![]() ন্যায় ও জনকল্যাণই রাজনীতির ভিত্তি
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() বাঙালি জাতির ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সাহসী তরুণদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরবর্তী সময়েও নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয়েছে। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সর্বশেষ চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে তরুণরাই। বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলন রূপ নেয় গণ-আন্দোলনে। যার ফলাফল স্বৈরাচারের পতন এবং নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের সুযোগ এসেছে। পরিসংখ্যান মতে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ তরুণ। ফলে আগামীর বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি-সবই নির্ভর করছে তরুণসমাজের ওপর। তারুণ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে গড়ে তুলতে হবে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ। যেকোন জাতির মেরুদণ্ড হলো শিক্ষা। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা দরকার। মুখস্থ ও চাকরিনির্ভর পড়াশোনা থেকে বেরিয়ে এসে বুদ্ধিদীপ্ত, সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে। নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে মনোযোগ দিতে হবে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায়। প্রণোদনা বাড়াতে হবে গবেষণা খাতে। আগামীর বাংলাদেশের সমাজ হতে হবে পুরোপুরি জ্ঞানভিত্তিক ও তথ্যভিত্তিক। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তৈরিতে এগিয়ে আসতে হবে তরুণদের। আগামীর বাংলাদেশ হবে মাদকমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত এবং লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতিমুক্ত। বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস। ফলে জনগণের জন্য হবে সংবিধান; সংবিধানের জন্য জনগণ নয়। সমতার ভিত্তিতে একটি প্রগতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে একটি স্বচ্ছ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যার মূলে থাকবে জনগণের কল্যাণ। সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে হবে সুধীসমাজকে। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। সুশাসন প্রতিষ্ঠাসহ সামাজিক সমস্যা সমাধান এবং জনমত সংহত করার ভূমিকা পালন করতে হবে সুধীসমাজকে। আগামীর বাংলাদেশ হতে হবে সবার জন্য নিরাপদ। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর দ্রুত সমাধানে কাজ করতে হবে। দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। আগামী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো দল বা ব্যক্তির হস্তক্ষেপ হতে দেওয়া যাবে না। সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। আগামীর বাংলাদেশে জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। ভোট প্রয়োগের অধিকার জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের হাতিয়ার। ফলে নাগরিকের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন হতে হবে ইতিবাচক। এর গুণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিদ্যমান সংবিধানে পরিবর্তন প্রয়োজন, যেন সংবিধান ব্যবহার করে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সুযোগ না থাকে। সংবিধানকে শুধু জনগণের করে তুলতে হবে, যেখানে থাকবে শুধুই জনগণের কল্যাণ। ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে সংবিধান সংস্কারের বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতা এমনভাবে বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা করতে হবে, যেন ক্ষমতা এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত না থাকে। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নজর দেওয়া প্রয়োজন। রাজস্বনীতি, করনীতি, ব্যাংকিং খাত থেকে শুরু করে শিল্পায়নের ক্ষেত্রেও সংস্কার প্রযোজন। পোশাকশিল্পের বাজার সম্প্রসারণ এবং দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আয়ের পথ উন্মুক্ত রাখতে হবে। দেশের বিপুল জনসংখ্যাকে প্রযুক্তিতে দক্ষ করে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রা মাথায় রেখে দারিদ্র্যমুক্ত, বৈষম্যহীন দেশ গড়ে তুলতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনকে বিবেচনায় রেখে পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। আগামীর বাংলাদেশ হবে শান্তি ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ। আগামীর বাংলাদেশে থাকবে না কোনো অসাম্য ও বৈষম্য, যেখানে প্রত্যেক মানুষ তার মৌলিক অধিকার তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ পাবে। প্রত্যেকে তার উদ্ভাবনী শক্তি ও সৃজনশীলতা দিয়ে দেশ গঠনে অবদান রাখবে। তরুণ প্রজন্মের বর্তমান রাজনীতির প্রতি একটা অনীহা কাজ করে। যেখানে আজকের তরুণরা নেতৃত্ব দানের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে তরুণদের মাঝে তৈরি হয়েছে রাজনীতির প্রতি এক ধরনের অনীহা। তার কারণ কী? কারণ দেশের রাজনীতির প্রতিটি ক্ষেত্র দুর্নীতি এবং সহিংসতা আচ্ছাদিত করে রেখেছে, যা তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করছে। রাজনীতিতে থাকে সেবা। যেটার মধ্য দিয়ে উপকৃত হবে জাতি। তবে সেবার কথা রাজনীতিবিদদের মাথায় থাকে তখনই, যখন নির্বাচনে দাঁড়ানো বা জয়ী হওয়ার প্রশ্ন আসে। এরপর সেবা নামের শব্দ তাদের মাথায় আর থাকে না। সেবার পরিবর্তে সাধারণ মানুষের ওপর পেশিশক্তি খাটিয়ে করা হয় অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম। রাজনীতি হলো বিলিয়ে দেওয়ার জায়গা। কিন্তু কজন রাজনীতিবিদ দেশ ও জাতির জন্য ত্যাগ স্বীকার করছেন? রাজনীতিকে ত্যাগ-তিতিক্ষার জায়গায় বানানো হয়েছে ব্যবসার জায়গা। যেটা করে বাড়ি-গাড়ির মালিক হওয়া যায় এবং তারা সেসব অর্জনের জন্যেই রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছে। আদর্শভিত্তিক রাজনীতি, সুশাসন ও দেশের উন্নয়ন হাত ধরাধরি করে চলে। আদর্শচ্যুত রাজনীতি সমাজ বা রাষ্ট্রকে কিছুই দিতে পারে না। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, অর্থ ও পেশিশক্তির প্রভাবে আদর্শ, জনকল্যাণ, আত্মত্যাগ ও নৈতিকতা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের পথ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। রাজনীতি করতে হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শহীদ জিয়াউর রহমানের আদর্শকে ধারণ করে। যারা সবসময় রাজনীতির মধ্য দিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণের কথা চিন্তা করেছেন। সততা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সঙ্গে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করলে মানুুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করা যায়। মানুষ তাদের প্রিয় নেতা হিসেবে মৃত্যুর পরেও স্মরণ করে। যদি সততা, নিষ্ঠা, আদর্শ মনে ধারণ করে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া না যায়, তাহলে দেশ আগামীতে হারাবে সঠিক নেতৃত্ব। অসহায় হয়ে পড়বে সাধারণ মানুষ। পিছিয়ে পড়বে দেশ। বাংলাদেশ আসলে কোন পথে যাবে? এই জিজ্ঞাসা স্বাভাবিক। তার চেয়েও জরুরি আমাদের অন্ধকারত্ব আর পরাধীনতার চিহ্নগুলো মুছে দেওয়া। আগামী দিনের বাংলাদেশ মূলত তারুণ্যের ওপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞান, মানবিকতা আর বিশ্বাস-এই তিন বিষয় হাত ধরাধরি করে না চললে আমরা এগোতে পারব না।অভ্যন্তরীণ ঝগড়া-ফ্যাসাদ আর অনৈক্য দূরীভূত করা এখন জরুরি। বাংলাদেশকে আমরা আমাদের মনের মতো করে সাজাতে হলে সব ভেদাভেদ ভুলে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অমীমাংসিত সব বিষয়ে মতভেদ দূর করে যদি নিজেদের একক ও একমাত্র বাংলাদেশি পরিচয়ে সতেজ রাখা যায়, তাহলেই তা সম্ভব। তারুণ্য উজ্জ্বল বাংলাদেশ এখন এক নতুন পথের সন্ধানে। সে পথ ও মত কী বা কতটা, তার প্রমাণ সময়ই বলে দেবে। আপাতত আমরা এটা দেখছি, বাংলাদেশ ও তার ইতিহাস আর যা-ই মানুক, একক কোনো কিছু মানে না। এককের নামে যেকোনো দানবই আমাদের দেশে পরাজিত হয়েছে। কারণ, এই মাটি আর জাতির চরিত্রে একক দৈত্য বা দানবের জায়গা নেই। অতিকায় কিছু নয়, সাধারণ মানুষের মনের কথা বুঝলেই বাংলাদেশকে জানা সম্ভব। বাংলাদেশ সব সময় একটি মায়াময় সমাজের দেশ। বাইরে থেকে যত ইন্ধন আর উসকানি থাক না কেন, মানুষ ভুল করে না। এই মানুষ বা জাতির স্বপ্ন আর আশা বাস্তবায়ন করা গেলেই ঝলমল করে উঠবে বাংলাদেশ। এই উদীয়মান বাংলাদেশকে সময়ের হাতে ছেড়ে দিলে আমাদের জাতি এগোতে পারবে না। আশপাশে তাকালে দেখব, অন্য দেশগুলো তরতর করে এগিয়ে চলেছে। অনেক সময় পরিসংখ্যান আমাদের হয়ে কথা বললেও মূল সমস্যা অন্যত্র। মনে রাখতে হবে, পরিসংখ্যান বা সমস্ত উপাত্তকে পিছে ফেলে এখন পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের পরিস্থিতি ভয়াবহ। কেন ভয়াবহ? তারা পরিশ্রমী, মেধাবী হলেও তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন আগামীর কারণ রাজনীতি। রাজনীতি ও নেতৃত্ব দূরদৃষ্টি সম্পন্ন না হলে কোনো জাতি এগোতে পারে না। তার প্রমাণ উপমহাদেশের এই দুই দেশ। অন্যদিকে নানাভাবে পিছিয়ে থাকলেও নেপাল বা শ্রীলঙ্কার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। শ্রীলঙ্কা তাদের সর্বনাশের রাত কাটিয়ে এখন আবার জয়রথে। সম্প্রতি তাদের মূল্যস্ফীতি নেমে গেছে শূন্যের কোঠায়। এটা কোনো ম্যাজিক না, এমন উজ্জ্বল উদাহরণ তখনই সম্ভব যখন জাতি সবকিছু বাদ দিয়ে দেশ গঠনে এক থাকে। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |