![]() দুদকে মামলা, অভিযোগ বাড়ছে, আছে শঙ্কাও
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
![]() সূত্র বলছে, সম্প্রতি দুদকের একটি মামলায় অভিযুক্ত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা আমিন আল পারভেজকে সংস্থাটিতেই নিয়োগ দেয়া নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। এ নিয়ে সেগুনবাগিচাসহ দুদকের বিভিন্ন জেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা গেছে। সেইসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর পক্ষ থেকেও উষ্মা প্রকাশ করা হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, সরকারের ভেতর থেকেই দুর্নীতির সুরক্ষা ও দুদককে অকার্যকর করার চেষ্টা করা হচ্ছে কি-না, এমন প্রশ্ন মোটেই অযৌক্তিক নয়। এমন একজন কর্মকর্তাকে দুদকে পরিচালক পদে নিয়োগ দিতে সরকারের প্রচেষ্টাকে পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য উল্লেখ করে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো- কোন মানদণ্ডে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে প্রেষণে দুদকেই নিয়োগ দেয়া হলো? সেটিও এমন একটি সময়ে, যখন দুদক সংস্কার কমিশন সুস্পষ্ট সুপারিশ করেছে যে, দুদকের অভ্যন্তরে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে চাকরি থেকে বহিষ্কার করে ফৌজদারি বিচারে সোপর্দ করতে হবে। এই সুপারিশের পুরোপুরি বিপরীতে গিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত একজন কর্মকর্তাকে নিয়োগের ঘটনা আসলে কী বার্তা দেয়? উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এমন মনে হওয়া অমূলক নয় যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দুদককে শক্তিশালী করার বদলে সরকারের ভেতর থেকেই দুদককে অকার্যকর করার চেষ্টা করা হচ্ছে! এদিকে ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে দুদকের কর্মকাণ্ডকে ইতিবাচক আখ্যা দিয়ে ‘ছন্দে ফিরেছে’ বলেও অনেকে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দুদকের একাধিক কর্মকর্তার রদবদল নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। সংস্থাটির সূত্রে জানা গেছে, রদবদল হওয়া অন্তত দু’জন কর্মকর্তা দায়িত্বের জায়গায় অটুট ছিলেন। সেইসঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রভাবশালীদের দুর্নীতির অনুসন্ধান করে সেসব কর্মকর্তা নিজেদের দক্ষতার প্রমাণও দিয়েছেন। কিন্তু অজানা কারণে তাদের বদলি করে ঢাকার বাইরে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নিয়ে বড় অনুসন্ধান করছেন এমন এক কর্মকর্তাকে প্রথমে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে দপ্তর থেকে সরানোর মতো ঘটনা ঘটেছে। পরে সেই কর্মকর্তাকে গণপূর্তে বদলি করা হয়। দুদক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কর্মকর্তা বদলির কারণে চলমান অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্তগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অবশ্য দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন জানিয়েছেন, সংস্থাটির প্রত্যেক কর্মকর্তাই যথেষ্ট দক্ষ। এতে কোনো প্রভাব পড়বে না। চলতি মাসেই এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মকর্তাদের বদলির বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুদকের সব কর্মকর্তাই দক্ষ। একজনের বদলির কারণে অনুসন্ধানে কোনো প্রভাব পড়ে না। আর বদলি দুদকের নিয়মিত কাজের অংশ। দুদক সূত্র জানায়, বিগত এক মাসের চেয়ে দুদকের মামলার গতি আরও বৃদ্ধি পাবে। সেইসঙ্গে মামলাগুলোর অভিযোগপত্রও আদালতে দাখিল করবে সংস্থাটি। এরই মধ্যে গত তিন মাসের দায়ের করা শতাধিক মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, দ্রুততার সঙ্গে নিখুঁতভাবে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার ব্যাপারে কমিশন গুরুত্ব আরোপ করছে। অন্যদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুদকের যে গতি বেড়েছে তা ইতিবাচক। তবে এই মামলা অনুসন্ধান তখনই কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে- যখন আদালতে গিয়ে আসামিরা সঠিকভাবে সাজা পাবেন। আর এরসবই নির্ভর করবে দুদকের কর্মকর্তাদের আন্তরিকতার ওপর। দুদক জানিয়েছে, গত পাঁচ মাসে অন্তত আট হাজারের বেশিসংখ্যক অভিযোগ জমা পড়েছে সংস্থাটির বিভিন্ন মাধ্যমে। এর মধ্যে বেশির ভাগই ঢাকার সেগুনবাগিচার প্রধান কার্যালয়ের অভিযোগকেন্দ্রে। এ ছাড়াও দেশজুড়ে সমন্বিত জেলা কার্যালয়গুলোতেও কম-বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। পাশাপাশি দুদকের হটলাইনে (১০৬) আসা অভিযোগগুলো নিয়েও বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করছে সংস্থাটির এনফোর্সমেন্ট ইউনিট। অবশ্য আভিযানিক এই দলটি লিখিত অভিযোগও আমলে নিয়ে অভিযানে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সংস্থাটির একাধিক সূত্র জানাচ্ছে, গত ৫ মাসে জমা পড়া ৮ হাজার ৬২৩টি অভিযোগের মধ্যে ১ হাজার ৩৬৯টিই আমলে নিয়ে প্রধান কার্যালয় থেকে অনুসন্ধান করছে দুদক। এর মধ্যে সংস্থাটির তফসিলভুক্ত অপরাধ না হওয়ায় ৬ হাজার ৭৬৭টি অভিযোগ আমলে নেয়া হয়নি। তবে ৪৯৫টি অভিযোগ বিভিন্ন দপ্তরে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে সারা বছরেই মাত্র ৮৪৫ অভিযোগ আমলে নিয়েছে তৎকালীন মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ কমিশন। সে বছর মামলা হয়েছে মাত্র ৪০৪টি। তার বিপরীতে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর ড. আবদুল মোমেন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পরপর সহস্রাধিক অভিযোগ অনুসন্ধান আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে। আর সর্বশেষ দেড়মাসেই একশ’টির বেশি মামলা করেছে বর্তমান কমিশন। অন্যদিকে ২০২২ সালে ১৯ হাজারের বেশি অভিযোগের মধ্যে অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেয়া হয়েছিল ৯০১টি। আর সে বছর মামলা হয় ৪০৬টি। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, ১৪ হাজার ৭৮৯টি অভিযোগের মধ্যে আমলে নেয়া হয় ৫৩৩টি। আর সে বছর মামলা দায়ের করা হয় ৩৪৭টি। ২০২০ সালের হিসাবেও অনেক কম অভিযোগ আমলে নেয়া হয়। বছরটিতে অভিযোগ আসে ১৮ হাজার ৪৮৯টি। আর আমলে নেয়া হয় ৮২২টি। এ সময় মামলা দায়ের হয় মাত্র ৩৪৮টি। দুদক সূত্রে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রতিদিন গড়ে দুইশ’র বেশিসংখ্যক অভিযোগ জমা পড়ছে সংস্থাটির বিভিন্ন দপ্তরে। এর মধ্যে রাজধানীর সেগুনবাগিচার প্রধান কার্যালয়ে চেয়ারম্যানের বরাবর আসা অভিযোগের সংখ্যাই বেশি। এ ছাড়া দুদকের হটলাইনসহ (১০৬) বিভিন্ন সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে প্রতিদিন অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়ছে। দুদুকের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, আগস্ট মাস থেকে সহস্রাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। যা নজিরবিহীন। এ যাবৎকালে এত অভিযোগ জমা পড়তে দেখা যায়নি। আর সে অনুপাতে অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেয়ার সংখ্যাটাও অনেক। এসব অভিযোগের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে। বর্তমানে দুদকের যাচাই-বাছাই কমিটিতে (যাবাক) সাড়ে তিন হাজারের বেশি অভিযোগ জমা রয়েছে। যা যাচাই-বাছাইয়ের পর সিদ্ধান্ত নেবে দুদক। এদিকে এসব অনুসন্ধান ও মামলা পরিচালনা নিয়ে বেশ কিছু জটিলতায় পড়েছেন অনেক কর্মকর্তা। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দুদক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, একদিকে বিপুলসংখ্যক অনুসন্ধান, অন্যদিকে মামলার তদন্ত কার্যক্রম। দুই মিলিয়ে কর্মকর্তারা চাপে পড়েছেন। কমিশনের পক্ষ থেকে তোড়জোড় করে মামলা দায়েরের নির্দেশনা থাকায় সেই নির্দেশ মানা হচ্ছে। কিন্তু অনেক মামলা দ্রুত করতে গিয়েও ভুলভ্রান্তি থেকে যায়। ফলে আইনের ফাঁক-ফোকরে আসামিরা আদালতে গিয়ে কোনো না কোনোভাবে পার পেয়ে যান। দুদক কর্মকর্তাদের মতে, একটি অনুসন্ধান যত গভীরে গিয়ে করা যায় ততই মামলা তদন্তের জন্য ভালো হয়। এতে ভুলভ্রান্তি কম থাকে। ফলে আদালতে গিয়ে মামলার সাজাও সহজে নিশ্চিত করতে পারে দুদক। এ বিষয়ে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম বলেন, দুদকের কাজের গতি বেড়েছে। এটা নিশ্চয়ই ভালো দিক। আগে যেভাবে অনুসন্ধান তদন্ত হতো সেটা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। তিনি আরও বলেন, শুধু মামলার চার্জশিট দিলেই হবে না। আইনজীবীদের দিকেও নজর দিতে হবে। সাজার হার নিশ্চিতে সমন্বয় করতে হবে। এ ছাড়া দুদকের কর্মকর্তাদের আন্তরিকতাও নির্ভর করবে বলে মনে করেন সাবেক এই মহাপরিচালক। |