![]() অন্তর্বর্তী সরকারের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক ম্যান্ডেট নিয়েও অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলো থেকে নির্ভরযোগ্য ও জবাবদিহিতা মূলক করার চ্যালেঞ্জ যেমন আছে, তেমন নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কীভাবে কার্যকর উপায়ে হবে, আছে সেই প্রশ্নও। এসব মিলে সরকারের জন্য গ্রহণযোগ্যতা ধরে রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠান হবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সময়ের তুলনায় বিভিন্ন তরফে বিভাজন দেখা যাচ্ছে ছয় মাসের সময়কালেই নানা ধরনের রাজনৈতিক বিভাজন, দ্বন্দ্ব আর অবিশ্বাসের জায়গা দেখা যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঘিরে। 'কিংস পার্টি' বিতর্কে সরকারের ছাত্র উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ দুজনেই বলেছেন, রাজনীতি করলে তারা সরকারি পদ থেকে বের হয়ে যাবেন। কিন্তু তাতে করে বিএনপি থেমে যায়নি। দলটির শীর্ষ পর্যায় থেকে ক্রমাগত বলা হচ্ছে নতুন দলকে তারা স্বাগত জানাবেন, কিন্তু সরকারে থেকে দল গঠন হলে সেটা জনগণ মেনে নেবে না। এর আগেও রাষ্ট্রপতি অপসারণ ও জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র নিয়ে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ দেখা গেছে। সরকারের সমর্থনে দল হলে সেটা বিএনপির জন্য আঘাত তৈরি করে কিনা, কিংবা এই সরকার আবার এক এগারোর মতো আচরণ করে কিনা তাদের সাথে এমন শঙ্কা থেকেই বিএনপি ছাত্রদের দল নিয়ে বিরোধিতা করছে বলে মনে করছেন অনেকে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ঘিরেও হয়েছে আলোচনা আর বিতর্ক। মুক্তিযুদ্ধকে পাশ কাটানোর মতো অভিযোগও এসেছে বিভিন্ন দিক থেকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার তো ভীষণ রকমের চাপ অনুভব করারই কথা। কারণ বিভিন্ন দল বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করছে এবং ঐক্যের জায়গা এখনও দেখা যাচ্ছে না। সরকারের ভেতরেও বিভিন্ন দলের মতের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্ন বা দূরত্ব এবং আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকেও নানা চাপ সরকারের ওপর রয়েছে। সরকারের জন্য একটা ঐক্যমত্যের জায়গা সৃষ্টি করাটাই এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ।সব পক্ষ থেকেই ঐক্য ধরে রাখার কথা বলা হলেও সরকারের যাত্রা শুরুর সময় যে ঐক্যমত্য বা আস্থার জায়গা ছিল সেটা কতটা ধরে রাখা সম্ভব হবে সেটা এখন একটা বড় প্রশ্ন। যে ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ দেড় দশক ক্ষমতায় ছিল, সে ব্যবস্থার সংস্কার করতে অনেকগুলো কমিশন হয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার বাস্তবায়ন কতটা করতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, 'সংস্কার সংস্কার বক্তব্য রেখে দয়া করে এই আলাপ দীর্ঘায়িত করবেন না। কারণ আপনারা আলাপ যত দীর্ঘায়িত করবেন দেশ তত বেশি সংকটের মুখে পড়বে'। সংস্কার বাস্তবায়নে নির্বাচন ছাড়া আর কোনো পথ দেখছে না বিএনপি। পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশের আগেই সংস্কার কমিশনের সুপারিশের প্রয়োগের জায়গায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। যেমন নির্বাচন বা জনপ্রশাসন সংস্কারের মতো দিক। সংস্কার কমিশনগুলো যে রিপোর্ট দিয়েছে সেখানেও ব্যাপক বিক্ষিপ্ততা, বিচ্ছিন্নতা রয়েছে এবং সেগুলোর জনগণের সাথে সম্পৃক্ততা নেই বলে মনে করছেন অনেকে।সরকার নিজেই জনসম্পৃক্তহীন অবস্থায় আছে এবং প্রক্রিয়াগত দিক দিয়ে সংস্কারের বিষয়ে জনগণের প্রাপ্যতার জায়গা এখনও পাওয়া শুরুই হয়নি বলে দাবি উঠেছে। অন্তত গুরুত্বপূর্ণ বা মৌলিক কিছু সংস্কারের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক ঐক্যমত্যের দরকার হবে। যদিও বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে অনাস্থা রয়েছে এই ইস্যুতেও। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যরা প্রশ্ন তুলেছেন সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে। সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামও বলেছেন, 'বিচার এবং সংস্কার আমাদের জন্য বেশি জরুরি।আমরা ছাত্ররা কিন্তু সরকারে এসেছি সেই ওয়াচডগের ভূমিকা পালন করতে'। যদিও সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য একটা রাজনৈতিক সরকার প্রয়োজন এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার খুব বেশি সংস্কার করতে পারবে বলে মনে করেন না অনেক বিশ্লেষক। যদি সরকারের মধ্যে এমন লক্ষ্য থাকে যে আমরা অনেক কিছু করে ফেলবো, বৈপ্লবিক কিছু করে ফেলবো, সেটা বোধহয় সম্ভব হবে না। বরং তাদের অল্প কিছু সংস্কারই করতে হবে এটাই সত্য, একেবারে যতটুকু না হলেই নয়। জুলাই-অগাস্টের সহিংসতার বিচারের প্রশ্নে সরকার বা রাজনীতিবিদের মধ্যে বিভেদ নেই। তবে বিচার সম্পন্ন করার সাথে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে বিরোধ রয়েছে। যদিও আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন,'বিচারকাজের সাথে নির্বাচনের কোনো বিরোধ নাই, কোনো সম্পর্ক নাই। বিচার বিচারের গতিতে চলবে'। আবার নির্বাচন যখন হবে তাতে আওয়ামী লীগ আদৌ অংশ নিতে পারবে কিনা আছে সে বিতর্কও। তাছাড়াও শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য নেতাদের আদৌ দেশে ফেরানো সম্ভব হবে কিনা আছে সেই প্রশ্নও। এসব প্রশ্নের উত্তর আদৌ সদুত্তর মিলবে কিনা সেদিকটাও অনিশ্চিত।অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জের জায়গা মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, রিজার্ভ পরিস্থিতি, বিনিয়োগ পরিবেশ, এমন অনেক কিছুই সামাল দেয়া। অর্থনীতি বা ব্যাংকিং ব্যবস্থা সামাল দেয়ার চেষ্টা করা হলেও মানুষের ওপর চাপ কমছে না। দ্রব্যমূল্যের সাথে কর্মসংস্থানের টানাপোড়েন মানুষের জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করছে।গত বছরের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন সম্প্রতি এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এতে বলা হচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতারা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন। এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের পুনরাবৃত্তি রোধ করার জন্য তারা অনেকগুলো সুপারিশ করেছে। এ রিপোর্ট প্রকাশের পর বাংলাদেশের রাজনীতি, সংস্কার কার্যক্রম এবং সরকার পরিচালনায় বড় ধরনের পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। একদিকে যেমন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই রিপোর্টকে ব্যবহার করে বিদায়ী সরকারকে খাটো করা চেষ্টা করবে। তেমনি সংস্কার কার্যক্রমে জাতিসংঘের আগ্রহের বিষয়টি তাদের অপছন্দ হলেও মেনে নিতে হতে পারে। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রিপোর্টকে স্বাগতও জানিয়েছে। তবে, বিশেষজ্ঞদের মতে বিভিন্ন কারণে এই রিপোর্টে দেওয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখামুখি হতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে।জনগণের ম্যান্ডেট না থাকায় একটা ট্রানজিশন পিরিয়ডের মাঝে অনিশ্চয়তার জায়গা থাকে যার মধ্যে বিনিয়োগ হয় না এবং এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। এছাড়াও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ বলে মনে করছেন অনেকেই। সুতরাং এমন বহুবিধ দ্বন্দ্ব, সংকট আর দুর্বলতা কাটিয়ে জনগণের জন্য আর্থিক দিক দিয়ে স্বস্তি আনাও সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতার জায়গাও প্রতিনিয়তই মানুষের মধ্যে সমালোচনার জায়গা সৃষ্টি করছে। উদ্যম ফেরানোর কাজ চলছে বলা হলেও বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অকার্যকর থাকার অভিযোগ উঠছে। পাঁচই অগাস্টের পর থেকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মব সংস্কৃতিসহ বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা হচ্ছে। সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার যেসব বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে জনগণের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়েছে সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ করে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা, আবার একই সাথে মাত্রাতিরিক্ত কঠোরতা যেন না হয় সেই ভারসাম্য রক্ষার দিকটাও এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এখন দেখার বিষয়, এতসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ড.মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার দেশকে কোন জায়গায় নিয়ে যান। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |