![]() জানমালের সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বড় চ্যালেঞ্জ
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() কিন্তু কার্যত এদিকটি যেন উপেক্ষিতই রয়ে গেছে।বিদায়ী সরকারের শাসনামলে দেশের অর্থনীতি নানা সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর অনাস্থা, সঠিক নির্বাচন প্রক্রিয়া না থাকা, জনমনে অস্থিরতা, একই সঙ্গে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাব ছিল প্রকট। দুই দফায় শেয়ারবাজার কারসাজির পাশাপাশি ব্যাংক থেকে টাকা হ্যাকিংয়ের মতো ঘটনা- গুলো আর্থিক খাতের অস্থিরতা প্রকাশ করেছে। এছাড়া নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে। ডাল, তেল, চাল, পেঁয়াজ, মাছ, মাংসের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে ২০২৩ সালে মূল্যস্ফীতির হার গড়ে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। যদিও এ অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে উঠে এসেছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে ১০ দশমিক ৭২ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ডিসেম্বরে ছিল ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ। তবে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি জানুয়ারিতে সামান্য বেড়ে ৯ দশমিক ৩২ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ডিসেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য এ পরিস্থিতি অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠেছে। বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, মজুদদারি ও চোরাচালানের মতো সমস্যাগুলো এখনো বিদ্যমান। অন্তর্বর্তী সরকারকে এ সমস্যা সমাধানে বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে এবং মজুদদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি দেশের অর্থনীতির একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের রাজস্ব আদায়ের হার জিডিপির মাত্র ১০ শতাংশের কাছাকাছি, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অত্যন্ত কম। কর ফাঁকি, অবৈধ অর্থপ্রবাহ ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।ফলে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে বাধার সৃষ্টি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য কর প্রশাসন সংস্কার, ডিজিটালাইজেশন ও কর ফাঁকি রোধে কঠোর নীতি গ্রহণ করা অপরিহার্য। বিনিয়োগ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাবিকাঠি। কিন্তু গত কয়েক বছরে দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ আশানুরূপ বাড়েনি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত ৩০ দশমিক ৯৮ শতাংশ ছিল, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের ৩০ দশমিক ৯৫ শতাংশ থেকে সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অপর্যাপ্ত। স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি,আমলা তান্ত্রিক জটিলতা ও অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে বিনিয়োগে অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে রফতানিমুখী শিল্প ও তৈরি পোশাক খাতে নতুন বিনিয়োগ কমে গেছে। তাই বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করার পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। কর্মসংস্থানের অভাব বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন এবং শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৩ অনুযায়ী, দেশের মোট বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ। তবে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি,যা ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি খাতে নতুন চাকরির সুযোগ সীমিত হওয়ায় যুবসমাজের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। সময় এসেছে স্কিল বেজড ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামে পরিবর্তন আনার এবং কর্মমুখী ও প্রশিক্ষণমুখী পাঠদান কার্যক্রম চালু করার। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতের সঙ্গে সমন্বয় করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কার্যকর পরিকল্পনা নিতে হবে। যদিও চ্যালেঞ্জগুলো অনেক তবু গত কয়েক মাসে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতিও দেখা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা পূর্ববর্তী মাসের তুলনায় সামান্য বৃদ্ধি নির্দেশ করে। এছাড়া ২০২৪ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে,যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। কৃষি খাতেও কিছু উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে,যা খাদ্যনিরাপত্তায় ভূমিকা রেখেছে। তবে এ অগ্রগতিকে টেকসই করতে আরো ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। যদিও রাষ্ট্র মেরামতে বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো অর্থনীতির মৌলিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। নিত্য পণ্যের মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি, বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং কর্মসংস্থানের অভাব এ সমস্যাগুলো সমাধানে সরকারকে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। গরিব মানুষের অর্থনীতিকে প্রাধান্য দিতে হবে, নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে নিয়ে ভাবতে হবে, ভোগ্যপণ্যকে সহনশীল মাত্রায় রাখতে হবে। পাশাপাশি জনগণ তথা জানমালের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারাই হবে সামনের দিনগুলোয় সংস্কার কার্যক্রমের প্রধান চ্যালেঞ্জ। সর্বোপরি কথা হচ্ছে,রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রের পক্ষে এই দায়িত্ব পালন করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিতে সর্বোচ্চ নজর দিতে হবে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের নানাবিধ দায়িত্ব রয়েছে, সেগুলো যথাযথভাবে পালন করতে হবে। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে জোরদার অভিযান পরিচালনার জন্যও কাজ করতে হবে।আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ার পেছনে কোনো অজুহাত থাকতে পারে না, থাকা উচিত নয়। প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করতে হবে। তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। প্রশাসনকে সাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তবে এ কথা সত্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো একা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলসহ সমাজের সব স্তরের মানুষেরও সমর্থন এবং সহযোগিতা প্রয়োজন। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর দায় অনেক বেশি, তবে রাজনীতিকসহ সমাজ প্রতিনিধিদের দায়ও কম নয়। আমাদের প্রত্যাশা,সরকার সবার সহযোগিতায় সাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এগিয়ে আসবেন। তবে এ কথা অনস্বীকার্য সত্য যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই নিরাপত্তা আমাদের দিতে পারছেন না।খুন-খারাবি,সন্ত্রাস-রাহাজানি, ছিনতাই-ডাকাতি দমনে পুলিশকে এমনভাবে নিয়োজিত রাখা হয়েছে, মানুষের মালের নিরাপত্তা রক্ষায় সেই কাঙ্ক্ষিত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা পুলিশের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠছে না।এ অবস্থায়ই যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে।আমরা মনে করি, গ্রেপ্তার অভিযান সঠিকভাবে চালালে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে পারে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এমনটাই সবার প্রত্যাশা। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |