্রবাদী নীতিগুলো থাকবে, ততক্ষণ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির উন্নয়ন হওয়াটা কঠিন। কিছু অপ্রত্যাশিত কাজ, যেমন- ভূ-রাজনৈতিক ধাক্কাগুলো থেকে বিরত থাকলে আসন্ন বছরটির মার্কিন অর্থনীতি সমৃদ্ধ হতে পারে। প্রত্যাশিত ভাবে ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড (বিওই) বৃহস্পতিবার তাদের প্রধান সুদের হার ৪.৭৫ শতাংশে অপরিবর্তিত রেখেছে এবং জানিয়েছে যে তারা ধীরে ধীরে হার কমানোর বিদ্যমান পদ্ধতিতে অবিচল থাকবে। এশিয়ায় জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (বিওজে) ট্রাম্পের নীতির হুমকির কারণে রপ্তানি-নির্ভর অর্থনীতিতে ছায়া পড়ার আশঙ্কায় অতি-নিম্ন সুদের হার অপরিবর্তিত রেখেছে। বিওজে তাদের সিদ্ধান্ত ঘোষণার বিবৃতিতে বলেছে, জাপানের অর্থনীতি ও মূল্যস্ফীতিকে ঘিরে অনিশ্চয়তা উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। রয়টার্সের এক জরিপে দেখা গেছে,জাপানি ব্যবসায়ীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশই মনে করেন যে ট্রাম্প তাদের ব্যবসার পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবেন। গত বছরের শেষ দিকে ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক (ইসিবি) এবং কানাডার ব্যাংক সুদের হার কমিয়েছে এবং উভয়েরই ধারণা ২০২৫ সালে কিছু অতিরিক্ত ছাড় দেওয়া হবে,কারণ অর্থনৈতিক আউটলুক দুর্বল হয়ে পড়ছে।প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে মার্কিন শুল্ক নিয়ে সম্ভাব্য ঝুঁকি কীভাবে মোকাবিলা করা হবে,তা নিয়ে মতবিরোধের পর পদত্যাগ করেছেন কানাডার অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড। এরপর ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দেন যে কানাডা ও মেক্সিকো যদি অভিবাসী এবং ফেন্টানিলের প্রবাহ যুক্তরাষ্ট্রে সীমিত না করে, তাহলে যদি প্রতিবেশী এই দুই দেশ থেকে আমদানি হওয়া পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন।এদিকে ক্রিপ্টো সম্পর্কিত সম্পদ গুলিতে ব্যাপক পতন ঘটেছে। এর মধ্যে বিটকয়েনের ৫ শতাংশ মূল্যহ্রাস ঘটেছে যা তিন মাসের মধ্যে সবচেয়ে বড় পতন। এসব কল্পকাহিনীর বিপরীতে, বাস্তবতা হল পুঁজিবাদের অধীনে অর্থনৈতিক সম্পর্কের কোন শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে না। চীনের ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের উত্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি পুনঃভারসাম্য তৈরি করতে যাচ্ছে না, বরং অর্থনৈতিক যুদ্ধের তীব্রতা তৈরি করবে, যা বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বজায় রাখার জন্য সরাসরি সামরিক সংঘাতের দিকে পরিচালিত করবে।বিশ্বায়িত উৎপাদনের মধ্যে বিশ্বের উৎপাদনশীল শক্তির সামঞ্জস্যপূর্ণ বিকাশ নিশ্চিত করার একমাত্র উপায় হল আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা-জাতীয় বিভাজন এবং মুনাফা ব্যবস্থার অবসান, যা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রজনন ক্ষেত্র।এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সক্রিয় রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তা আরও স্পষ্টভাবে উঠে আসবে আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর সামনে, চীনে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং সারা বিশ্ব জুড়ে আগামী দিনগুলিতে যখন বিশ্ব পুঁজিবাদের দ্বন্দ্বগুলি আরও বিস্ফোরক রূপ ধারণ করবে। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |