![]() বৈষম্যহীন বাংলায় দলিতদের প্রতি সীমাহীন বৈষম্য!
শিপন কুমার রবিদাস:
|
![]() এই মহান দিবসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়: দক্ষিণ আফ্রিকার শার্পভ্যালিতে সাধারণ জনগণ জাতিগত বর্ণ বৈষম্য বিল পাশের বিরুদ্ধে ১৯৬০ সালে একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করে এবং পুলিশ বিনা উস্কানিতে মিছিলে গুলি করে ৬৯ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। মর্মান্তিক এই ঘটনাকে উল্লেখ করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৬৬ সালে সকল দেশের সকল মানুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য কমানোর জন্য সকল দেশের প্রতি জোরালোভাবে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ জাতিগত বৈষম্য কমানোর জন্য সংহতি সপ্তাহ ঘোষণাসহ প্রতিবছর ২১ মার্চকে আন্তর্জাতিক বর্ণ বৈষম্য বিলোপ দিবস ঘোষণা করে। সেই থেকে ২১ মার্চ সারা বিশ্বে একযোগে এই দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় ‘আন্তর্জাতিক বর্ণ বৈষম্য বিলোপ দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। এই দিবস পালনের সময়কাল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণ বৈষম্য আইন বিলোপ ঘোষণা করা হয় যার ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচলিত বর্ণবাদ আইন এবং চর্চা বাতিল করতে বাধ্য হয়। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয়ভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও প্রায় সকল প্রকার ধর্ম চর্চা, ব্যক্তি বিশেষের মননে ও চিন্তায়, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বর্ণবাদ প্রথা বিদ্যমান থাকায় এখনও মানুষ বৈষম্য থেকে মুক্তি পায়নি। বর্ণবাদ হলো সেই দৃষ্টিভঙ্গি, চর্চা এবং ক্রিয়াকলাপ যেখানে বিশ্বাস করা হয় যে: মানুষ বৈজ্ঞানিকভাবেই অনেকগুলো গোষ্ঠীতে (races) বিভক্ত এবং একই সাথে বিশ্বাস করা হয় কোন কোন গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য উঁচু অথবা নিচু; কিংবা তার উপর কর্তৃত্ব করার অধিকারী; অথবা বেশি যোগ্য কিংবা অযোগ্য। বর্ণবাদের সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করাটা কঠিন। গবেষকদের মতে, বর্ণবাদ কখনো গায়ের চামড়ার রং দিয়ে হতে পারে, কখনো আঞ্চলিকতা দিয়ে হতে পারে, কখনো গোত্র দিয়ে হতে পারে, কখনো বর্ণ (caste) দিয়ে হতে পারে। কিছু কিছু সংজ্ঞা অনুসারে, কোনো মানুষের আচরণ যদি কখনো তার জাতি বা বর্ণ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, সেটি অন্য কারো জন্য ক্ষতিকর না হলেও তাকে বর্ণবাদ বলা হবে। অন্যান্য সংজ্ঞায় শুধুমাত্র বর্ণবাদ দিয়ে প্রভাবিত হয়ে শোষণ এবং অত্যাচার করাই বর্ণবাদ। যদিও কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘মানুষ জাতি’ কবিতায় বলে গেছেন- “কালো আর ধলো বাহিরে কেবল ভিতরে সবারই সমান রাঙা”। তবুও সাদা আর কালোতে, জাতি আর ধর্মের নানা বর্ণবাদী বৈষম্যে নিপীড়িত হয়েছেন, সহিংসতায় প্রাণ দিয়েছেন অগণিত মানুষ। আবার এই বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামেও প্রাণ দিতে হয়েছে অগণিত মানুষকে। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশেই জন্ম ও পেশাগত কারণে অস্পৃশ্যতার চর্চা ও অমানবিক আচরণের দৃষ্টান্ত অহরহ। বাংলাদেশে এই একবিংশ শতাব্দীতেও দলিত ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীরা প্রতিনিয়ত অস্পৃশ্যতার শিকার হন বৃহত্তর সমাজের কাছ থেকে। খাবারের হোটেল থেকে শুরু করে উপাসনালয়, সেলুনসহ অনেকক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার হন তারা। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েই তাদের জীবন যাপন করতে হয়, ‘পাবলিক স্পেস’ ব্যবহারের সুযোগ তারা পাননা। এই বিচ্ছিন্নতা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানসিক। এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জন্ম ও পেশাগত পরিচয়ের কারনে বাংলাদেশে দলিত জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭৫ লাখ মানুষ সমাজে অস্পৃশ্যতার শিকার। দলিতরা প্রতিনিয়ত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন, কর্মক্ষেত্র, ব্যবসা বাণিজ্য, আবাসন এমনকি মৃতদেহ সৎকারের ক্ষেত্রেও বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার হয়। যুগ যুগ ধরে দলিত জনগোষ্ঠীর উপর চলমান যে বৈষম্য বিদ্যমান রয়েছে তা তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নয়নের অন্যতম প্রধান অন্তরায়। বাংলাদেশের অনেকেই জাত-পাত বৈষম্যের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন, মানতে নারাজ। তাদের মতে, সভ্যতার এ যুগে এসে অস্পৃশ্যতা চর্চার সময় নেই। হ্যাঁ, বিষয়টি এমনটি হলে ভালোই হতো। কিন্তু বাস্তবতা পুরো উল্টো। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখনও কিছু মানুষের রেস্টুরেন্ট, সেলুন, উপাসনালয়ে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, রংপুরসহ অধিকাংশ জেলাতেই হরিজন গোত্রের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের হোটেলের বাইরে থেকে খাবার নিতে দেখা যায়। থাকে তাদের জন্য আলাদা প্লেট-গ্লাস। এর চেয়ে অমানবিক আর কি হতে পারে। এ লজ্জ্বা কার? বর্ণ বৈষম্যমূলক আচরণের সূত্রধরে বগুড়ার সান্তাহারে মিঠুন বাঁশফোরের হাত গরম তেলে ঝলসে দেওয়া, মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় হরিজন শিশুকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া, রংপুরের গঙ্গাচড়ায় হরিজন শিশুকে খাবার হোটেল থেকে বিতাড়িত করা, দিনাজপুরের পার্বতীপুরে হরিজন শিশু শিক্ষার্থীদের ভর্তি না নেওয়ার মতো ঘটনাগুলো একই সূত্রে গাঁথা। এরকম চলমান উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। বিশ্বাস না হলে যখন-তখন প্রমান মিলবে সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে। বিষয়গুলো হরহামেশাই ঘটছে সারাদেশে। দেখার কেউ নেই। কোনও প্রতিকারও নেই। অঞ্চলভেদে এই বৈষম্যের তারতম্য থাকলেও কঠিন এবং কঠোর প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দলিতদের জীবনযাপন করতে হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের কথা উল্লেখ করা হলেও স্বাধীনতার এত বৎসর পরও বৈষম্য বিরাজমান। দেশের অনগ্রসর দলিত, হরিজন, তৃতীয় লিঙ্গসহ পিছিয়ে পড়া তথাকথিত অস্পৃশ্য নাগরিকদের প্রতি সকল ধরণের বৈষম্য বিলোপে আইন প্রণয়নের দাবি দীর্ঘদিনের। ‘অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়নের জন্য ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের আইন মন্ত্রণালয় “বৈষম্য বিলোপ আইন ২০১৪” খসড়া তৈরি করেছে যা এখনও চূড়ান্তভাবে আইন আকারে অনুমোদিত হয়নি। এটি কার্যকর হলে বৈষম্যের শিকার ব্যক্তি মামলা করতে পারবেন এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অবহেলিত মানুষগুলো উপকৃত হবেন। অবহেলিত জনগোষ্ঠীর প্রায় এক কোটি মানুষের অধিকার নিশ্চিত হবে। এতে বৈষম্য বিলোপ বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠা এবং বৈষম্য করার অপরাধে নানা দন্ডের সুপারিশ রয়েছে। সুপারিশে বলা হয়, সরকার প্রতিটি জেলায় এক বা একাধিক ‘বৈষম্য বিলোপ বিশেষ আদালত’ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে জেলা জজ বা দায়রা জজকে এ আদালতের বিচারক নিযুক্ত করবে। অভিযোগ গঠনের তারিখ থেকে ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করতে হবে। এটি কার্যকর হলে বৈষম্যের শিকার ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করার অধিকারী হবেন। খসড়া আইনে বলা আছে; ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, শারীরিক, মানুষিক ও লৈঙ্গিক প্রতিবন্ধীত্ব এবং কথিত অস্পৃশ্যতার অজুহাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বৈষম্যমূলক কাজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। প্রস্তাবিত খসড়ায় অবহেলিত জনগোষ্ঠীর লোকদের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা লাভে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলে প্রথমবার ২ বছরের কারাদন্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড দিতে পারবেন আদালত। পরে প্রতিবারের জন্য ৫ বছরের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড দেওয়া যাবে। শিক্ষা ও চিকিৎসা গ্রহণে বাধা; কর্মলাভে বাধা, জনস্থল, সার্বজনীন উৎসব, নিজ উপাসনালয়ে প্রবেশ ও অংশগ্রহণে বাধা প্রভৃতি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। কিন্তু খসড়াটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হলেও কোনো অগ্রগতি নেই। সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তি আইনটি প্রণয়নে নানা সময়ে নানা কথা বললেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায় নি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইন ও সনদ বাস্তবায়নেও বৈষম্য বিলোপে আইন করাটা জরুরি। এ বিষয়ে সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আরও আন্তরিক হতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪, ২৭ ও ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারনে কোনো ব্যক্তির প্রতি কোনো প্রকার বৈষম্য করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হলেও সুনির্দিষ্ট কোনো বিধি-বিধান না থাকায় ভূক্তভোগী ব্যক্তির পক্ষে আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করা কঠিন। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলন (বিডিইআরএম) ও নাগরিক উদ্যোগ এবং আরো অন্যান্য নাগরিক সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্য বিলোপ আইন প্রনয়ন ও বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আসছে। পরবর্তিতে এই দাবির প্রেক্ষিতে আইন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও অন্যান্য নাগরিক সংগঠনের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে ‘বৈষম্য বিলোপ আইন-২০১৪’ শিরোনামে একটি খসড়া আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে দাখিল করে। আইনটির খসড়া প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বিডিইআরএম ও নাগরিক উদ্যোগ শুরু থেকেই আইন কমিশনের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করেছে। দীর্ঘদিনের দাবীর প্রেক্ষিতে আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম, ঐ অধিবেশনেই প্রস্তাবিত ‘বৈষম্য বিরোধী বিল’ টি পাশ করে বাংলাদেশের দলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু আশার গুড়ে বালি। সংসদে কত কত বিল পাস হয়েছে, কিন্তু অধিকতর জনগুরুত্বপূর্ণ এ বিলটি আশার মুখ না দেখায় আমরা সত্যিই ব্যথিত। রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন, আদৌ কি ‘বৈষম্য বিরোধী বিল’ টি পাশ করা হবে। অথবা সে আন্তরিকতা সংশ্লিষ্টজনদের আছে? বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে ভাষা-সংস্কৃৃতি-পেশার বৈচিত্র্যকে ধারণ করে। এবং তা স্বীকৃতি দেওয়ার নজির বাহবা পাবার যোগ্যও বটে। বৈচিত্র্যের বৈভব ও বহুত্ববাদের এই দেশে সবকিছুরই ভিন্নতা পাবে এক অনন্য মর্যাদা, এমনটাই প্রত্যাশিত। আন্তর্জাতিক বর্ণ বৈষম্য দিবসে আজ আমাদের সকলের অঙ্গীকার হোক দেশের সকল জাতি ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, পেশা, লিঙ্গভিত্তিক বিদ্যমান বৈষম্য বিলোপের মাধ্যমে একটি বহুত্ববাদী সমাজ গঠনে অবদান রাখার। যেখানে দেশের সকল মানুষ সমঅধিকারের ভিত্তিতে মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবে। কণ্ঠে কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হোক: “জাতপাত নিপাত যাক, মানবতা মুক্তি পাক”। লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলন (বিডিইআরএম), কেন্দ্রীয় কমিটি। |