![]() রাজনৈতিক সংস্কৃতি সংস্কার বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা
রায়হান আহমেদ তপাদার
|
![]() অথচ একটি দেশের টেকসই অগ্রগতির জন্য ধারাবাহিক সংস্কার অপরিহার্য। যদিও বাংলাদেশ একটি কাঙ্ক্ষিত অর্থনীতি, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, বিচার বিভাগীয় ও সামাজিক সংস্কার বাস্তবায়ন করা এখানে অত্যন্ত কঠিন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বিপরীতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো, যেমন ভিয়েতনাম, ধারাবাহিক সংস্কারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। অপর দিকে বাংলাদেশে সংস্কারপ্রক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই স্থবির হয়ে পড়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। যদিও সংস্কারের গুরুত্ব বহুমুখী,যা শুধু অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি সামগ্রিক রূপান্তরপ্রক্রিয়া, যা দেশের সামাজিক,প্রশাসনিক, বিচারিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে সংস্কারপ্রক্রিয়াকে ব্যাপক পরিসরে গ্রহণ করতে হবে।বিভিন্ন খাতে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হওয়ার পাশাপাশি সুশাসন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। অর্থনৈতিক সংস্কার দেশের উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বেশ কিছু সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিল। ফলে বেসরকারি খাতের বিকাশ ঘটে, রপ্তানি বৃদ্ধি পায় এবং বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত হয়। বিশেষ করে পোশাক শিল্পের উত্থান এবং বাণিজ্য উন্মুক্তকরণ নীতির কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গতিশীল হয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈদেশিক বিনিয়োগের অভাব, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা, কর আদায়ের সীমাবদ্ধতা ও ব্যবসাবান্ধব নীতির অভাবের কারণে নতুন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তীব্র হয়েছে। টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য ব্যাংকিং ও রাজস্ব ব্যবস্থায় কাঠামোগত পরিবর্তন আনা জরুরি। রাজনৈতিক সংস্কারের গুরুত্বও কম নয়, কারণ গণতন্ত্রের বিকাশ, নির্বাচনব্যবস্থার স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করা দেশ পরিচালনায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। তবে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারবিমুখতা এ খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় এবং এর ফলে অন্যান্য খাতেও সংস্কার কার্যকর করা কঠিন হয়ে পড়ে।প্রশাসনিক সংস্কার ছাড়া উন্নয়ন কার্যক্রমকে গতিশীল করা সম্ভব নয়। আমলা- তন্ত্রের দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং ডিজিটাল প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের মাধ্যমে সরকারি কার্যক্রমকে আরও জনবান্ধব করা সম্ভব। বর্তমানে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও স্বচ্ছতার অভাব সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা ব্যাহত করছে। তাই প্রশাসনিক কাঠামোতে আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য। বিচার বিভাগীয় সংস্কার দেশের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘসূত্রতা, মামলার জট, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব এবং আইনি প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি বিচারব্যবস্থার প্রধান চ্যালেঞ্জ। সাধারণ জনগণের জন্য দ্রুত বিচার ও আইনি সহায়তা সহজলভ্য করতে হলে যথাযথ নীতিগত সংস্কার প্রয়োজন। বিচারব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ফেরাতে হলে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি ও বিচার বিভাগের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক সংস্কার উন্নয়নের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ, যা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, শ্রমবাজার সংস্কার, দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি এবং নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হতে পারে। মানবসম্পদের যথাযথ বিকাশের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি শ্রমবাজারে বৈষম্য কমানো এবং নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুযোগ সম্প্রসারণের মাধ্যমে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, বিচারিক ও সামাজিক সংস্কার কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারবে। তবে এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষ নীতি-পরিকল্পনা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শুধু একটি ক্ষেত্রের ওপর গুরুত্ব দিলে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করা সম্ভব নয়, বরং সামগ্রিকভাবে সংস্কারের ধারা বজায় রাখাই হবে টেকসই উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। সংস্কার বাস্তবায়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো জনমত ও সামাজিক চাহিদা, যা বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে দুর্বল। সংস্কারের পক্ষে শক্তিশালী সামাজিক চাহিদা এখনো সুসংগঠিত হয়নি। ফলে সরকার ও নীতিনির্ধারকেরা সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণে পর্যাপ্ত চাপ অনুভব করে না। যদিও বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতি, অদক্ষতা ও স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে নাগরিক অসন্তোষ রয়েছে, তবে তা সংগঠিত রূপ পায়নি। গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ এবং শিক্ষিত নাগরিকদের সক্রিয় ভূমিকা এ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তবে তাদের প্রচেষ্টার অভাবে নীতিনির্ধারকদের ওপর সংস্কারের জন্য চাপ যথেষ্ট পরিমাণে তৈরি হচ্ছে না। সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য কেবল সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা যথেষ্ট নয়, বরং নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ, গণমাধ্যমের নিরপেক্ষ ভূমিকা এবং শক্তিশালী জনমতের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধি ও কায়েমি স্বার্থবাদীদের প্রভাব সীমিত করার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব হতে পারে।সুশীল সমাজ, সচেতন নাগরিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারপন্থী অংশ মনে করে যে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাপ্তিকাল সংস্কার কার্যক্রমের জন্য একটি অনুকূল সুযোগ। তাদের আশা, এ সরকার দ্রুত কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে। তবে প্রশাসনের মধ্যে সংস্কারবিরোধী আমলাদের অসহযোগিতা, সুস্পষ্ট রোডম্যাপের অভাব এবং সংস্কারের পক্ষে জনগণের ধারাবাহিক, শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ চাপের অভাব অনেক ক্ষেত্রেই এসব উদ্যোগের গতি থামিয়ে দেয়। এ ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কারের প্রতি প্রকৃত অঙ্গীকারের অভাবের কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের চালু করা সংস্কারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ক্ষমতায় ফিরে আসার পর এসব দল প্রায়ই পূর্বের সংস্কার উদ্যোগগুলো বন্ধ করে দেয় বা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পরিবর্তন আনে, যা কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের তুলনায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো, বিশেষ করে ভিয়েতনাম ধারাবাহিক সংস্কারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক খাতে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অর্জন করেছে। সংস্কারবিহীন প্রবৃদ্ধি দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হয় না। কারণ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কেবল উৎপাদন বা আয় বৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং তা নির্ভর করে কার্যকর প্রতিষ্ঠান, সুশাসন ও অন্তর্ভুক্তি- মূলক নীতির ওপর। যদি কাঠামোগত সংস্কার না করা হয়, তাহলে আয় ও সম্পদের বৈষম্য বাড়তে পারে, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অদক্ষতা বৃদ্ধি পেতে পারে এবং বিনিয়োগ পরিবেশ প্রতিকূল হয়ে পড়তে পারে। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিছু সময়ের জন্য ত্বরান্বিত হলেও তা স্থায়ীভাবে জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়। উন্নত, দারিদ্র্যমুক্ত ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, বিচার বিভাগীয় ও সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করা জরুরি, যাতে ন্যায়বিচার ও সুশাসনের সুযোগ সবার জন্য নিশ্চিত হয়।একটি টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের জন্য প্রয়োজন সংস্কারমুখী রাজনৈতিক নেতৃত্ব। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সফল সংস্কার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক খাতের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় সংস্কারপথ নির্ধারণ করতে পারে, যা দীর্ঘ মেয়াদে দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য সহায়ক হবে। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |