![]() অধিকাংশ দোকানেই নেই বোতলজাত তেল
ডিসির হুঁশিয়ারিতেও কাটেনি বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট
দু-একটি দোকানে মিললেও কিনতে হচ্ছে বেশি দামে
নতুন বার্তা, চট্টগ্রাম:
|
![]() গত ৪ মার্চ চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত সভায় জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বলেন, ‘আমি দেখতে চাই, রাষ্ট্রের শক্তি বেশি না ব্যবসায়ীদের শক্তি। তেলের সাপ্লাাই যদি পর্যাপ্ত না হয়, তবে গুদাম পর্যায়ে অভিযান চালানো হবে। কীভাবে ভোক্তা তেল পাবে, সেই ব্যবস্থা করুন। না হয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা নেবে। আর কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। আমি এবার শুধু জরিমানা করবো না, কারাদণ্ডও দেবো। বড় গ্রুপগুলোর কোনো কর্মকর্তাকে অনিয়মে সম্পৃক্ততা পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। আমাদের সঙ্গে ছাত্র সমন্বয়করাও থাকবেন। দেখি কার শক্তি বেশি।’ ডিসির এ হুঁশিয়ারির চারদিন পেরিয়ে গেলেও বাজারে স্বাভাবিক হয়নি বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ। কোথাও বেশি দামে দু-এক বোতল মিললেও অধিকাংশ জায়গায় মিলছে না। বোতলের গায়ে লেখা সর্বোচ্চ দামে সয়াবিন তেল কিনতে খুচরা বিক্রেতাদের বাধ্য করছেন ডিলাররা। একই কোম্পানির অপ্রচলিত অন্য পণ্য কিনতেও বাধ্য করা হচ্ছে। শনিবার (৮ মার্চ) দুপুরে নগরীর বড় খুচরা বাজার বহদ্দারহাট, চকবাজার এবং কাজীর দেউড়ি এলাকার মুদি দোকানগুলোতে সরেজমিনে এ তথ্য মিলেছে। খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, হুঁশিয়ারির পরেও জেলা প্রশাসককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মিলার এবং ডিলাররা স্বাভাবিকভাবে বোতলজাত সয়াবিন সরবরাহ দিচ্ছেন না। ফলে বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট রয়েই গেছে। সংখ্যায় কম হলেও অনেকে বেশি দামেও বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি করছেন। কাজীর দেউড়ি সিডিএ মার্কেটের সাদিয়া ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিক শামসুল আলম বলেন, ‘ডিলাররা কিছু কিছু পাম অয়েল দিচ্ছে। কিন্তু সয়াবিন তেল দিচ্ছেন না। পাম অয়েলও পর্যাপ্ত দিচ্ছে না। দু-এক কার্টন দিচ্ছে। কিছুদিন আগে ডিলাররা সয়াবিন তেল কিছু কিছু দিলেও এখন একেবারেই দিচ্ছে না।’ পাশের ভাই ভাই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিক শংকর বাবু বলেন, ‘ডিলাররা চাহিদামাফিক বোতলজাত সয়াবিন তেল দিচ্ছেন না। এখন অল্পসংখ্যক তেল দিচ্ছেন। আমাদের দু-একটা এক লিটারের বোতল আছে। এগুলো আমাদের নিয়মিত ক্রেতাদের দেওয়ার জন্য রেখেছি।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক মুদি দোকানি বলেন, ‘জেলা প্রশাসন শুধু হুমকি-ধামকি দেয়। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। শুধু খুচরা পর্যায়ে দোকানগুলোতে লোক দেখানো মোবাইল কোর্ট চালানো হচ্ছে। সঙ্গে মিডিয়া নিয়ে এসে প্রচার করা হচ্ছে। প্রশাসন কিন্তু ডিলার এবং মিলারদের গুদামে যাচ্ছে না। ওখানে মিডিয়া নিয়ে প্রশাসন অভিযান চালালে আসল চিত্র দেখা যাবে, সংকট খুচরা পর্যায়ে নাকি ডিলার মিলার পর্যায়ে।’ নগরীর ব্যস্ততম বহদ্দারহাট বাজারে দেখা যায় পাঁচমিশালি চিত্র। বাজারে প্রবেশ করতেই নিউ হাসমত স্টোরে সয়াবিন তেল মিলছে। তবে বেশি দামে। দোকানদার মো. আজিজ বলেন, ‘আমাদের মূল ডিলাররা কোনো সয়াবিন তেল দিচ্ছেন না। নিয়মিত গ্রাহকদের দেওয়ার জন্য বাইরে থেকে বেশি দামে কিনে এনেছি। আমাদের এখানে পাঁচ লিটার বোতল ৯৬০ টাকা এবং দুই লিটার বোতল ৩৮০ টাকায় বিক্রি করছি।’ তিনি বলেন, ‘আগে ডিলাররা আমাদের দোকানে এসে সয়াবিন তেল সরবরাহ দিয়ে যেতেন। এখন আমাদের গাড়ি ভাড়া খরচ করে নগদ টাকায় সয়াবিন তেল সংগ্রহ করে আনতে হচ্ছে।’ পাশের ফরিদ স্টোরের মো. ফরিদ বলেন, ‘আমার দোকানে মাত্র তিনটি তিন লিটারের স্টারশিপ সয়াবিন রয়েছে। এগুলো বোতলের গায়ে লেখা ৫২৫ টাকা দামেই বিক্রি করছি। ৫২৫ টাকার তেল বিক্রি করে ৫ টাকা লাভ হবে। কিন্তু এখানে প্রতিদিন অভিযানের নামে হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে।’ বাজারের আরেক দোকানি ব্রাদার্স জেনারেল স্টোরের মালিক ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমার দোকানে কোনো সয়াবিন তেল নেই। পলিব্যাগের কিছু তেল ছিল, সেগুলো বিক্রির পর এখন আর নেই। এখন কোম্পানির এসআর আসছে না, ডিলাররাও মাল (সয়াবিন তেল) দিচ্ছেন না। সয়াবিন তেল না থাকাতে অন্য পণ্য বিক্রিও কম হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন আগে রূপচাঁদা তেল নিয়েছি। দুই লিটার, এক লিটার তেলের সঙ্গে বাধ্যতামূলক দুই কার্টন সরিষার তেল দিয়েছে। এখন সরিষার তেলগুলো বিক্রি হচ্ছে না। আগে সয়াবিন তেলের সঙ্গে চা-পাতা দিয়েছিল, সেগুলোও এখনো বিক্রি হয়নি। এতে আমার মূলধন আটকে আছে।’ পাশের নিলয় এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী পারভেজ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের কাছে বোতলজাত সয়াবিন তেল নেই। একদিন আগে স্টারশিপ ব্র্যান্ডের এসআর থেকে তিন লিটারের কয়েক বোতল তেল নিয়েছি। তারা বোতলের গায়ে লেখা ৫২৫ টাকা দাম আমাদের কাছ থেকে নিয়েছে। সয়াবিন তেলের সঙ্গে একই কোম্পানির অন্য পণ্য নিলেই তারা তেলের দাম কম নেয়। নতুবা তেলই দিচ্ছে না।’ দোকানিরা বলছেন, দেশে মাত্র গুটিকয়েক মিলার সয়াবিন তেল বোতলজাত করেন। তাদের কারখানায় দিনে কী পরিমাণ তেল বোতলজাত হয় এবং প্রতিদিন প্রত্যেক কোম্পানি তাদের ডিলার ডিস্ট্রিবিউটরদের কী পরিমাণ বোতলজাত সয়াবিন তেল সরবরাহ দিচ্ছে মন্ত্রণালয় চাইলেই ওই তালিকা নিয়ে প্রতিদিন মন্ত্রণালয় কিংবা ভোক্তা অধিদপ্তরের অনলাইনে প্রকাশ করতে পারে। তাহলে কোন ডিলার প্রতিদিন কী পরিমাণ তেল পাচ্ছে তার একটি চিত্র দেশের লোকজন পেতো। স্থানীয় প্রশাসনও ডিলারদের কাছ থেকে বোতলজাত সয়াবিন সরবরাহ তদারকি নিশ্চিত করতে পারতেন। এখন জেলা প্রশাসন থেকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় ব্যবসায়ীদের। কিন্তু বড় ব্যবসায়ীরা জেলা প্রশাসনকে কোনো কর্ণপাতই করেন না। অভিযানের নামে যা হচ্ছে, সবই আইওয়াশ। রমজান শুরুর আগে থেকেই বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট তৈরি হয়। মূলত মিলার কোম্পানিগুলো বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে বলে দাবি ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলোর। বোতলজাত সয়াবিন তেলের বাজারে সংকট তৈরি হওয়ায় সুযোগ নিচ্ছে অসাধু মুদি দোকানিরা। অভিযোগ উঠেছে, বোতলজাত সয়াবিন খুলে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এ নিয়ে চট্টগ্রামের বাজারে খোলা তেলের দাম নির্ধারণ করে দেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। কিন্তু গত ডিসেম্বর মাসেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর খোলা সয়াবিন তেলের দাম প্রতিলিটার ১৫৭ টাকা নির্ধারণ করে দেয় মিলাররা। কিন্তু গত ৪ মার্চ চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে সেই দাম লিটারে ৩ টাকা বাড়িয়ে খুচরা পর্যায়ে খোলা তেলের দাম লিটার ১৬০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ১০ এপ্রিল পর্যন্ত আমদানিকারকেরা ১৫৩ টাকা দরে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করবেন। পাইকারি পর্যায়ে তা ১৫৫ এবং খুচরা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ১৬০ টাকা বিক্রি করা যাবে। এদিকে জেলা প্রশাসক গুদাম পর্যায়ে অভিযান চালানোর যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, চারদিনেও এমন অভিযানের খবর মেলেনি। এই কয়েকদিনে নগরীর খুচরা বাজারগুলোতে অভিযান সীমাবদ্ধ রেখেছে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতগুলো। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগ নেবেই। জেলা প্রশাসক ওইদিন হুংকার দিলেন, সয়াবিন তেলের সংকট না কাটলে গুদামে অভিযান চালাবেন। কিন্তু পরের দিন একজন সহকারী কমিশনারকে দিয়ে চকবাজারে মুদি দোকানে অভিযান চালালেন। অভিযানে একটি দোকানকে ৫শ টাকা জরিমানা করলেন। ক্যাব সদস্যরা যখন বিষয়টি সহকারী কমিশনারের কাছে জানতে চাইলেন, তখন তিনি বললেন দুই হাজার টাকার বেশি জরিমানা না করার নির্দেশনা আছে। এই সুযোগটাই ব্যবসায়ীরা নিচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের হুঁশিয়ারিতে কাজ হচ্ছে না, এটা সঠিক নয়। মূলত জেলা প্রশাসন ঘোষণা দিয়ে ঘোষণার বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এটি প্রশাসনের দুর্বলতা। ব্যবসায়ীরা তো দেখছেন জেলা প্রশাসন শুধু ঘোষণা আর হুংকারে সীমাবদ্ধ। যে কারণে সুফল মিলছে না। ফলে বাজারে বোতলজাত সয়াবিনের সংকট কাটছে না।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বলেন, ‘আমরা খুচরা বাজারে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। কিছু স্থানে বেশি দাম নেওয়ার অভিযোগ পাচ্ছি।’ তবে বাজারে ডিলারদের কাছ থেকে খুচরা মুদি দোকানিরা সয়াবিন তেল পাচ্ছেন না- এমন অভিযোগের বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমি রোববার আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিংয়ের কারণে অভিযান চালাতে পারবো না। সোমবার থেকে অভিযানে নামবো। আমি চট্টগ্রামে টিকে এবং সিটি গ্রুপের সঙ্গে কথা বলেছি। এখন খুচরা বাজারে আর অভিযান চালাবো না। মিলার ও ডিলারদের গুদামে অভিযান চালাবো। এ তথ্য ক্লিয়ার।’ |