/ অপরাধ / লুটেছেন ব্যাংকের দুই হাজার কোটি টাকা: আনসারুলও কম যান না এস আলমের চেয়ে!
লুটেছেন ব্যাংকের দুই হাজার কোটি টাকা: আনসারুলও কম যান না এস আলমের চেয়ে!
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের ফুপাতো ভাই আনসারুল করিম চৌধুরী। সেপ্টেম্বর মাসে ইউএস-বাংলার একটি ফ্লাইটে দুবাই পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। সে সময় তাকে গ্রেপ্তার করে বিমানবন্দর অভিবাসন পুলিশ। অর্থ পাচার আইনের মামলায় তাকে পাঠানো হয় কারাগারে। প্রায় আড়াই মাস ধরে তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম কারাগারে। সে সময় সেখানে বিলাসী জীবনযাপনও করছিলেন তিনি—এমন অভিযোগ রয়েছে। জামিনের পর এখন তিনি বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। শুধু অর্থ পাচার আইনের মামলাই নয়, তার বিরুদ্ধে রয়েছে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ১ হাজার ৯৭০ কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার অভিযোগ। পাশাপাশি একইভাবে করোনাকালীন প্রণোদনা হিসেবেও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে নিয়েছেন ১৭০ কোটি টাকা। খাতুনগঞ্জে তার নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হলেও ডাটাবেজ সফটওয়্যার-‘অ্যাসাইকুডা’ যাচাই করেও আনসারুলের প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে কোনো ধরনের পণ্য আমদানির রেকর্ড খুঁজে পাননি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা। এসব অভিযোগের বিষয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন জানতে আনসারুলের ব্যবহৃত নম্বরে বহুবার কল দিয়েও সংযোগ পাওয়া যায়নি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, আনসারুল দেশের বাইরে চলে গেলে এই ঋণগুলো আর উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। আবারও সেই মন্দ ঋণের কাতারে যুক্ত হবে এই অর্থগুলো। উঁচু হবে মন্দ ঋণের পাহাড়। জমি কেনায় মধ্যস্থতাসহ বহু প্রতিভা: খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘকাল ধরে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের ব্যক্তিগত সহকারী আকিজ উদ্দিনের সঙ্গে মিলে কাজ করতেন আনসারুল করিম চৌধুরী। তার নামে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই টাকা ব্যবহার করত এস আলম গ্রুপ। বিনিময়ে কিছু ভাগ দেওয়া হতো আনসারুলকে। তবে এস আলম গ্রুপের জালে জড়ানোর আগে তিনি নিজেও ব্যবসা করতেন। পশ্চিম পটিয়ার শিকলবাহা এলাকায় এহসান স্টিলের সঙ্গে একসময় ব্যবসায়িকভাবে যুক্ত ছিলেন আনসারুল। পরে এহসান স্টিলের নামেও ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ কৌশলে বের করে নেওয়া হয়। এস আলম গ্রুপ ঋণ নেওয়ার প্রয়োজনে যাদের ব্যবহার করত, তাদের মধ্যে কারও কারও নামে জমি-বাড়িও কিনত। পরে সেইসব বাড়ি ও জমি ব্যাংকে বন্ধক রেখে বিপুল পরিমাণ ঋণের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হতো। সেই ফাঁদের অংশ হিসেবে আনসারুলের নামেও চট্টগ্রামের কালামিয়া বাজার এলাকায় একটি বড় বাড়ি কেনা হয়েছিল বলে গুঞ্জন রয়েছে। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানে ১ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা ঋণ: আনসারুলের অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানেই ১ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা আটকে আছে ইসলামী ব্যাংকের। ‘ইনহেরেন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড ইমপেক্স লিমিটেড’ নামের প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকটির চাক্তাই শাখা থেকে এই ঋণ নেন আনসারুল। ঋণ অনুমোদনের নথিতে চট্টগ্রামের আছাদগঞ্জের রামজয় মহাজন লেনে প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা উল্লেখ করা হলেও গত দুই বছরেও এই প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এমনকি ওই সড়কের ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দারাও এই প্রতিষ্ঠানের নাম শোনেননি বলে জানান। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানে ১৭০ কোটি টাকার প্রণোদনা: ঋণের তথ্যে দেখা যায়, শুধু ঋণ নয়, আনসারুলের প্রতিষ্ঠান ইনহেরেন্টকে ১৭০ কোটি টাকার করোনাকালীন প্রণোদনাও দিয়েছে শাখাটি। ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য এই প্রণোদনা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও নামসর্বস্ব এই প্রতিষ্ঠানকেই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ইসলামী ব্যাংক ছাড়াও আনসারুলের নামে ৩৪০ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে জনতা ব্যাংকে। ২০২২ সালে ব্যাংকটির আগ্রাবাদ করপোরেট শাখা থেকে এই ঋণ নেন আনসারুল। এস আলমের মালিকানাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংকের ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকার এফডিআর দেখিয়ে আনসারুল ট্রেডিংয়ের নামে এই ঋণ নেয়। ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার এফডিআর থাকা এই স্বত্বাধিকারীর অ্যাকাউন্ট ওপেনিং ফরমে মাসিক আয় উল্লেখ রয়েছে মাত্র ২ লাখ টাকা। ঋণ নিতে যে কৌশল খাটান: ব্যাংকগুলোর তথ্য বলছে, ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর ঢেউটিন আমদানিকারক পরিচয়ে আনসারুল জনতা ব্যাংকে একটি হিসাব চালু করেন। এই হিসাব চালুর তিন দিনের মধ্যেই এস আলমের মালিকানাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংকের কয়েকটি শাখায় কয়েকশ কোটি টাকার এফডিআর খোলা হয় আনসারুল আলমের প্রতিষ্ঠানের নামে। আর এফডিআর খোলার ১০ দিনের মাথায় ১৭ নভেম্বর জনতা ব্যাংক থেকে এক বছর মেয়াদি ৩৪০ কোটি টাকা ঋণ আবেদন করেন আনসারুল। এর বিপরীতে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকে খোলা এফডিআরগুলো জমা দেওয়া হয়। আবেদনের পরের সপ্তাহে ঋণ অনুমোদন পান আনসারুল। এই ঋণ অনুমোদন দেন জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সালাম আজাদ। পরে এই টাকা কৌশলে এস আলমের কাছে চলে যায় বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সময় ফরমে লেখা হয়েছিল তার মাসিক আয় ২ লাখ টাকা, আর সেই ব্যক্তিকেই ইসলামী ব্যাংক ঋণ দিয়েছিল হাজার কোটি টাকা। যেভাবে গ্রেপ্তার, এখন বিদেশে পালানোর চেষ্টায়: পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান বলেন, অর্থ পাচার আইনের মামলা রয়েছে আনসারুল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে। সিআইডি এটি তদন্ত করছে। তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে চট্টগ্রাম আদালতে পাঠানো হয়। পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেল কর্মকর্তাদের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে আনসারুল কাটান বিলাসী ও আয়েশি জীবন—এমন গুঞ্জন রয়েছে। জামিন পাওয়ার পর গত ৮ নভেম্বর আনসারুল আলম চৌধুরী চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বেরিয়ে যান। তার ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, আনসারুল এখন আত্মগোপনে আছেন। গোপনে তিনি বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা তাকে অভয় দিয়েছেন বলে জানিয়েছে ওই সূত্রটি। অন্যান্য ব্যাংক থেকেও ঋণ নিয়েছেন সাইফুল আলমের আত্মীয়রা: খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মুরাদ এন্টারপ্রাইজের মালিক মুরাদ ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ১ হাজার কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের জুবলী রোড শাখা থেকে ১২০ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ৪৫ কোটি টাকা এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক আনোয়ারা শাখা থেকে ৩৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। আদিল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আদিল এবং তার স্ত্রীর ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায় ২ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, নিজের প্রভাব খাটিয়ে আত্মীয়-স্বজনের জন্য ঋণ পাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেন এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ। |