/ অর্থনীতি / বাণিজ্য / আমদানি-রপ্তানি সহজীকরণ: কিছু প্রতিষ্ঠানের অসহযোগিতায় চালু হচ্ছে না সিঙ্গেল উইন্ডো
আমদানি-রপ্তানি সহজীকরণ: কিছু প্রতিষ্ঠানের অসহযোগিতায় চালু হচ্ছে না সিঙ্গেল উইন্ডো
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে ব্যবসায়ীদের ভিন্ন ভিন্ন সংস্থা থেকে সনদ ও লাইসেন্স সংগ্রহ করতে বাড়তি সময় ও অর্থ দেওয়ার পাশাপাশি হয়রানির শিকার হতে হয়। হয়রানি দূর করে এসব সনদ ও লাইসেন্স একটি সিস্টেমের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রদান করতে ১৯টি সংস্থাকে একটি সিঙ্গেল উইন্ডোর মাধ্যমে সংযুক্ত করতে উদ্যোগ নেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনিবআর)। কিন্তু আট বছর চলে গেলেও ১১টি সংস্থাকে যুক্ত করা যায়নি। যার কারণে আবারও বাড়নো হলো এই প্রকল্পের সময়। জানা গেছে, অগ্রহ না থাকা ও নিজেদের হাত থেকে কর্তৃত্ব হাতছাড়া না করতে চাওয়াসহ নানা অজুহাতে এসব প্রতিষ্ঠান সময় ক্ষেপন করছে। আর এ কারণে ব্যবসায়ীরা দুর্ভোগ দূর করে ঘুষ-দুর্নীতি মুক্ত থেকে কম সময়ে সরকারি সংস্থার সনদ পাওয়া কথা থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে তা পাচ্ছেন না। পণ্য আমদানি করতে ১৯টি সরকারি সংস্থা ও দপ্তর থেকে ৩২টি সনদ নিতে হয়। ব্যবসায়ীদের একেকটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে আবেদন করে এই সব সনদ সংগ্রহ করতে হয়ে। এতে দীর্ঘ সময় লাগার পাশাপাশি বাড়তি টাকা গুনতে হয়। তারপরও নানা অজুহাতে সময় ক্ষেপন করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একদিন থেকে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এতে উৎপাদিত পণ্য সময় মত কারখানা ও বাজারে পৌঁছাতে পারে না। এ সব হয়রানি বন্ধ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সেবা দিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ২০১৭ সালে ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো প্রজেক্টের মাধ্যমে বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো (বিএসডব্লিউ) নামে সফ্টওয়্যার প্রস্তত শুরু করে। যার সঙ্গে ১৯ দপ্তর ও সংস্থার নিজস্ব সিস্টেম যুক্ত করা হবে। পণ্য আমদানি-রপ্তানি করতে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে সিঙ্গেল উইন্ডো বিএসডব্লিউ সিস্টেম ব্যবহার করে আবেদন করার এক ঘণ্টা থেকে সর্বোচ্চ একদিনের মধ্যে আবেদনকারী সনদ পেয়ে যাবে। এই সনদ নিয়ে ব্যবসায়ী কাস্টম থেকে মালামাল ছাড় করবে। মূলত এভাবেই নতুন এই ব্যবস্থাটি তৈরি হওয়ার কথা ছিল। সিঙ্গেল উইন্ডো বিএসডব্লিউ সিসটেম ফাংশন শুরু করলে আবেদনকারী ও সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরাসরি দেখা হবে না। ফলে বাড়তি অর্থ নেওয়ার জন্য অযথা সময় ক্ষেপন বা আবেদন সময় মতো না পৌঁছানোর অজুহাত দেখাতে পারবে না। আবেদনের সিস্টেমেই বলে দেবে কোন সময় আবেদন এসেছে, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে আছে কি না। এই সিস্টেম চালু হলে কোনো সংস্থার লোকজনের যোগসাজসে নিষিদ্ধ ঘোষিত পণ্য আমদানি-রপ্তানি করতে পারবে না। এর মাধ্যমে অবৈধ পণ্য দেশে আসবে না, আবার কর্মকর্তাদের অসৎ পথে টাকা আদায় করার পথও বন্ধ হবে। প্রয়েজনীয় তথ্য প্রমাণসহ আবেদন করলে সঙ্গে সঙ্গে সনদ পেয়ে যাবে। এনবিআর সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে ৬০৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এ সিঙ্গেল উইন্ডো বিএসডব্লিউ এর উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর সিঙ্গেল উইন্ডো বিএসডব্লিউ কাজ শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু সিঙ্গেল উইন্ডোর সঙ্গে সংযুক্ত হতে যাওয়া ১৯ প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার মধ্যে আট বছরে সংযুক্ত হতে পেরেছে মাত্র আটটি। বাকি ১১টি প্রতিষ্ঠান এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি। এ জন্য আরও দুই মাস সময় পেছানো হয়েছে। এর আগে খুঁচরাবাজারে পণ্য বিক্রিতে ভ্যাট আদায়ের জন্য এনবিআর মেশিন বসানো কার্যক্রম দীর্ঘ এক যুগেও সম্পন্ন করতে পারেনি। সর্বশেষ কিছু দোকান ও আউটলেটে ইএফডি মেশিন বসানো হলেও বেশিভাগ দোকানে বসানো সম্ভব হয়নি। ফলে পণ্য বিক্রিতে ইএফডি মেশিন থাকা ও না থাকা দোকানের মধ্যে দামের তারতম্য সৃষ্টি হয়েছে। এক সঙ্গে সকল দোকানকে ইএফডি মেশিন সরবারহ না করতে পারার কারণে ইএফডি মেশিন পাওয়া দোকানগুলো ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সিঙ্গেল উইন্ডো বিএসডব্লিউ স্থাপনের ক্ষেত্রে এই দীর্ঘসূত্রতায় অনিশ্চয়তা পেয়ে বসেছে আমদানি-রপ্তানিকারকদের। এ বিষয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, আমদানি-রপ্তানি সম্পর্কিত সকল সেবা একটি সিঙ্গেল ব্যবস্থার মাধ্যমে পাওয়ার দাবি ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের। তাদের দাবি সিঙ্গেল উইন্ডো যেন হয় সিঙ্গেলই হয়; এই বিভাগের জন্য একটি উইন্ডো, আরেকটি বিভাগের জন্য আরেকটি উইন্ডো, এমন যেন না হয়। একটি হাইটেক পার্কের জন্য, একটি বিডার জন্য এমন হলে এটা ওয়ান স্টপ সার্ভিস হলো না, এটা ফোর স্টপ সার্ভিস হয়ে গেলো। ওয়ান স্টপ সার্ভিসে নিতে যখন যাবো, আমি আর এক কদম অন্য কোথাও যাবো না। এটা মেইন্টেন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমি একটি কক্ষে যাবো, সেখান থেকে সব সমাধান দিতে হবে। অমুকের কাছে পঠাবে, তমুকের কাছে পাঠাবে-এটা যেন না হয়। এই সুবিদা যদি দেওয়া না যায় তাহলে একটি বিভাগ খোলা হবে, একাধিক কর্মকর্তার নিয়োগ দেয়া হবে। আর এতে সরকারের অযথা খরচ বাড়বে। এতে আমরা আশাবাদী না; অতীতেও ছিলাম না। তবে একটি নতুন সরকার এসেছে, এ সরকার নতুন করে করার চেষ্টা করছে। আমরা ভিন্ন ভাল কিছুর অপেক্ষায় থাকলাম; বলেন এই ব্যবসায়ী নেতা। তিনি বলেন, আমরা ভবিষ্যৎবাণী শুনে শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ভবিষ্যৎবাণী দেওয়া আর বাস্তবায়ন করা এক জিনিস নয়, যা আমাদের রাজস্ব বোর্ড দেখিয়েছে। আমরা আর বাণী শুনতে চাই না, আমরা দেখতে চাই, এটা হচ্ছে। এক জায়গা থেকে ভবিষ্যৎবাণী আসে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে, বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে যাবে, এ ধরনের বাণী সব সময় ছিল। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি। ব্যবসায়ীদের হাতে আর সময় নেই। ব্যবসায়ীদের যেভাবে আঘাত করা হয়েছে সেটা কাটিয়ে উঠতে পারবে কি না, জানি না। অতীতে যে সব ভুল হয়েছে, সেগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগুতে হবে। তা নাহলে আবার ভুল হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইন্টিগ্রেটেডে ট্যাক্স এ্যাডমিনেসস্ট্রেশনেও বাঁধা এসেছে। এনবিআর এর ভেতর থেকে কেউই তাদের রাজত্ব ছাড়তে চান না। এটা আমরা ১৫ বছর ধরে চাচ্ছি! আগে হয়তো একটি রাজনৈতিক দল পরিচালনা করেছে, তখন না হয় বাধা দিয়েছে। এখন তো আর রাজনৈতিক দল নেই। এখন তো করে ফেলতে পারবে। প্রাধান্যটা জায়গা মতো দিতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণে সরকার নিজস্ব ৮০ কোটি ৬৬ লাখ টাকাসহ বিশ্বব্যাংকের ৫২৯ কোটি ২৯ লাখ ঋণ সহায়তায় বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো সিসটেম প্রস্তুত করছে। লক্ষ্য ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণের মাধ্যমে বৈশ্বিক বাণিজ্যের কাতারে নিজেদের উপনীত করা এবং দেশের রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থা আধুনিক করা। বিএসডব্লিউ সিস্টেম প্রস্তুত করার পরও সিসটেমের অংশী প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব ধরে রেখে ঘুষ-দুর্নীতির সুযোগ হাত ছাড়া করতে না চাওয়া, অদক্ষতা ও উদ্যোগের অভাব ব্যবসা সহজীকরণে প্রধান বাধা হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন এটা করতে হলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইন করে হলেও পিছিয়ে থাকা অংশী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করতে হবে। এ বিষয়ে সিপিডির সিনিয়র গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম বলেন, সিঙ্গেল উইন্ডোর উদ্যোগটি ভাল। কিন্তু এর বড় ইস্যু ছিল এনবিআর এর সঙ্গে অংশী প্রতিষ্ঠানগুলো রাজত্ব ছাড়তে চান না। এখন সেইগুলো যদি অপারেশনাল করা যায় তাহলে এটা ইফেক্টিভ হবে। গত বিশ বছর ধরে আমরা চাচ্ছি। এটা করতে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেটাও প্রায় দশ বছর চলছে। এখন কথা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক সঙ্গে করতে হবে। এক সঙ্গে আনা গেলে কর ফাঁকিসহ অন্যান্য বিষয়গুলোও চেক করা সহজ হবে। কারণ এর মধ্য দিয়ে সবগুলো কাজ এক জায়গার মধ্যে আসবে। অন্যদিকে সুশাসনের দিক থেকেও ভাল হবে। সর্বোপরি নীতি গ্রহণের জন্যও এটা ইতিবাচক হবে। |