/ অপরাধ / সিন্ডিকেটে জিম্মি যাত্রীরা, লাগামহীন বিমান ভাড়া
সিন্ডিকেটে জিম্মি যাত্রীরা, লাগামহীন বিমান ভাড়া
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
নানা উদ্যোগ নিয়েও সিন্ডিকেটমুক্ত করা যাচ্ছে না আকাশ পথ। কিছু চক্র সিন্ডিকেট গড়ে তুলে জিম্মি করে যাত্রীদের পকেট কাটছে। তারা অনলাইনে টিকিট শূন্যতা দেখিয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে যাত্রীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। টিকিট সিন্ডিকেটের ফাঁদে পড়ে রীতিমতো অসহায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী শ্রমিক ও অন্যান্য যাত্রীরা। কারণ নির্ধারিত তারিখের মধ্যে যাওয়া-আসার বাধ্যবাধকতা থাকায় তারা বেশি দামে টিকিট কিনে যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের উদ্দেশ্যেও যারা যাতায়াত করছেন তাদেরও একইভাবে বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যের দেশে নয় ইউরোপ আমেরিকার রুটেও সিন্ডিকেট করে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চক্রগুলো এমনটি করলেও কোনোভাবে সেটি বন্ধ করা যাচ্ছে না। এভিয়েশন খাতের সূত্রগুলো বলছে, দীর্ঘদিন ধরে উড়োজাহাজের টিকিটের মূল্য কৃত্রিমভাবে বৃদ্ধি করছে সিন্ডিকেট। চক্রটি সংশ্লিষ্ট উড়োজাহাজ প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশ করে বাল্ক টিকিট বিক্রি করছে। এ ছাড়া যাত্রীর নাম ছাড়া ভুয়া গ্রুপ টিকিট বুকিং দিয়ে কৃত্রিম সংকট দেখাচ্ছে। পরে তারা চাহিদার প্রেক্ষিতে উচ্চ দামে এসব টিকিট বিক্রি করছে। যাত্রীরা যখন টিকিট বুক করতে চান তখন অনলাইনে সিট ফাঁকা নাই দেখায়। কিন্তু যাত্রীরা তাদের প্রয়োজনের তাগিদেই ওইসব তারিখের টিকিট পেতে তোড়জোড় শুরু করেন। এক ট্রাভেল এজেন্সি থেকে আরেক এজেন্সিতে যান। পরে উপায়ান্তর না পেয়ে চক্রের হাঁকানো দামেই টিকিট কিনেন। সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীরা। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের যাত্রীদের ঘিরে টিকিটের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যর প্রায় প্রতিটি রুটেই স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। যেসব রুটে টিকিটের দাম ৪০ হাজার টাকা সেই টিকিট এখন কিনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায়। এর বাইরে ওমরা ও সামনের পবিত্র হজকে ঘিরেও অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়ানো হচ্ছে। যদিও টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির পেছনে অসাধু ট্রাভেল এজেন্টদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। যাদের মধ্যে অনেকেই আটাবের সদস্য। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার পতন ও নতুন সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর বিদেশযাত্রা কিছুটা কমলেও এখন পর্যায়ক্রমে বেড়েছে। পর্যটন মৌসুমেও বেড়ে যায় টিকিটের চাহিদা। এই সুযোগে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে উড়োজাহাজের টিকিটের দাম। এ ছাড়া ওমরা ও হজকে ঘিরেও চক্রগুলো টিকিটের দাম বাড়িয়ে দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে টিকিটের দাম লাগামহীন হওয়াতে যাত্রী ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি অভিযোগ দিয়ে আসছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে টিকিটের দাম সহনীয় রাখতে মন্ত্রণালয় থেকে ভাড়া সহনীয় রাখতে এয়ারলাইনসগুলোকে নির্দেশনা দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে বেবিচককে চিঠি দেয়া হয়। পরে ভাড়া সহনীয় রাখতে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোকে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এর আগে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর সংগঠন এসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশও (আটাব) উড়োজাহাজ ভাড়া সহনীয় রাখার অনুরোধ জানিয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। আটাব জানিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের গন্তব্যগুলোতে ভাড়া বেশি বেড়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ভাড়া বেড়েছে জেদ্দা, মদিনা, রিয়াদ ও দাম্মাম রুটে। এসব গন্তব্যে ভাড়া বাড়লে সংশ্লিষ্ট অন্য গন্তব্যগুলোতেও এয়ারলাইন্সগুলো ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। সামগ্রিকভাবে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ এবং কিছু ক্ষেত্রে আরও বেশি বেড়েছে। কিছুদিন আগেও যে টিকিটের দাম ৪০ হাজার ছিল এখন সেটি ৮০ হাজারের বেশি। ট্রাভেল এজেন্টরা বলছেন, ৫ থেকে ৭ শতাংশ দাম বাড়লে সেটি স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। কিন্তু ৪০-৫০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি বাড়লে অস্বাভাবিক হয়ে যায়। বেশি দাম দিয়েও অনেকে টিকিট পাচ্ছে না। তাই সমাধানের জন্য যারা টিকিট নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তুলে কৃত্রিম সংকট দেখাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি ফ্লাইট ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে। ক্যাপাসিটি বাড়লে টিকিটও সহজলভ্য হবে, দামও কমবে। বেবিচকের পরিচালক (ফ্লাইট সেফটি রেগুলেশনস ও ইন্সপেকশন অথরাইজেশন) গ্রুপ ক্যাপ্টেন আহসান হাবীব বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করা বিদেশি ২৪টি এয়ারলাইন্সকে ভাড়া সহনীয় রাখার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে বলেছেন, বাংলাদেশে উড়োজাহাজের ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে প্রায়ই জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। বিশেষ করে বছরের যে সময়ে যাত্রীদের যাতায়াত বৃদ্ধি পায়, সে সময়ে বিমান ভাড়া বাড়ানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আমরা এয়ারলাইন্সগুলোর পরিচালন ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। চিঠিতে বলা হয়, উড়োজাহাজের ভাড়া ভ্রমণকারীদের সাধ্যের মধ্যে রাখাটা তাদের যেমন স্বস্তি ও আস্থা দেবে, সেই সঙ্গে টেকসই এভিয়েশন খাত গড়ে উঠতে সাহায্য করবে এবং এতে আকাশপথে ভ্রমণ আরও বাড়বে। এজন্য এয়ারলাইন্সগুলোকে তাদের ভাড়ার তালিকা পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ জানানো হয়েছে চিঠিতে। গত মাসের ১২ই ডিসেম্বর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব রোকসিন্দা ফারহানা স্বাক্ষরিত বেবিচক চেয়ারম্যানের কাছে দেয়া এক চিঠিতে বলা হয়, বছরে যে সময়ে যাত্রীদের গমনাগমন বৃদ্ধি পায়, সে সময়ে বিমান ভাড়া বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বছরের বিশেষ সময়ে যাত্রীদের গমনাগমন বৃদ্ধির সময়ে যাতে বিমান সংস্থাসমূহ অকারণে ভাড়া বৃদ্ধি না করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। আটাব তার সদস্যকে দেয়া চিঠিতে জানিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এয়ার টিকিটের সাশ্রয়ী মূল্য বজায় রাখার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকল এয়ারলাইন্সকে নির্দেশনা প্রদান করেছে। সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সৌদি আরবে বিগত সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ হারে বিএমইটি ছাড়পত্র প্রদান করছে ও শ্রমিক যাত্রী প্রেরণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়াও ওমরাহ যাত্রীদের সংখ্যা রমজান মাস পর্যন্ত বেশি থাকে। এই কারণেও ফ্লাইটের চাহিদা অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরদিকে বিগত বছরের তুলনায় এ বছর কয়েকটি এয়ারলাইন্স ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট থেকে তাদের প্রায় ৫২টি ফ্লাইট পরিচালনা কমিয়ে দিয়েছে যার ফলে প্রতিদিন প্রায় ১৫০০ আসন কমে গিয়েছে। এয়ারলাইন্সগুলো ডলার সংকটের জন্য যথাসময়ে তাদের নিজ নিজ দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে না পারায় ডলারের রেট বৃদ্ধিসহ এয়ারলাইন্সের কস্ট অব ফান্ড বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এবং যাত্রীদের টিকিটের চাহিদা বেশি হওয়ায় এয়ার টিকিটের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে এয়ারলাইন্স জানিয়েছে। এয়ার টিকিটের মূল্য সহনীয় পর্যায় রাখার লক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্যগামী সকল এয়ারলাইন্সদের অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনার জন্য আটাব অনুরোধ জানিয়েছে এবং আটাবের অনুরোধ ও পরিস্থিতি বিবেচনায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স মদীনায় সপ্তাহে অতিরিক্ত ১টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এয়ার টিকিটের মূল্যবৃদ্ধির জন্য এয়ারলাইন্সের পাশাপাশি ট্রাভেল এজেন্সিদেরও দায়ী করা হচ্ছে। ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন কিছুদিন আগে আরও ২৭ হাজার ৮২০ টাকা কমিয়ে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা বিমান ভাড়া নির্ধারণ করতে আধাসরকারি পত্র (ডিও) দিয়েছিলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন উপদেষ্টা প্রয়াত এ এফ হাসান আরিফকে। পত্রে খালিদ হোসেন বলেন, বিমান ভাড়া কমানো হলে বাংলাদেশের হজ কোটা পূরণ সহজ হবে। সৌদি সরকারের কাছে দেশের সম্মান বৃদ্ধি পাবে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সও বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হবে। এর আগে আটাব নেতৃবৃন্দ ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসায় শৃঙ্খলা ফেরাতে ৯ দাবি জানিয়েছিলেন। এরমধ্যেও বিমান টিকিটের মূল্যবৃদ্ধি ও মজুতদারী বিষয়টি উঠে আসে। তাদের দাবির মধ্য ছিল এয়ার টিকিটের মজুতদারী ও সিন্ডিকেট বন্ধ করে গ্রুপ টিকেটিং এর নীতিমালা-নির্দেশ প্রদান করা। তৃতীয় দেশ (যাত্রা ও গন্তব্যের দেশ ব্যতীত অন্য কোনো দেশ। যেমন:- ভারত, দুবাই, সিঙ্গাপুর থেকে বিক্রয়কৃত টিকিটের যাত্রী বাংলাদেশ বিমানবন্দরে অনবোর্ড বন্ধ করলে তৃতীয় দেশ থেকে টিকিট বিক্রয় ও অর্থ পাচার বন্ধ হবে। আটাবের সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ বলেছিলেন, আমাদের দেশে এয়ার টিকিটের মূল্য কেন বেশি এটি আমরা বার বার বলেছি। গ্রুপের নামে টিকিট ব্লক করে দেয়া হচ্ছে। অথচ এটি কোনো গ্রুপ না। মূলত টিকিটের দাম বাড়াতেই কৌশলে এগুলো করা হচ্ছে। আমাদের কাজ হলো সরকারকে অনিয়ম অন্যায় দেখিয়ে দেয়া। কাজ করবেন তারা। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ উইং কমান্ডার (অব.) এটিএম নজরুল ইসলাম বলেন, চাহিদা বেশি থাকলে তারা সুযোগ বেশি নেয়। যারা সিন্ডিকেট করে তারা এককভাবে করে না। এয়ারলাইন্সের সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকলে সিন্ডিকেট করা সম্ভব না। গ্রুপ টিকিটের নামে তারা টিকিট নিয়ে যেভাবে ধরে রাখে সেটা মনিটরিং হচ্ছে না। তারা কীভাবে এয়ারলাইন্সের কাছ থেকে টিকিট নিচ্ছে, সেটি কি দামে বিক্রি করবে এই শর্তগুলো কীভাবে দেয়া হচ্ছে এই শর্তগুলো যদি প্রকাশ হতো তাহলে সিন্ডিকেট এতটা শক্তিশালী হতে পারতো না। মনে হচ্ছে এখানে ইচ্ছা করেই মনিটরিং করা হয় না, ইচ্ছা করেই সুযোগ দেয়া হচ্ছে। |