/ বিশেষ / সাদিক আব্দুল্লাহর ঘনিষ্ঠকে মাউশির ডিজি: সমন্বয়ক-নাগরিক কমিটির সঙ্গে শিক্ষা সচিবের তুঘলকি কাণ্ড
সাদিক আব্দুল্লাহর ঘনিষ্ঠকে মাউশির ডিজি: সমন্বয়ক-নাগরিক কমিটির সঙ্গে শিক্ষা সচিবের তুঘলকি কাণ্ড
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
শিক্ষা প্রশাসনে শীর্ষ দুটি পদে মহাপরিচালক পদায়ন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক পদে পদায়ন পেয়েছেন পটুয়াখালী সরকারি কলেজের অধ্যাপক, শিক্ষা ক্যাডারের ১৪তম বিসিএসের কর্মকর্তা ড. এহতেসাম উল হক। আর জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম) মহাপরিচালক পদে পদায়ন পেয়েছেন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. জুলফিকার হায়দার। এই দুজনই বিগত সরকারের সুবিধাভোগী ও আওয়ামী লীগের মতাদর্শের বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের পদায়নে ক্ষুব্ধ হয়ে রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়েরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের অর্ডার বাতিলের দাবি জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটির সদস্যরা। অন্যাথায় সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) মাউশি অধিদপ্তর ও নায়েম ঘেরাও করবেন বলে হুমকি দিয়েছেন তারা। এসময় সচিবের সঙ্গে তাদের বাগবিতাণ্ডা হয়। উত্তেজিত হয়ে চুক্তিভিত্তিকে আসা সচিব বলেন, এমন হলে আমি চলে যাবো। সরজমিনে দেখা যায়, বেলা ২টার পর সচিবের রুমে প্রবেশ করে নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক। তারা মাউশি ও নায়েমের ডিজির পদায়নের বিষয়ে জানতে চান। সচিব জানান, এই দুইজনের আদেশ হওয়ার আগে দুই কর্মকর্তার কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত তথ্য, একাডেমিক ফলাফল সংগ্রহ করে ফাইল তোলা হয়। এরপর উপদেষ্টার সম্মতির পাওয়ার পর দুটি গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে তাদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেখানে তারা আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী ছিলেন এমন কোনো তথ্য আসেনি। এরপর চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ফাইল পাঠানো হয়। সচিব তাদের জানায়, এখানে আমি সাচিবিক দায়িত্ব পালন করেছি। কোনো তথ্য যদি গ্যাপ থাকে সেটি উপদেষ্টাকে জানানো হবে। তিনিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। তিনি চাইলে তাদের অর্ডার বাতিল করতে পারেন। এরপর সমন্বয়কদের একজন বলেন, মাউশির নতুন ডিজি ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পক্ষে গুণগান গেয়েছেন। স্বৈরাচারী হাসিনার ফুফাতো ভাই বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর অনুগত ছিলেন। জুলাই আন্দোলনের সময় ছাত্রদের মুভমেন্ট ও তথ্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিতেন। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সচিবের হাতে তুলে দেন সমন্বয়করা। তারা বলেন, এমন ব্যক্তিকে মাউশির ডিজি করা মানে ছাত্রদের রক্তের সাথে বেইমানি। তাকে দ্রুত সময়ের মধ্যে অপসারণ করতে হবে সচিব বলেন, পুরো বিষয়টি আমি উপদেষ্টাকে জানাবো। তিনিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। এই সময় একজন সমন্বয়ক বলেন, আপনি (সচিব) হয়েছেন ছাত্রদের রক্তের ওপর দাড়িয়েছে। অথচ আপনি সাবেক বিদ্যুৎ জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নজরুল হামিদ বিপুর হাতে ধরে যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন। সেই অভিযোগ আমরা করতে চায় না। কিন্তু আপনার হাত ধরে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন হলে এটা ছাত্ররা মেনে নেবে না। এসময় সচিব উত্তেজিত হয়ে বলেন, আমাকে এসবের ভয় দেখাবে না। আমি আছি বলেই এখনও কিছু ভালো পদায়ন হচ্ছে। অন্যথায় অনেক কিছু এখানে ঘটতো। তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আমি বিপুর লোক হলে অনেক আগেই সচিব হয়ে যেতাম। পদায়ন ও যোগদানের সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রোববার আলাদা প্রজ্ঞাপনে দুইজন মহাপরিচালককে পদায়ন করা হয়। মজার ব্যাপার হল এই দুইজনের নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করে মন্ত্রণালয়। ৩০ জানুয়ারি প্রজ্ঞাপন হলেও মাউশির ডিজির প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয় রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) বেলা সাড়ে ১১টার পর। তার আগেই তাকে মন্ত্রণালয়ে যোগদান করান সচিব। সকাল ১০টায় সচিবের রুমে যোগদান করেন নতুন মহাপরিচালক ড. এহতেসাম উল হক। সচিবের কাছে যোগদানের পর মন্ত্রণালয়ের ডেস্ক অফিসার উপসচিব (সরকারি কলেজ-২) মো. মাহবুব আলম মাউশির কর্মকর্তাকে ফোন করে জানান, নতুন মহাপরিচালক হিসেবে ওমুক যোগদান করেছেন। তিনি একটু পর যোগদান করবেন। তার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। এটা শুনার পর মাউশির কর্মকর্তা দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন। ততক্ষণ পর্যন্ত জানেন না, কে নতুন ডিজি হিসেবে পদায়ন পেয়েছেন। দপ্তরের আসার পর তারা জানতে পারেন ওনি পটুয়াখালী সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক। এ বিষয়ে মাউশির একজন কর্মকর্তা বলেন, এমন যোগদান এর আগে কখনও তিনি দেখেননি। আগে অর্ডার হয় তারপর যোগদান। এবার দেখলাম আগে যোগদান তারপর অর্ডার। তাকে যোগদানের ক্ষেত্রে এমন গোপনীয়তা নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে শিক্ষা প্রশাসনে। অনেকের অভিযোগ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের পছন্দের ওনি পদায়ন পেয়েছেন। তাকে বাছাই প্রক্রিয়ায় সচিব সংশ্লিষ্ট শাখার কাউকে জানাননি। সব প্রক্রিয়া শেষ করে উপদেষ্টাকে তিনি ম্যানেজ করেন। কেউ কেউ বড় ধরনের আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ তুলেছেন। যদিও সচিব এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি তার দপ্তরে বলেন, কোন পদায়ন আমি ইচ্ছে হয় না। সবকিছু উপদেষ্টা সম্মতি নিয়েই হয়। মহাপরিচালকের ক্ষেত্রে ফাইল প্রধান উপদেষ্টা পর্যন্ত যায়। এখানে আমার পছন্দে তিনি নিয়োগ পেয়েছেন বিষয়টি সম্পূর্ণ অমূলক। মাউশির ডিজির বিরুদ্ধে যত অভিযোগ মাউশির নতুন ডিজি ড. এহতেসাম উল হক ৫ আগস্টের আগে বরিশালে মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। জুলাই আন্দোলনের সময় কলেজের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক আচরণসহ আন্দোলনকারীদের তথ্য পুলিশের কাছে তুলে দেন অধ্যক্ষ। ৫ আগস্টের তার অপসারণের দাবিতে কলেজে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অসদাচরণের অভিযোগ দীর্ঘদিনের এমন অভিযোগ তুলে তার অপসারণ চায় শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবি, এহতেসাম উল হক ২০২১ সালের জুন মাসে এই কলেজে যোগদান করেন। তিনি বরিশাল সিটি কর্পোরেশন তৎকালীন মেয়র ও শেখ হাসিনার আত্মীয় সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর ঘনিষ্ঠ অনুচর ছিলেন। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, অধ্যক্ষ তাঁর মেয়াদকালে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেছেন। জুলাই আন্দোলন কলেজ থেকে সব ধরনের অসহযোগিতা করেছেন। তাকে বরিশাল মডেল কলেজ থেকে অপসারণের জন্য শিক্ষার্থীরা বরিশাল পুলিশ কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে শিক্ষা সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। শিক্ষার্থীরা বলেন, অধ্যক্ষ এহতেসাম এখনও স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের দোসর হয়ে কাজ করছেন। আমাদের দিয়ে এখনও জয়বাংলা স্লোগান দেওয়ানোর চেষ্টা করছে। কলেজের এসি ব্যবহার করছেন নিজ বাসভবনে। তার আচরণ ও কর্মকাণ্ডে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা অতিষ্ঠ। অভিযোগে আরও বলা হয়, তিনি কলেজের গাড়ি পারিবারিক কাজে ব্যবহার করতেন। গাড়িটিতে বাসার বাজার, শ্বশুর বাড়ির লোকজনও ব্যবহার করতেন। কলেজের বিদ্যুৎ দিয়ে কলেজের অভ্যন্তরে অধ্যক্ষের নিজস্ব কলেজ অ্যাভিনিউর বাসার গ্রিল নির্মাণসহ অন্যান্য বৈদ্যুতিক কাজ করিয়েছেন। কেউ প্রতিবাদ করলে চাকুরি খেয়ে ফেলার হুমকি, এসিআর খারাপ করে দেওয়ার হুমকি দেন। চুক্তিভিত্তিক শিক্ষককে বেতন না দিয়ে বিদায় করে দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের আবেদনের পর নভেম্বর মাসে বরিশাল মডেল কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে পদাবনতি দিয়ে পটুয়াখালী কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক পদে পদায়ন করা হয়। সব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে এহতেসাম উল হককে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। তার দপ্তরের গিয়েও পাওয়া যায়নি। এদিকে নায়েমের ডিজি হিসেবে পদায়ন পাওয়া জুলফিকার হায়দার। তার বিরুদ্ধে দীপু মনির সাথে ঘনিষ্ঠতা এবং বাতিল হওয়া বিতর্কিত কারিকুলামের সঙ্গে সরাসরি সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। |