![]() গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী তরুণ নেতৃত্ব ও নাগরিক প্রত্যাশা
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() চব্বিশের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের নেতৃত্বেই গড়ে উঠেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এই তরুণরা চব্বিশের পাঁচ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, তারা রাজনৈতিক দল গড়ার মধ্য দিয়ে আরেক অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে। তরুণ নেতৃত্বের ডাকে সাড়া দিয়ে যেভাবে গত বছর সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল, তার ফলেই দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটে। এ কারণেই তরুণদের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি সে আস্থা কাজে লাগিয়ে কতটা রাজনীতি করতে পারবে; ভোটের মাঠের জটিল হিসাবে দলটি কতটা চমক আনতে পারবে, নিঃসন্দেহে তা দেখার বিষয়। মানুষের কাছে দলটি কতটা পৌঁছতে পারবে এবং মানুষকে তাদের এজেন্ডা কতটা বোঝাতে পারবে। দলটি যে বাংলাদেশ পন্থার কথা বলছে, সেটি নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের মানুষের ভাগ্য দেশের নাগরিকরাই নির্ধারণ করবে। নাগরিকদের দ্বারা এবং নাগরিকদের জন্যই বিশেষ করে যে রাজনীতি, তা দেশের মানুষকে জাতীয় নাগরিক পার্টি বোঝাতে পারলে জনভিত্তি তৈরি করাও সহজ হবে। দেশের জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ তরুণ। এ তারুণ্য আজ নানাবিধ সংকটে জর্জরিত। তরুণদের নেতৃত্বাধীন নাগরিক পার্টির এ বাস্তবতা ভালোই বোঝার কথা। সে জন্য তরুণদের অগ্রাধিকার দিয়ে বিশেষ কর্মসূচি দলটির থাকতেই হবে। তারুণ্যের বেকারত্ব আমাদের বড় সমস্যা। জাতীয় নাগরিক পার্টির তরুণ নেতৃত্বকে বেকারত্ব ঘোচাতে অভিনব ও বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ নিতে হবে। অবশ্য কেবল তরুণদের জন্যই নয়, সব শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের জন্যও দলটির কর্মসূচি থাকতে হবে। জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখার কারণেই দলটির প্রতি মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। দুই হাজার আঠারো সালে তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ ছাত্র অবস্থায় নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে অংশ নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। একই বছরেই তারা কোটা সংস্কারের সফল আন্দোলন করেছিল। দুই হাজার চব্বিশে এসে কোটা সংস্কার দিয়ে শুরু হওয়া তাদের আন্দোলন সরকার পতন পর্যন্ত গড়ায়। বিগত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের পরও যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হয়নি, সেখানে তারুণ্য অল্প দিনেই আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে যে তরুণ সমাজ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে; বিগত সরকার নির্দয়ভাবে তাদের অনেককে হত্যা করে। অন্তত দেড় হাজার শহীদের কথা আমরা জানি। তাদের রক্তের ওপরেও দাঁড়িয়ে আছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। সে জন্য প্রতিটি পদক্ষেপে শহীদদের আত্মত্যাগ তাদের স্মরণে রাখতে হবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার হওয়ার পরও জনপ্রত্যাশা পূরণের সরকার সে অর্থে দেখা যায়নি। জাতীয় নাগরিক কমিটি সেই স্থান পূরণ করতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ এতটা সহজ নয়। তা ভেবেই পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদ্যমান রাজনৈতিক দলের বিপরীতে নাগরিক পার্টি কী বার্তা নিয়ে হাজির হচ্ছে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ।প্রচলিত ধারার রাজনীতিতে নেতাদের চাঁদাবাজি, দখল, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখা যায়। জাতীয় নাগরিক পার্টির তৃণমূল হতে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মীকে এ ধরনের অন্যায়ে যুক্ত হওয়া যাবে না। জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতৃত্বে এসেছেন চিকিৎসক, আইনজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সরকারের উপদেষ্টা থেকে পদত্যাগ করে এসেছেন। অন্যান্য নেতৃত্বকেও মানুষ দীর্ঘ সময় না হলেও অনেক দিন ধরেই দেখে আসছেন। তারা অন্যায়ের কাছে আপসহীন হবেন এটাই প্রত্যাশা। মনে রাখতে হবে, রাজনীতির পথ খুব সহজ নয়। এখানে সাফল্য পেতে দীর্ঘ সাধনা প্রয়োজন, যেখানে জেল-জুলুম-নির্যাতনের শঙ্কা নিত্যসঙ্গী। যারা রাজনীতি করেন, এটা ঘোষণা দিয়েই করেন-তারা দেশ ও দশের সেবা করতে চান। তাদের কাছে যেন নিজের উন্নতির চেয়ে দেশের উন্নতিই মুখ্য। তার ক্ষমতা পাওয়ার মূলেও রয়েছে দেশ আর সবার গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা। দিনশেষে জনগণের কাছে জবাবদিহির মানসিকতাও রাজনীতিকদের থাকা জরুরি। চব্বিশের জুলাই আগস্ট গণঅভ্যুত্থান বড় সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। দেশের অনেক জায়গায় সংস্কার প্রয়োজন। অভ্যুত্থানের পর সে জন্যই সংস্কারের আলোচনা প্রধান হয়ে উঠেছে। নাগরিক কমিটির মতো অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারীদের দলের মাধ্যমেই সে সংস্কার বাস্তবায়ন হতে পারে। বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে যে তরুণরা একদিন আন্দোলনে নেমেছে, আজ তারাই অভ্যুত্থানের মতো সাফল্য এনে দিয়ে দেশ গড়ার লক্ষ্যে রাজনীতিতে নিয়োজিত। সুতরাং দেশকে বৈষম্যমুক্ত করতে হবে। দেশের তরুণদের জন্য গতানুগতিক সিদ্ধান্ত না নিয়ে, তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান নিয়ে গবেষণা করেই পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বৈষম্যহীন সমাজ রূপান্তরের জন্য যে অর্থনৈতিক কর্মসূচি প্রয়োজন তার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমতাবাদী করার উদ্যোগ নিতে হবে। জনক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সর্বক্ষেত্রে জনগণের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়। কেবল আইন ও নীতির পরিবর্তন নয়, বরং প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে এমন প্রতিষ্ঠান গঠন করতে হবে যাতে জনসাধারণের অংশগ্রহণমূলক শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার প্রসার ও স্বাস্থ্যসেবার সমতা না থাকলে সামাজিক বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়। বিশেষত গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ও শহরের সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণীর জন্য উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। উচ্চশিক্ষায় প্রবেশাধিকারকে আরো গণতান্ত্রিক করা প্রয়োজন, যাতে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে না পড়ে। একই সঙ্গে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবাকে মানুষের অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে শ্রেণীভেদ দূর হয়। রাজস্ব আহরণের কাঠামোতে বৈষম্য দূর করতে হবে। ধনীদের ওপর আনুপাতিক হারে কর আরোপ এবং গরিবদের জন্য কর রেয়াত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। রাজস্ব ব্যবস্থায় বৈষম্য থাকলে সমাজে আয়বৈষম্য বাড়বে এবং ধনী-গরিবের ব্যবধান আরো গভীর হবে। নতুন রাজনৈতিক দলকে রাষ্ট্র পরিচালনায় তার রাজস্ব নীতিকে বৈষম্য নিরসনের হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। স্থানীয় সরকারের ব্যাপক ক্ষমতায়ন করা প্রয়োজন। কারণ গ্রামীণ ও প্রান্তিক মানুষের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের কাঠামো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শক্তিশালী স্থানীয় সরকারের অনুপস্থিতিতে ও জাতীয় সরকারের প্রাধান্যের কারণে বিভিন্ন অঞ্চলের উন্নয়ন অসমভাবে ঘটে। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করলে স্থানীয় জনগণের চাহিদা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হবে। নতুন রাজনৈতিক দলকে বাজেট বরাদ্দ থেকে শুরু করে নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা বৃদ্ধি করার নীতি প্রণয়ন করতে হবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়েছে কর্মসংস্থানকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের বৃহত্তর যুবসমাজের জন্য যথাযথ ও মানসম্মত কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা ব্যতীত বাংলাদেশ সামনে এগোবে না। নতুন অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে শিল্পায়ন, কৃষি ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে বিকশিত করে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বেকারত্ব দূর না হলে সামাজিক বৈষম্য আরো প্রকট হবে। এক্ষেত্রে বৃহৎ শিল্পে অর্থায়নের পলিসি পরিবর্তন করে দেশে স্বল্প মূলধনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতে অর্থায়নের মাধ্যমে শিল্প সম্প্রসারণ করে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা ন্যায্য পারিশ্রমিক পায়। স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক সুরক্ষা ও বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করা জরুরি। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রান্তিক মানুষ ও বিশেষত নারী ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত ও নাজুক হয়। টেকসই উন্নয়নের জন্য পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে হবে। জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির উৎস ব্যবহার বাড়াতে পলিসি গ্রহণ করতে হবে। কৃষি খাত আধুনিকায়ন ও তরুণ প্রজন্মকে কৃষি উৎপাদনে উৎসাহী করার পলিসি গ্রহণ করতে হবে। নতুন উদ্যোক্তাদের উৎপাদন পরিচালনার জন্য সাংগঠনিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সাংগঠনিক সক্ষমতার জন্য তাদের উন্নত ও দক্ষ শিল্পায়িত দেশগুলোয় প্রয়োজন হলে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বশেষ নতুন অর্থনৈতিক কর্মসূচি গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করা ভিন্ন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলের অর্থায়নে স্বচ্ছতা, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র এবং নাগরিক অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত হলে সুশাসনে সহায়ক হবে।বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের জন্য কেবল রাজনৈতিক সংকল্পই যথেষ্ট নয় বরং কার্যকর নীতিমালা ও পরিকল্পনা প্রয়োজন। রাষ্ট্রযন্ত্রের কাঠামোগত পরিবর্তন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাস এবং জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া এ রূপান্তর সম্ভব নয়। বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সব শ্রেণীর মানুষের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |