/ শিক্ষা / ইউজিসিতে জিম্মি করে পদোন্নতি আদায়ের চেষ্টা
ইউজিসিতে জিম্মি করে পদোন্নতি আদায়ের চেষ্টা
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
অস্থিরতা বিরাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি)। আওয়ামী লীগ আমলে বৈষম্যের শিকার এমন অভিযোগ তুলে বঞ্চিতদের পাশাপাশি পদোন্নতি বাগিয়ে নিয়েছেন কিছু সুযোগ সন্ধানী কর্মকর্তা। দাবির প্রেক্ষিতে পদোন্নতি দেয়ার কারণে বঞ্চিত হয়েছেন অন্তত ৭০/৮০ জন। তাদের দাবি পদোন্নতিতে মানা হয়নি জ্যেষ্ঠতা বা চাকরির শর্ত। বঞ্চিতরা নতুন করে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এমন অভিযোগ তোলার পরও পড়েছেন রোষানলে। অফিস করছেন ভয়ে ভয়ে। বুধবার ছিল কমিশন সভা। এজন্য ইউজিসি ভবনে শোডাউন করতে দেখা যায় কর্মকর্তাসহ বহিরাগতদের। আওয়ামী লীগ আমলে যোগ্যতা থাকার পরও অনেকেই ছিলেন পদোন্নতি বঞ্চিত। পট পরিবর্তনের পর কিছু কর্মকর্তা বঞ্চিতদের কাতারে ঢুকে পড়েন। তারা ইউজিসি নতুন প্রশাসনকে এতটাই কোণঠাসা করে ফেলেন যে, বাধ্য হয়ে পদোন্নতি দেয়া হয় তাদেরকেও। অনেকের নেই যোগ্যতা, এ ছাড়াও অনেকেই ছিলেন আওয়ামী লীগ আমলের সুবিধাভোগী। ৫ই আগস্টের পর অনেকেই দলের ভোল পাল্টিয়ে ফেলেন। পূর্ণাঙ্গ কমিশনের আগেই কয়েক ধাপে ৩৩ জনকে পদোন্নতি দেয়া হয়। এরমধ্যে ১৮ই নভেম্বর এক অফিস আদেশেই পদোন্নতি পান ২৮ জন। যাদের মধ্যে রয়েছেন ৯ জন অতিরিক্ত পরিচালক, ২ জন উপ-পরিচালক, ৯ জন জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক ও ৮ জন সহকারী পরিচালক। এ ছাড়াও পূর্বের দুই ধাপে পাঁচজনকে পদোন্নতি দেয়া হয়। কোনো কর্মকর্তা বকেয়া বিল পাবেন না উল্লেখ করে ব্যাকডেটেও পদোন্নতি দেয়া হয়। বঞ্চিতরা অভিযোগ করছেন, অবিশ্বাস্যভাবে অনেকেই পেয়েছেন পদোন্নতি। বিষয়টি তারা পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তারা বলেন, অতিরিক্ত পরিচালক পদে পদোন্নতি পাওয়া তিনজন ও উপ-পরিচালক পদের একজন ছিলেন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। আর জ্যেষ্ঠ সহকারী ও সহকারী পরিচালকরা সবাই তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। তারা অধিকাংশ যোগদানের সময় ছিলেন কম্পিউটার অপারেটর। এমনকি পদোন্নতি পাওয়া একজন পরিচালক তৃতীয় শ্রেণির রিসিপশনিস্ট পদে চাকরি শুরু করেন। তবে এই তালিকায় রয়েছেন প্রকৃত বঞ্চিত কর্মকর্তারাও। বঞ্চিত কর্মকর্তারা এতটাই কোণঠাসা যে, যারা পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করেছেন তারাও কথা বলতেও চাইছেন না। তারা লিখিতভাবে গত ২৬শে জানুয়ারি আলাদা দুটি অভিযোগ করেন। প্রথম চিঠিতে স্বাক্ষর করেন ৩০ জন কর্মকর্তা। এতে পদোন্নতির উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, কোনো কোনো কর্মকর্তাকে তার পূর্ব পদের এবং মোট চাকরির অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ না হওয়া সত্ত্বেও পদোন্নতি/পদোন্নয়ন দেয়া হয়েছে। যা ইউজিসি’র প্রবিধানমালা ও অনুসৃত নিয়োগ নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অধিকন্তু, এ বিষয়ে কমিশন থেকে আবেদন চেয়ে কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়নি। দ্বিতীয় চিঠিতে স্বাক্ষর করেন ১০ কর্মকর্তা। এতে বলা হয়, গত ১৮ই নভেম্বর আদেশে প্রথম চারজনের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি/পদোন্নয়ন কার্যকর করা হয়েছে ১০ জন কর্মকর্তার চাকরিতে যোগদানের ১/২ সপ্তাহ পূর্ব থেকে। তারা অভিযোগ করে এর ফলে জ্যেষ্ঠতার নিয়ম মানা হয়নি। এই চিঠিতে সই করা একজন কর্মকর্তা বলেন, এখন ইউজিসি চলছে মগের মুল্লুকের মতো। প্রথমে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে জোরপূর্বক রদবদল করা হয়। গায়ের জোর দেখানোর জন্য বাইরে থেকে লোক আনা হয়। অভ্যুত্থানের পর যারা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসেছেন তারাই এর সঙ্গে জড়িত উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন ইউজিসিতে চাকরি করা কঠিন হয়ে গেছে। আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও কোণঠাসা। তিনি অভ্যুত্থানের পর রদবদল হওয়া পদগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধানের দাবি জানান। তিনি বলেন, যারা আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে বা ঊর্ধ্বতনদের হয়ে ইউজিসিতে বসেছিলেন তারা অভ্যুত্থানের পরই চলে গেছেন। আমরা চাকরির জন্য তাদের সঙ্গ দিয়েছি। এখন আমাদের ট্যাগ দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আমি বিএনপি’র আমলে চাকরিতে যোগদান করেছি। তাহলে আমার ট্যাগ তো উল্টো হওয়া উচিত ছিল। যারা আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী ছিলেন তারাই এখন ভোল পাল্টিয়েছেন। পদাবনতি পাওয়া আরেক কর্মকর্তা বলেন, যদিও এটা রুটিন ওয়ার্ক দেখানো হয়েছে। কিন্তু আমাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি এসব বিষয়ে কোনো অভিযোগ করতে চাই না। এখুনি শোকজের ভয়ে আছি। বুধবার ইউজিসি কার্যালয়ে দুপুরে দেখা যায়, কমিশনের সভা উপলক্ষে নিচে জড়ো হয়েছেন একাধিক লোক। সভাকক্ষের সামনেও অবস্থান নিয়েছেন বেশ কয়েকজন। নিচে থাকা অনেকেরই ইউজিসি’র সঙ্গে যোগাযোগ নেই বলে জানা যায়। তারা সেখানে আইসক্রিম ও বরই খাচ্ছিলেন। সভাকক্ষের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একাধিক ব্যক্তি প্রশ্ন তোলেন কার কাছে যাবো। আবার নিচে বেরিয়ে এসে আকাশ নামে এক যুবকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি ইউজিসি’র কেউ নন উল্লেখ করে বলেন, বড় ভাই ডাকছেন এজন্য আসছি। ডাকার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ভাই বললেন থাকো। কোনো প্রয়োজন হলে ডাক দেবো। তবে তিনি ভাইয়ের নাম বলতে রাজি হননি। ইউজিসি’র প্রবেশ পথে নাম ও পরিচয় এন্ট্রি খাতায় উল্লেখ করে প্রবেশ করতে হয়। নিয়ম থাকলেও ইউজিসি আইডি কার্ড ব্যতীত লোকদের এন্ট্রি না করেই প্রবেশ করতে দেখা যায়। তবে তারা ইউজিসি সংশ্লিষ্ট কিনা তা জানা যায়নি। ইউজিসিতে গিয়ে জানা যায়, মঙ্গলবার সেখানে পদোন্নতি নিয়ে হয়েছে হট্টগোল। সচিবের দপ্তরে কথা-কাটাকাটি হয়। সেখান থেকে চেয়ারম্যানের দপ্তরে গেলে সেখানেও পদোন্নতি পাওয়া ও না পাওয়াদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা বাধে। এরপর সমস্যা সমাধানের জন্য ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান এবং অধ্যাপক ড. মো. সাইদুর রহমান তাদের সঙ্গে বসে শান্ত করেন। এ প্রসঙ্গে ইউজিসি’র সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, দাবি নিয়ে কথা বলছিলেন। তাদের মধ্যে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। পরে কথা বলার পর শান্ত হন তারা। পদোন্নতির বিষয়ে ইউজিসি অফিসিয়াল বার্তায় জানায়, স্বৈরাচার আমলে দেশের সব প্রতিষ্ঠানে স্বৈরাচারপন্থি এবং তোষামোদকারী ব্যক্তিদের পদোন্নতি ও পদোন্নয়ন দিয়ে উচ্চপদে উন্নীত করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নিতান্ত অযোগ্য ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। এভাবে প্রতিষ্ঠানসমূহকে প্রকারান্তরে ধ্বংস করা হয়েছে। এতে বলা হয়, যোগ্যতাসম্পন্ন, ভিন্ন মতাদর্শী এবং প্রতিবাদী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি/ পদোন্নয়নসহ প্রাপ্য অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ৫ই আগস্ট বাংলাদেশ স্বৈরাচারমুক্ত হলে অন্তর্বর্তী সরকার ইউজিসিতে নতুন কর্তৃপক্ষ নিয়োগ করেছে। এই কর্তৃপক্ষ নিয়ম ও বিধি অনুসরণ করে স্বৈরাচার সময়ে বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার সেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রথম পর্যায়ে একাংশকে তাদের প্রাপ্য পদোন্নতি/পদোন্নয়ন করেছে। সেইসঙ্গে বর্তমান সুযোগ্য কর্তৃপক্ষ সকলকে অফিসে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রেখে দেশের উচ্চশিক্ষাকে গতিশীল করতে তাদেরকে অনুপ্রাণিত করছে। এ বিষয়ে অভ্যুত্থানের পর দায়িত্বে আসা ইউজিসি’র একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, এখন প্রতিষ্ঠানটিকে স্থির করা অতীব জরুরি। এখন সংস্কারের সময় কিন্তু কাজ করতে পারছি না। আমরা অনেকটা বাধ্য হয়ে তাদের পদোন্নতি দিয়েছি। কিছুটা চাপের মুখে আমরা কাজ করছি। পদোন্নতি পাওয়া কিছু ব্যক্তি যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ পাননি বিষয়টি আমরা অনুধাবন করেছিলাম। কিন্তু দায়িত্ব নেয়ার পরই এগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়েছে। তিনি একটি সিন্ডিকেটের কথা উল্লেখ করে বলেন, তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে হয় বুঝেশুনে। তারা চারদিক দিয়ে নানানভাবে জাল বিস্তার করছেন। এখন এই অসন্তোষ দূরীকরণে আমরা কৌশল নির্ধারণ করবো। আমরা কৌশলগত পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভেবে দেখবো। এক প্রশ্নের জবাবে ইউজিসি বহির্ভূত ব্যক্তিদের আনাগোনার বিষয়টি অবগত উল্লেখ করে তিনি বলেন, আপাতত বাইরের লোকদের নিয়ে ভয় নেই তবে ভেতরের বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তিত। |