/ সারাদেশ / স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে জয়পুরহাটের আলুচাষিদের
স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে জয়পুরহাটের আলুচাষিদের
নতুন বার্তা, জয়পুরহাট:
|
হিমাগারে আলু রাখার সময় দাম ছিল ১৩ থেকে ১৬ টাকা কেজি। তবে হিমাগার থেকে বের করার সময় বীজ আলুর দাম এক লাফে বেড়ে ১০০ টাকায় পৌঁছে যায়। কৃষকরা আশ্চর্য হলেও উপায় না থাকায় বেশি দামেই বীজ আলু কিনতে হয়। আবার আলু রোপণের সময় সারেও দিতে হয়েছে চড়া মূল্য। সবকিছুতে খরচ বেশি হওয়ায় বেশি দামে আলু বিক্রি হবে এমনই আশা ছিল কৃষকদের। তবে সেই আশা হতাশায় পরিণত হয়েছে। আলু চাষে লাভ তো দূরের কথা খরচ উঠানোর চিন্তায় রয়েছেন জয়পুরহাটের চাষিরা। কারণ, এবার আগাম আলুর দাম অন্য বছরের তুলনায় কম। তাই চড়া দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। আলু রোপণ ও উত্তোলনের সময় আলু চাষির মুখে হাসি না থাকলেও কিছুটা স্বস্তি মেলাতে পারতো হিমাগারগুলো। তবে সেখানেও এবার চাষিদের কপালে ফেলবে চিন্তার ভাঁজ। কেননা হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করার সময়ও গুণতে হবে বেশি টাকা। দেশের আলু উৎপাদনের অন্যতম শীর্ষ জয়পুরহাট জেলা এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তিন হাজার ৪৭০ হেক্টর বেশি জমিতে আলুর চাষ হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এই মৌসুমে আলু চাষে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪০ হাজার হেক্টর জমি। আর আলু চাষ হয়েছে ৪৩ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে। এরমধ্যে কালাই উপজেলায় ১০ হাজার ৯০৫ হেক্টর, ক্ষেতলালে ৯ হাজার ২২০ হেক্টর, পাঁচবিবিতে ৮ হাজার ৯৪৫ হেক্টর, সদর উপজেলায় ৭ হাজার ৮০০ হেক্টর ও আক্কেলপুরে ৬ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। এবার আলুর চাষ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯ লাখ ৫৬ হাজার মেট্রিক টন। পাঁচ বছরের তুলনায় এবার আলু চাষে রেকর্ড চলতি ২০২৪-২৫ মৌসুমে আলু চাষ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গত পাঁচ বছরের তুলনায় রেকর্ড করেছে। গত ২০২০-২১ মৌসুমে এ জেলায় আলু চাষে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ওই মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৮৫ হেক্টর জমি কমে ৪০ হাজার ৩১৫ হেক্টর জমিতে আলুর চাষ হয়েছিল। আলু উৎপাদন হয়েছে ৮ লাখ ৪৫ হাজার ২৯৭ মেট্রিক টন। পরের ২০২১-২২ মৌসুমে ৪০ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও ৭০ হেক্টর কম জমিতে আলু আবাদ হয়েছিল। আর ওই মৌসুমে ফলন ভালো হওয়ায় ৯ লাখ ২৮ হাজার ১২০ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়েছে। ওই মৌসুমে আলু উৎপাদন ভালো হলেও চাষিরা ২০২২-২৩ মৌসুমে অন্যান্য ফসলের চাষ বাড়িয়ে দেন। এ কারণে ওই মৌসুমে ৩৮ হাজার ৩৬৫ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কৃষি বিভাগ। তবে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৩৮ হাজার ৮৬৫ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়েছিল। আর আলু উৎপাদন হয়েছে ৯ লাখ ২৩ হাজার ২০০ মেট্রিক টন। তবে ওই মৌসুমে চাষিরা আগাম ও ভরা মৌসুমে আলুর কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ার কারণে গত ২০২৩-২৪ মৌসুমে আলুর আবাদ সেভাবে বাড়াননি। গত মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩৮ হাজার ৮১৫ হেক্টর জমি। আর আলুর চাষ হয়েছে ৩৮ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে। ২০২২-২৩ মৌসুমের তুলনায় গত মৌসুমে আলুর আবাদ মাত্র ৮৫ হেক্টর জমিতে বাড়লেও উৎপাদন বাড়েনি। গত মৌসুমে আগের বছরের তুলনায় ৮০ হাজার ১২৭ মেট্রিক টন আলুর উৎপাদন কমে ৮ লাখ ৪৩ হাজার ৭৩ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়েছে। ২০২৩-২৪ মৌসুমে আলুর উৎপাদন কম হওয়ায় ভরা মৌসুমের তুলনায় আগাম আলুর দাম চড়া হয়। এই আলু হিমাগারে সংরক্ষণের পর থেকে দিন দিন আলুর দাম চড়া হতেই থাকে। এ কারণে গত পাঁচ বছরের তুলনায় এবার রেকর্ড পরিমাণ জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। জেলায় ২৭ জাতের আলু চাষ সাধারণত বাজারে পাকড়ী, কার্ডিনাল, গ্র্যানুলা, এস্টেরিক্স, ডায়মন্ড, ক্যারেজ জাতের আলু বেশি পাওয়া গেলেও উফশী ও স্থানীয় মিলে ২০২৪-২৫ মৌসুমে ২৭ জাতের আলু চাষ হয়েছে। এবার জেলায় আলুর উফশী ফসলের মধ্যে এক হাজার ১৮৩ হেক্টর জমিতে কার্ডিনাল জাতের আলুর চাষ হয়েছে। একইসঙ্গে গ্র্যানুলা ২ হাজার ২৯৯ হেক্টর, এস্টেরিক্স ১৭ হাজার ৯৬৮ হেক্টর, কারেজ ৩ হাজার ৭৮০ হেক্টর, ডায়মন্ড ৫ হাজার ৭৭৩ হেক্টর, লেডিরোসাটা ৩৭৫ হেক্টর, মিউজিকা এক হাজার ৯৮১ হেক্টর, রোমানা এক হাজার ৫৪১ হেক্টর, সানসাইন এক হাজার ৪০৩ হেক্টর, বারি আলু ৮৫ (সেভেন) ৭৫ হেক্টর, বারি আলু ৮৬ (১২১৩) ২ হাজার ৪২৬ হেক্টর, বারি আলু ৯০ (এলুয়েট) ৪১৩ হেক্টর, ভেলেনসিয়া ১১৪ হেক্টর, ফ্রেস ৩২৫ হেক্টর, এলগার ৯৮ হেক্টর, লেভাস্তে ১০ হেক্টর, সাদিকা ১৯৮ হেক্টর, কুইন এ্যানি ২০ হেক্টর, আটলান্টিক ৬ হেক্টর ও সূর্যমুখী ১৩৭ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। আলুর উফশী ফসলের পাশাপাশি স্থানীয় সাত জাতের আলু করেছেন চাষিরা। এরমধ্যে লাল পাকড়ী ২ হাজার ১৪২ হেক্টর, সাদা পাকড়ী ৬৬০ হেক্টর, পাটনাই ২৫ হেক্টর, হাগরাই ২৫ হেক্টর, তেল পাকড়ী ২০৫ হেক্টর, ফাটা পাকড়ী ২৬০ হেক্টর ও শীল বিলাতি ২৮ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। বীজ-সারে চড়া মূল্য, উৎপাদিত আলুর দাম কম, যা বলছেন চাষিরা গত ২০২৩-২৪ মৌসুমে ৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আগাম জাতের আলু চাষ হয়েছিল। ওই মৌসুমে আগাম জাতের আলুর দাম ছিল প্রতিমণে এক হাজার ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা। এ ছাড়া ভরা মৌসুম ও আলু হিমাগারে সংরক্ষণের সময় এই দাম প্রতিমণে ৫২০ টাকা থেকে ৬৪০ টাকা ছিল। তবে দিনদিন আলুর দাম বেড়ে যায়। এতে খাবার আলু ৮০ টাকা কেজি পর্যন্ত হয়েছে বলে জেলা কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে। এরপরই আলু রোপণের সময় আসে। আর এসময় বিভিন্ন কোম্পানি বীজ আলুর দাম ৭৮ টাকা থেকে ৮০ টাকা কেজি নির্ধারণ করে। তবে কিছু সংখ্যক চাষি এই দামে আলু পেলেও পরবর্তীতে তা আর মেলেনি। সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে বীজ আলুর কেজি ১০০ টাকা থেকে ১০৫ টাকা পর্যন্ত হয়েছে। উপায় না থাকায় বেশি দামেই বীজ আলু কিনতে হয়েছে চাষিদের। আবার আলু রোপণের সময় সার কিনতে গিয়েও গুণতে হয়েছে বেশি টাকা। কৃষিবিদরা বলছেন, প্রতিবিঘায় ৪ বস্তা (১৬০ কেজি) আলু নির্ধারিত দাম অনুযায়ী ৮০ টাকা প্রতি কেজি দরে ১২ হাজার ৮০০ টাকা পড়েছে। তবে এই দামে বীজ খুব কম সংখ্যক কৃষকরাই পেয়েছেন। কৃষকদের ১০০-১০৫ টাকা দরে প্রতি কেজি আলু কিনতে হয়েছে। সেই হিসাবে খরচ হয়েছে ১৬ হাজার থেকে ১৬ হাজার ৮০০ টাকা। আলুর জমি চাষে গুণতে হয়েছে প্রায় ১২০০ টাকা। সার কিনতে গিয়েও গুণতে হয়েছে অতিরিক্ত টাকা। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, প্রতি বিঘায় ইউরিয়া সার ৪০ কেজি ১০৮০ টাকা, ডিএপি ৩০ কেজি ৬৩০ টাকা, এমওপি ৪০ কেজি ৮০০ টাকা, দস্তা ১ কেজি ১৫০ টাকা, বোরন ২ কেজি ৩০০ টাকা, জীপসাম ১০ কেজি ১০০ টাকা, ম্যাগনেসিয়াম ২ কেজি ১০০ টাকা, জৈব (গোবর) সার ২ হাজার টাকা হিসাবে মোট ৫ হাজার ১৬০ টাকা খরচ করলেই হয়। তবে চাষিরা এই হিসাবের বাইরে গিয়ে জমিতে অতিরিক্ত সার ব্যবহার করেন। কৃষকদের হিসাবে এবার প্রতি বস্তার সারে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি দিতে হয়েছে। কোনো কোনো কৃষক ৫০০ টাকা বেশি দিয়েও সার কিনেছেন। আলু রোপণের পর কীটনাশক দিতে খরচ প্রায় ২ হাজার টাকা। শ্রমিক মজুরি ৭ হাজার টাকা। অনেক চাষিরা জমি লিজ বা ভাড়া নিয়েছেন। সেক্ষেত্রে এলাকা হিসেবে তাদের ৭ হাজার থেকে ১৩ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়েছে। আবার আলুতে সেচ খরচ রয়েছে। সবমিলিয়ে বিঘায় কৃষকদের ৪০ হাজার থেকে ৫৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ গুনতে হচ্ছে। আর আগাম আলুর ফলন হয়েছে বিঘায় ৫০ থেকে ৬০ মণ। বর্তমান বাজারে প্রতিমণ আলু ৭২০ টাকা থেকে ৮৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সেই হিসাবে বিঘায় ৩৬ হাজার টাকা থেকে ৫২ হাজার ৮০০ টাকা দরে প্রতিমণ আলু বিক্রি হচ্ছে। এতে কোনো চাষি লোকসান গুনছেন, আবার কোনো চাষি অল্প কিছু টাকা লাভ এবং খরচ উঠানোর চিন্তায় রয়েছেন। তবে ভরা মৌসুমে আলুর এরকম দাম থাকলে আর ফলন ভালো হলে লাভের মুখ দেখবেন চাষিরা। স্নাতকোত্তর শেষ করে নিজ জমি চাষাবাদ করছেন কালাইয়ের হারুঞ্জ এলাকার বাসিন্দা শামীম আহম্মেদ। তিনি এবার ৭ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছেন। মিউজিকা, ১২১৩ ও এস্টেরিক্স জাতের আলু চাষ করা শামীম আহম্মেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, জমি চাষাবাদ থেকে শুরু করে বীজ, আবার সার মিলে আলুতে খরচ আসতেছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা, আবার জমি লিজ নেওয়া থাকলে আরও ১০ হাজার টাকা বেশি। তবে বর্তমানে আলুর যে বাজার সেই হিসাবে ৮০০ টাকা মণ ও ফলন ৫০ মণ ধরে ৪০ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে। এতে আমাদের খরচ উঠানোর চেয়ে লোকসান গুনতে হচ্ছে। কেননা আমরা বীজ ৪ হাজার টাকা বস্তাতে কিনতে হয়েছে। আবার সার কিনতে গিয়ে রশিদে লিখে দিচ্ছে এক, আর দাম নেওয়া হয়েছে আরেকভাবে। শামীম আহম্মেদ আরও বলেন, প্রতি বস্তায় ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে লিজ নেওয়া চাষিদের এই আগাম আলুতেই ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা এবং কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। ভরা মৌসুমে আলুর বাজার আরও কমে গেলে কৃষকের আরও বেশি অঙ্কের টাকা লোকসান গুনতে হবে। তাহলে কৃষকের থাকবে কি আর এই দুরবস্থা দেখবে কে? যেসব বীজ ও সারের যে সিন্ডিকেট ছিল সেসময় প্রশাসনের সেভাবে নজরদারি ছিল না। বর্তমান সময়ে আলুর আমদানি বন্ধ করে কৃষকের দিকে নজর না দিলে বাঁচার কোনো সুযোগ নেই। সুমন মণ্ডল নামে এক আলু চাষি বলেন, এবার ব্যালকাপাতার মাঠে সাড়ে ৯ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছি। সব ১২১৩ জাতের আলু। বিঘায় ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আবার আমি আলু বিক্রি করতে গিয়ে ৭২০ টাকা দরে প্রতিমণ দাম পাচ্ছি। এতে তো আমাদের পত্তা (লাভ) হচ্ছে না। যদি এক হাজার টাকা মণ থাকতো, তাহলে পত্তা হতো। বিগত বছরের তুলনায় এ বছর আলুর দাম অনেক কম। আরেক কৃষক আব্দুস সামাদ বলেন, তিন বিঘা জমিতে মিউজিকা আলু লাগিয়েছি। আলুর সার-বীজ সবমিলিয়ে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়ে যাবে। তবে লাভ হবে না। কারণ, ৫০ হাজার টাকা খরচ করে আলু যদি ৬০ মণ ফলনও হয়, তাহলে ৮৩০-৮৩০ টাকা প্রতিমণ দাম ধরে প্রায় ৫০ হাজার টাকা বিক্রি। তাহলে লাভ হলো? নয়াপুকুর মাঠে ৬ বিঘা আলু চাষ করেছেন কৃষক আনিছুর রহমান। তিনি বলেন, এই জমিতে এস্টেরিক্স জাতের আলু রোপণ করেছি। ৯০ দিন থেকে ১০০ দিন বয়স হলে আলু উত্তোলন করা হবে। আর কয়েকদিন ধরে আবহাওয়া আপ-ডাউন করছে। এজন্য জমিতে কিছু বেরাম (রোগ) এসে ঢুকেছে। ঘনঘন ওষুধ দিতে হচ্ছে। আর এবার বীজের তো অনেক দাম। সিরিয়াল দিয়েও বীজ পাওয়া যাচ্ছিল না। অগ্রিম টাকা দিয়েও ডিলাররা দিতে পারছিলেন না। আগে যারা বুকিং দিয়েছিল তারাও নিতে পারছিল না। এবার বীজে তো খুব সিন্ডিকেট ব্যবসা হয়েছে। তবে এবার এখন আলুর যে দাম, কমতেছে আর কমতেছে। দাম তো ঊর্ধ্বগতি নয়। এখন ভরা মৌসুমে কি হবে তা বলা মুশকিল। আবাদ-আমদানি দুটোই বেশি, তাই চাষি পর্যায়ে কমেছে দাম, বলছেন ব্যবসায়ীরা জেলায় এবার আলু চাষ বেশি হয়েছে। আবার আগাম আলু উত্তোলন অনেক জেলায় বেশি করে শুরু হয়েছে। এতে আমদানি বেড়েছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, কৃষকরা সরিষা চাষ কমে দিয়ে আলু চাষ বেশি করেছেন। আবার চাহিদার তুলনায় আমদানি বেড়েছে। এজন্য চাষি পর্যায়ে আলুর দাম কম রয়েছে। কালাইয়ের মোলামগাড়িহাটের আলু ব্যবসায়ী আজাহার আলী আকন্দ বলেন, কিছুদিন আগে তিন জাহাজ আলু আমদানি করা হয়েছে। তাছাড়া এবার আলুর উৎপাদন বেশি হয়েছে। ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুরে আলু উত্তোলন বেড়েছে। এ কারণে অন্য বছরের তুলনায় দাম কম। আমার আলুগুলো মাগুরা, ফরিদপুর, বোয়ালমারী, কানাইপুর অর্থাৎ দক্ষিণবঙ্গে যায়। প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ ট্রাক আলু কেনাবেচা করি। অর্থাৎ প্রতিদিন ১২০০ থেকে ১৫০০ বস্তা আলু যায়। পরবর্তীতে আরও বেশি আলু যাবে। আমি কমিশনে এই ব্যবসা করি। একটি বস্তায় ২০ টাকা কমিশন পাই। এখানে বস্তা বস্তা খাজনা, শ্রমিক, গাড়ি সব খরচ পার্টি দেয়। ব্যবসায়ী সুলতান আহম্মেদ গত ১৫ জানুয়ারি জয়পুরহাট জেলা শহরের নতুনহাটে প্রায় ৪ হাজার কেজি আলু কিনেছেন। সেসময় প্রতিমণ আলুতে তার দাম পড়েছিল ৮০০ টাকা থেকে ৮২০ টাকা। এই ব্যবসায়ী ১৮ জানুয়ারি একই হাটে প্রায় ৬ হাজার কেজি আলু কিনেছেন। তিনি বলেন, গত হাটের চেয়ে আলুর দাম আরও অনেক কমে গেছে। ৬৪০ টাকা থেকে ৬৮০ টাকা মণে আলু কেনা হয়েছে। এরপর হাটের খাজনা-শ্রমিক মিলে আরও ৫ টাকার মতো খরচ হয়। আমার সব আলু ঢাকায় যায়। সেখানে দুই-এক টাকা লাভে আলু পাইকারিতে বিক্রি করে দেওয়া হয়। কিন্তু হাটে আলুর আমদানি বেড়েছে। মোকামগুলো আলু সেভাবে নিচ্ছে না। একই হাটে আলু কিনেছেন ক্ষেতলালের মহব্বতপুর এলাকার ব্যবসায়ী জুয়েল রানা। তিনি বলেন, গত ১৫ জানুয়ারি প্রায় ২০ টনের মতো আলু কেনা হয়েছে। সব আলু পাকরি ও ছোট সাইজের। গড়ে দাম পড়েছে প্রায় ৮৫০ টাকা। ১৮ জানুয়ারি এই হাটে প্রায় ১৬ টনের মতো আলু কেনা হয়েছে। এবার দাম আরও কম। প্রতিমণ আলুর দাম পড়েছে ৭৫০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা। তিনি আরও বলেন, আলু কেনার পর শ্রমিকদের দিতে হয় প্রতি বস্তায় ৪০ টাকা, খাজনা ১০ টাকা, আবার ট্রাক সমিতিতে ২০০ টাকা, ট্রাক ভাড়া ২০ হাজার থেকে ২২ হাজার টাকা। ঢাকা ও গাজীপুর গিয়ে সেখানে আবার আনলোড করতে শ্রমিকদের মজুরি দিতে হয়। সবমিলিয়ে কেজিপ্রতি সাড়ে ৪ টাকা থেকে ৫ টাকা খরচ হয়। এরপর আমরা অল্প কয়েক টাকা লাভে আলু বিক্রি করে দিই। এসব আলু আবার সেখানকার ব্যবসায়ীরা কিনে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেয়। হিমাগারে আলু সংরক্ষণেও স্বস্তি নেই, বাড়ল ভাড়া এ জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে ১৯টি হিমাগার রয়েছে। এর সবগুলোতেই আলু সংরক্ষণ করা হয়। তবে জেলায় যেখানে আলুর উৎপাদন ৯ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়েছে সেখানে এসব হিমাগারে সব মিলিয়ে মাত্র এক লাখ ৯২ হাজার মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করতে পারে। এরমধ্যে খাবার আলু এক লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন ও বীজ আলু ৬২ হাজার মেট্রিক টন। তবে জেলায় প্রায় ৬০ হাজার মেট্রিক টন বীজ আলুর প্রয়োজন হয়। আর জেলায় খাবার আলুর প্রয়োজন হয় প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন। এসব হিমাগারে আগে ৩২০ টাকায় ৮০ কেজি আলুর বস্তা সংরক্ষণ করা যেত। তবে গত বছর সংরক্ষণ ভাড়া বাড়ানোর পর এ বছরও ভাড়া বাড়িয়েছে হিমাগার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএসএ)। ইতোমধ্যে আলু সংরক্ষণ ভাড়া প্রতি কেজি ৮ টাকা ধার্য করে হিমাগারগুলোতে ব্যানার লাগিয়ে দিয়েছে বিসিএসএ নামের ওই সংগঠনটি। জয়পুরহাট জেলা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বাজার অনুসন্ধানকারী রতন কুমার রায় বলেন, হিমাগারে আলু সংরক্ষণের পর উৎপাদিত আলু অনেকেই বাসা-বাড়িতে রাখেন। আবার অন্য জেলায় এবং দেশের বাইরেও কিছু আলু রপ্তানি করা হয়। তবে গত বছরের তুলনায় এবার আলুর দাম কম। গত বছর এ সময় ৪৮ টাকা থেকে ৫২ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হয়েছে। আর এবার ১৮ টাকা থেকে ২৪ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সেই হিসাবে আলুর মূল্য হ্রাস পেয়েছে। ভাড়া বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আলু সংরক্ষণের হিমাগার হিমাদ্রি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, গত বছর ৭ টাকা কেজি দরে আলুর ভাড়া ছিল। এবার কেজিতে এক টাকা বাড়িয়ে ৮ টাকা করা হয়েছে। এই দাম বাড়ানোর বিষয়ে হিমাগার মালিকদের সংগঠন বলতে পারবে। জানতে চাইলে এ বিষয়ে বৃহত্তর বগুড়া জেলা (বগুড়া-জয়পুরহাট) কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ ও জয়পুরহাটের কালাইয়ের আর বি স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজের মালিক প্রদীপ কুমার প্রসাদ বলেন, সবকিছু বিবেচনা করে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন কেজিতে আলুর ভাড়া এক টাকা বাড়িয়েছে। আলু সংরক্ষণে দাম বাড়ানোর কারণ জানতে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব সুশান্ত কুমার প্রামাণিকের মোবাইলে বৃহস্পতিবার দুপুরে কল করলে তিনি সচিবালয়ে আছেন, পরে কথা বলবেন বলে কল কেটে দেন। পরবর্তীতে তাকে আবারও কল করা হলে তিনি আর রিসিভ করেননি। এমনকি খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। আগামীতে যে প্রভাব পড়তে পারে জয়পুরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোছা. রাহেলা পারভীন বলেন, এ জেলায় ৪৩ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে, আর আগাম আলুর চাষ হয়েছে ৪ হাজার ৬৩০ হেক্টর। আবহাওয়া মোটামুটি ভালো যাচ্ছে। আলুতে এবার তেমন রোগ নেই। তারপরও আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। উৎপাদিত আলু হিমাগারে রাখার পর যেটি থাকে এগুলোর মধ্যে কিছু আলু প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষণ করা যায়। কৃষি বিপণন এর উদ্যোগ নিয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে আলু সংরক্ষণ করলে ছয় মাস সংরক্ষণ করে রাখতে পারবে। বীজ আলুর দাম স্বাভাবিকভাবে বেশি হয়। কেননা বীজ আলুতে নিয়ম মেনে বিশেষ পরিচর্যা করতে হয়। এজন্য বীজ আলুর দাম বেশি থাকে জানিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ শিক্ষা বিভাগের প্রফেসর ড. এম আসাদুজ্জামান সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর কৃষকদের আলু চাষে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আবার বিভিন্ন বিষয় ভেবে হিমাগারে ভাড়া হয়তো বাড়ানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে আলু চাষে অবশ্যই প্রভাব পড়বে। এখানে আলু বীজের দামই হোক বা হিমাগারে রাখার খরচ যখন বেড়ে যাবে তখন নিঃসন্দেহে আলুর উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। আলুর যে বাজার পাওয়ার কথা সেটি তো সরকার করতে পারছে না। সেক্ষেত্রে এখানে পলিসি থাকা দরকার জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এই পলিসি জনগণ ও সরকারের বোঝা দরকার। এ বছর আলুর দাম কৃষকেরা পায়নি। তখন আগামী বছর কম সংখ্যক চাষি আলু চাষ করবেন। অনেক চাষি ছিটকে যাবে। তারা আর আলু চাষ করবে না। তাই ভেবে নিবেন এটি অলাভজনক ফসল। যখন আলু চাষ কম হবে, তখন তুলনামূলকভাবে আলুর দাম আবার বেড়ে যাবে। কারণ, সাপ্লাই কম হলে ডিমান্ড বেড়ে যাবে। তখন তার পরের বছর গিয়ে আবার সব চাষি আলু চাষ বাড়িয়ে দিবে। তখন সাপ্লাই বেড়ে গেলে আবার ডিমান্ড কমে যাবে। এই সাইকেলে সরকারের একটি পলিসি থাকা দরকার। প্রফেসর ড. এম আসাদুজ্জামান সরকার বলেন, যে এলাকাগুলোতে আলু হয়, সেই এলাকাতে আলু কত হেক্টর জমিতে হবে, সেটি হওয়ার পর আবার চাহিদা কতটুকু, সেটি করার পর আলু চাষ করতে পারবে না বলে জানিয়ে দিতে হবে। যদি এটি না হয় তাহলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখানে একটি কন্ট্রোল থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে এটি নেই। একজন চাষি চাইলেই যা মনের ইচ্ছে তা চাষ করতে পারছে। কৃষি যেহেতু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ তাই কতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু চাষ করা দরকার। এখানে কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তর বা অন্য যেসব দপ্তর রয়েছে, তাদের কন্ট্রোল থাকা দরকার। এটি হলে এক বছর পরপর কৃষকদের যে ক্ষতি, তা আর হবে না। এক্ষেত্রে এই ছোট দেশে সরকারের পাশাপাশি চাষিদেরও বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে। |