/ সারাদেশ / টেন্ডার সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি সাতক্ষীরা স্বাস্থ্য বিভাগ
এ যেন মামা বাড়ির আবদার!
টেন্ডার সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি সাতক্ষীরা স্বাস্থ্য বিভাগ
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি:
|
এ যেন মামা বাড়ির আবদার! আদালতে মামলা দায়ের করে টেন্ডার প্রক্রিয়া আটকে দিয়ে এবং রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে সাতক্ষীরা স্বাস্থ্য বিভাগকে জিম্মি করে ফেলেছে খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও ধোলাইয়ের কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারী সিন্ডিকেট। এক টেন্ডারেই বিগত ১০ বছর ধরে খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও ধোলাইয়ের কাজ ‘জবরদখল’ করে রেখেছে জেলা জাতীয় পার্টির সহ সভাপতি ও তালা উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি নজরুল ইসলাম নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেটটি। কিন্তু যেন দেখার কেউ নেই। এতে একদিকে যেমন সরকারি হাসপাতালে সরবরাহকৃত খাদ্যের মান কমেছে, তেমনি খাদ্যের মানউন্নয়নে স্বাস্থ্য বিভাগেরও কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে না। যেভাবে আটকে দেওয়া হয় টেন্ডার প্রক্রিয়া: মামলার বিবরণে জানা যায়, মোঃ নজরুল ইসলাম ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও ধোলাইয়ের ঠিকাদারী পান। একইভাবে মেসার্স কামরুল এন্ড আকরামুল ট্রেডার্স দেবহাটা হাসপাতাল এবং মেসার্স সরদার ট্রেডার্স সিভিল সার্জন অফিস সেবা ইনস্টিটিউট, টিবি ক্লিনিক, সদর উপজেলা স্বাস্থ্য অফিসের সরবরাহকারী হিসেবে ঠিকাদারী পান। এছাড়া কলারোয়া, কালিগঞ্জ ও শ্যামনগর হাসপাতালের সরবরাহের কাজ পান মেসার্স শেখ সিরাজুল ইসলাম, মেসার্স ঘোষ ট্রেডার্স ও মেসার্স জলিল অ্যান্ড কনস্ট্রাকসন। তাদের সরবরাহের মেয়াদ শেষ হয় ২০১৪ সালের ৩০ জুন। এরই মধ্যে ২০১৪ সালের ১৫ মে এবং ২০১৪ সালের ১৯ মে ঠিকাদাররা সিন্ডিকেট করে অন্যায্যভাবে সাতক্ষীরার সিভিল সার্জনের কাছে তাদের কাজের মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন করেন। দাবিটি অন্যায্য হওয়ায় সিভিল সার্জন ২০১৪ সালের ২৭ মে মানবজমিন পত্রিকায় টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি আহবান করেন। এরপর ওই আবেদন নিষ্পত্তি না করে টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার অভিযোগে ঠিকাদাররা সিভিল সার্জন সাতক্ষীরাকে বিবাদী করে সাতক্ষীরা যুগ্ম জেলা জজ আদালতে ২২/২০১৪ নং দেওয়ানী মামলা দায়ের করেন। এই মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় বিগত ১০ বছর টেন্ডার প্রক্রিয়া আটকে রয়েছে। যার সুযোগে মামলাকারী সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে সাতক্ষীরা স্বাস্থ্য বিভাগ। হাসপাতালে নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করায় আন্দোলন সাতক্ষীরার হাসপাতালগুলোতে বিগত ১০ বছর খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি সরবরাহ এবং ধোলাইয়ের কাজের জন্য কার্যত কোনো টেন্ডার হয়নি। এই সুযোগে হাসপাতালগুলোতে নিম্নমানের খাবার সরবরাহ ও প্রয়োজন অনুপাতে খাবার সরবরাহ না করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা লুটের অভিযোগ উঠেছে। এর প্রতিবাদে দফায় দফায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে স্থানীয়রা। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। সেই ঠিকাদারী সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে আছে সাতক্ষীরা স্বাস্থ্য বিভাগ। সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের ১নং ওয়ার্ডের ১০নং বেডে চিকিৎসাধীন রাশেদুজ্জামান রুবেল বলেন, আমি চারদিন যাবত হাসপাতালে ভর্তি আছি। এখানে দুপুরে ও রাতে যে খাবার সরবরাহ করা সেটার মান খুবই নিম্ন। আসলে যে খাবার দেওয়া হচ্ছে সেটা রোগীদের জন্য উপযোগী না। আমি নিজে খেয়ে বুঝলাম। সাথে যে বেডসিট বিছানো হয়েছে, সেটা পরিষ্কার না। এছাড়া চারদিনে একটাই বেডসিট আমাকে দেওয়া হয়েছে। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা শিশু ওহিদের মা বলেন, এখান থেকে ভাত এবং তরকারি সরবরাহ করা হয় সেটা খাওয়ার মতো না। এছাড়া পরিমাণে খুবই কম দেওয়া হয়। এ বিষয়ে টিআইবির অ্যাক্টিভ সিটিজেন গ্রুপের (এসিজি) সমন্বয়ক (স্বাস্থ্য) মামুন অর রশিদ বলেন, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের খাবারের মান নিয়ে রোগীদের মধ্যে নানান প্রশ্ন আছে। আমরা সরজমিনে গিয়ে দেখেছি এবং রোগীদের সাথে কথা বলে জেনেছি খাবারের মান খুবই নাজুক। তাছাড়া যে সমস্ত কাপড় বা বেডশিট যেগুলো দেওয়া হয় সেগুলো প্রায়শই অপরিষ্কার থাকে। এইগুলাে নিয়ে রোগীদের মধ্যে সবসময় অসন্তোষ থাকে। আমরা এটা নিয়ে বিভিন্ন সময় সিভিল সার্জনের সঙ্গে সভা করেছি কিন্তু কোন ধরনের সমাধান আসেনি। এ বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক অ্যাড. আজাদ হোসেন বেলাল বলেন, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে আজকে প্রায় এগারো বছর ধরে কোনো টেন্ডার হয় না। উচ্চ মূল্যের এই কাজটা যারা নিয়েছিল তারা বিভিন্ন কলাকৌশলে এই কাজ এগারো বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন। আদালতে তারা একটা ভুয়া মামলা করে রেখেছেন যেটি আদালত খারিজ করে দিয়েছিলেন এবং পরে তারা জেলা জজ আদালতে আপিল করেছেন। শুনানি না করে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে তারিখের পর তারিখ পিছিয়ে নিচ্ছেন। সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালসহ জেলার সবকটি হাসপাতালের একই চিত্র, খাবারের মান খুব খারাপ। রোগীদের যে পরিমাণ খাবার দেওয়া দরকার, যে বাজেটের খাবার দরকার সেটাও দেয় না এবং রোগীরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই বিষয় নিয়ে নাগরিক কমিটি সবসময় সরব, কিন্তু ফলাফল পায়নি। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে স্বাস্থ্য বিভাগকে জিম্মি করে ঠিকাদারী সিন্ডিকেট: এই ঠিকাদারী সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন জেলা জাতীয় পার্টির সহসভাপতি ও তালা উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি নজরুল ইসলাম। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সঙ্গী জাতীয় পার্টির এই নেতা রাজনৈতিক প্রভাবে ধরাকে সরা জ্ঞান করে সাতক্ষীরা স্বাস্থ্য বিভাগকে জিম্মি করে রেখেছেন। মামলাবাজ হিসেবে পরিচিত নজরুল ইসলামের সাথে এই কাজে যুক্ত রয়েছে শেখ আব্দুস সাত্তার, শেখ সিরাজুল ইসলাম, স্বপন কুমার ঘোষ এবং মো. আব্দুল জলিলের মতো ঠিকাদাররা। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক, সাবেক এমপি মীর মোস্তাক আহমেদ রবিসহ সংশ্লিষ্টদের ম্যানেক করে ১০ বছর যাবত জিম্মি করে রেখেছেন সাতক্ষীরা স্বাস্থ্যবিভাগকে। মামলাটি সম্পর্কে আদালতের সর্বশেষ আদেশে যা বলা হয়েছে: টেন্ডার সিন্ডিকেটের সদস্যরা আদালতে যে ঘোষণামূলক মোকাদ্দামাটি আরজি দাখিলের মাধ্যমে দায়ের করেছেন, সেটি আদালত দেওয়ানী কার্যবিধির ৭ আদেশের ১১ বিধি অনুযায়ী খারিজ করে দেন। খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে বাদীপক্ষ জেলা জজ আদালতে আপিল করেন। পরে আপিল শুনানি না হওয়ায় তারিখের পর শুধু তারিখ পড়ছে। যা বলছে স্বাস্থ্য প্রশাসন সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. আব্দুস সালাম সম্প্রতি সাতক্ষীরায় যোগদান করেছেন উল্লেখ করে বলেন, টেন্ডার চালুর জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে মামলা লড়ছি। সর্বশেষ গত ৯ জানুয়ারি একটি ফাইল রেডি করে আদালতের জিপি বরাবর পাঠিয়েছি। আশা করছি আদালত সরকারের পক্ষে রায় দেবে এবং অতি দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হবে। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক ডা. মোঃ মনজুরুল মুরশিদ বলেন, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালসহ অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে দীর্ঘদিন টেন্ডার ছাড়া খাবার সরবরাহের ব্যাপারটা আমি জানি। একটি মামলা করে ব্যাপারটা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছি। খুব তাড়াতাড়ি এই সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছি। |