![]() কৃত্রিম প্রজনন : সরকারি চুক্তিতেও ‘বিনা বেতন’
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
![]() অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথমদিকে পাঁচ লাখ গাভির কৃত্রিম প্রজনন করা হলেও বর্তমান লক্ষ্যমাত্রা ৪১ লাখের অধিক। এ খাত থেকে সরকারের বছরে প্রায় ৩০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হলেও চুক্তির কারণে নিয়োগ পাওয়া কর্মীরা কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। বর্তমানে কৃত্রিম প্রজননে নিয়োজিত রয়েছেন পাঁচ হাজার এআই টেকনিশিয়ান। তারা মূলত প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এআই টেকনিশিয়ান প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি। কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম সরকারিভাবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কৃত্রিম প্রজনন দপ্তর পরিচালনা করে থাকলেও বর্তমানে ১১টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এ কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো- আমেরিকান ডেইরি লিমিটেড (এডিএল), লালতীর লাইভস্টক (বিডি) লিমিটেড, ব্র্যাক এআই এন্টারপ্রাইজ (শম্ভুগঞ্জ), এসিআই এনিমেল জেনেটিক্স, ইজাব এলায়েন্স লিমিটেড, সমাজ ও জাতিগঠন (সজাগ), ব্র্যাক এআই এন্টারপ্রাইজ (শেরপুর, বগুড়া), পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) বগুড়া, মিল্কভিটা লিমিটেড, ঠাকুরগাঁও ডেইরি লিমিটেড (টিডিএল) ও ইয়ন বায়োসায়েন্স লিমিটেড। জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে দেশের বর্ধিত জনসংখ্যার প্রাণিজ পুষ্টির চাহিদা মেটাতে গো-সম্পদের জাত উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা জরুরি হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় কৃত্রিম প্রজননের জন্য প্রকল্প হাতে নেয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। সেখানে অর্গানোগ্রামে (জনবল কাঠামো) নিয়োগের সুযোগ না থাকায় পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণ দিয়ে সারা দেশে ইউনিয়নপর্যায়ে এআই টেকনিশিয়ান (স্বেচ্ছাসেবী) নিয়োগ দেওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে পাঁচ হাজার জনকে মনোনয়ন করে অধিদপ্তর। প্রকল্পের শুরুর দিকে একটি ইউনিয়নে একজনকে নিযুক্ত করা হলেও বর্তমানে অনেক জায়গায় একাধিক টেকনিশিয়ান কাজ করছেন। বিনা বেতনের কাজ হলেও দেশের চাকরির বাজারের অবস্থা বিবেচনা করে এটিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন অনেকে। একাধিক টেকনিশিয়ান নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘১৯৯৬ সালে গাভির কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রমে পাঁচ বছরের জন্য বিনা বেতনে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে চুক্তিবদ্ধ হই। সেই চুক্তি দিয়ে এখনও আমাদের কাজ করানো হচ্ছে। আমরা বিভিন্ন সময় বেতন কিংবা ভাতার দাবি জানিয়ে আসলেও অধিদপ্তর তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না।’ ‘একদিকে বেতন নেই, অন্যদিকে বেসরকারি কোম্পানিকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তার ওপর প্রতি মাসে ১৫০ থেকে ২০০টি সিমেন বিক্রির টার্গেট রয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে একজন টেকনিশিয়ান দেওয়ার কথা থাকলেও এখন একাধিক ব্যক্তি কাজ করছেন। সেই কারণে টার্গেট পূরণ করা সম্ভব হয় না। বছর শেষে নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে টার্গেট পূরণ করতে হয়।’ তারা আরও বলছেন, ২০০০ সালের আগে প্রতি সিমেনের জন্য রাজস্ব মূল্য ছিল পাঁচ টাকা। পরে তা ৩০ টাকা করা হয়। আর টেকনিশিয়ানদের জন্য পারিশ্রমিক ধরা হয় ৪০ টাকা। ২০২৩ সালে ৩০ থেকে ৭৫ টাকা করা হয় সিমেনের মূল্য। তবে, টেকনিশিয়ানদের পারিশ্রমিক বাড়েনি। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে বেশ কয়েকটি সিমেনের অনুমোদন রয়েছে। তার মধ্যে শাহিওয়াল, হলস্টিন ফ্রিজিয়ান, হলস্টিন ফ্রিজিয়ান ক্রস, রেড চিটাগাং ক্যাটেল (আরসিসি), উন্নত দেশি, আরসিসি মুন্সীগঞ্জ, পাবনা। এসব সিমেনের জন্য জাতীয় প্রজনন নীতিমালা অনুসরণের নির্দেশিকা রয়েছে। কোন সিমেন কত শতাংশ ব্যবহার করতে হবে তা-ও উল্লেখ রয়েছে। তবে, বেশ কয়েকটি জাতের সিমেনের অনুমোদন সরকার দেয়নি। টেকনিশিয়ানদের অভিযোগ, অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি কোম্পানিগুলো কয়েকটি জাতের সিমেন বিক্রি করে। নিষিদ্ধ সিমেনগুলো হলো- ব্রাহমা সিমেন, গির সিমেন, ফ্লেকভি সিমেন ও জার্সি সিমেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি নীতি আদেশ ২০২১-২৪ এর ৩৪ ধারায় গবাদিপশুর হিমায়িত সিমেন আমদানির বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘গবাদিপশুর হিমায়িত সিমেন ও এমব্রায়ো, ফ্রিজিয়ান, ফ্রিজিয়ান ক্রস, শাহিওয়াল, শাহিওয়াল ক্রস, ফ্রিজিয়ান-শাহিওয়াল ক্রস, এএফএস, এএফএস ক্রস জাতের গবাদিপশুর হিমায়িত সিমেন (ডিপ ফ্রোজেন সিমেন) ছাড়া অন্যান্য গরুর সিমেন আমদানি নিষিদ্ধ। তবে এও বলা হয়েছে, ফ্রিজিয়ান, ফ্রিজিয়ান ক্রস, শাহিওয়াল, শাহিওয়াল ক্রস, ফ্রিজিয়ান-শাহিওয়াল ক্রস, এএফএস, এএফএস ক্রস, ব্রাহমা, মুররাহ, নিলিরাভি ও মেডিটেরানিয়া মহিষের জাতের গবাদিপশুর হিমায়িত সিমেন, এমব্রায়ো আমদানি করা যাবে।’ ৭ দফা দাবিতে সারা দেশে টেকনিশিয়ানদের কর্মবিরতি বেতন-ভাতাসহ সাত দফা দাবিতে সারা দেশব্যাপী কর্মবিরতি পালন করছে এআই টেকনিশিয়ানরা। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ এআই টেকনিশিয়ান কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. আজাদ হোসেন বলেন, ‘দেশে প্রজননক্ষম গবাদিপশুর সঠিক সংখ্যা নিরূপণ না করে বেসরকারি সিমেন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে কৃত্রিম প্রজননের কাজ করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যা আমাদের পেশাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। যথাযথ প্রশিক্ষণ না দিয়ে অনেক কর্মীকে মাঠে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভবিষ্যতে আমাদের জাত উন্নয়নকে ব্যাহত করবে।’ ‘কৃত্রিম প্রজনন নীতিমালায় আমরা সবাই আটকে আছি অথচ বেসরকারি কর্মীরা তা মানছেন না। মাঠপর্যায়ে যথাযথ তদারকির ব্যবস্থা নিতান্তই অপ্রতুল’ — অভিযোগ করেন তিনি। মো. আজাদ হোসেন বলেন, ‘আন্দোলন-সংগ্রামের মুখে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ৫০০ টাকা প্রতীকী ভাতা দেওয়া শুরু করে সরকার। পরবর্তী সময়ে দুই হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়। ন্যূনতম এ ভাতা নয় মাস বকেয়া রেখে ২০২৪ সালের ৩০ জুন থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিনা বেতনে কাজ করেও প্রতি বছর আমরা সরকারকে প্রায় ৩০ কোটি টাকার রাজস্ব প্রদান করছি।’ ‘বিরাজমান কঠিন বাস্তবতা মোকাবিলা করে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও পেশাদারিত্ব ও দায়িত্ববোধের কারণে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। কিন্তু চলমান পরিস্থিতিতে আমরা অসহায়। জীবন ও জীবিকার বৃহত্তর স্বার্থে আমরা সাত দফা দাবি জানিয়েছি।’ বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ এআই টেকনিশিয়ান কল্যাণ সমিতির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, ‘সিমেনের মূল্য যখন পাঁচ টাকা (রাজস্ব) ছিল তখন আমাদের কোনো পারিশ্রমিক ছিল না। যখন ৩০ টাকা রাজস্ব হয় তখন আমাদের পারিশ্রমিক ৪০ টাকা নির্ধারণ হয়। এখন সরকার ৭৫ টাকা রাজস্ব আদায় করলেও আমাদের পারিশ্রমিক বাড়ানো হয়নি।’ টার্গেটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মাসে ১৫০ থেকে ২০০টি সিমেনের টার্গেট দেওয়া হয়। সেই টার্গেট পূরণ করতে না পারলে বছর শেষে টাকা পকেট থেকে দিতে বাধ্য করে। আমি কাজ করি বা না করি, টাকা দিতে বাধ্য থাকি।’ ‘আমার টার্গেট ১০৫টি। বেতন-ভাতা কিছু নেই, তবে সিমেন নিতে বাধ্য। প্রকল্পের উপপরিচালকের সঙ্গে আমি ১৯৯৮ সালে টেকনিশিয়ান হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হই। সেখানে লেখা ছিল— সরকারের বিধিবিধানে কাজ করতে হবে। পাঁচ বছর বেতন ভাতা চাইতে পারবে না। চুক্তিপত্রের মেয়াদ শেষ, তবে এখনও সেই চুক্তিপত্র দিয়ে কাজ চলছে। আর আমরা বেতন ছাড়া চলব কী করে? শুধু সিমেন নয়, সরকারের ভ্যাকসিনের কাজটাও বিনামূল্যে আমরা করে থাকি।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রায় এক মাস আগে আমরা স্মারকলিপি দিয়েছি। দুজন ডিজি লিখিতভাবে আশ্বাস দিয়েছিলেন, আমাদের ভাতা করে দেবেন। কিন্তু আমাদের ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়নি। আমাদের আন্দোলন প্রত্যাহার করাতে হলে উপদেষ্টা বা সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাতে হবে।’ জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কৃত্রিম প্রজনন দপ্তরের পরিচালক কৃষিবিদ মো. শাহজামান খান বলেন, ‘টেকনিশিয়ানরা আমাদের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। তাদের কাজ এখনও চলমান। আমি জামালপুরে আছি, সেখানেও কাজ চলমান। টাঙ্গাইলেও একই অবস্থা দেখলাম।’ সাত দফা দাবি ও অন্যান্য বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। উল্টো এ প্রতিবেদককে অফিস যাওয়ার দাওয়াত দেন। টেকনিশিয়ানদের দাবিগুলো হলো— ১. এআইটি কল্যাণ সমিতির নেতাদের সঙ্গে ইতোপূর্বে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনুষ্ঠিত বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল (সম্মানজনক ভাতা/দৈনিক হাজিরা) তার দৃশ্যমান অগ্রগতি পরিলক্ষিত করতে হবে। ২. একই ইউনিয়নে একাধিক এআইটি নিয়োগ প্রক্রিয়া (নিজ খরচ, যথাযথ প্রক্রিয়াবিহীন প্রশিক্ষণ) বাতিল করতে হবে। ৩. বেসরকারি কোম্পানিকে কৃত্রিম প্রজননে কাজ করার অনুমতি দিয়ে টার্গেট প্রথা বহাল রাখা অযৌক্তিক। টার্গেট পূরণের বাধ্যবাধকতা শিথিল করতে হবে। ৪. এআইটিদের চাহিদা মোতাবেক সিমেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। ৫. সরকারি সিমেনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার রোধ করতে হবে। সেক্ষেত্রে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস, জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস ও জেলা ডিডি (এআই) অফিসকে যথোপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। ৬. বেসরকারি এআইকর্মীদের উপজেলা প্রাণীসম্পদ অফিসে মাসিক রিপোর্ট প্রদান নিশ্চিত করতে অফিস আদেশ জারি করতে হবে। ৭. সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী যোগ্য এআইটিদের এফএ (এআই) পদে নিয়োগ প্রদান ত্বরান্বিত করতে হবে। |