![]() ফিলিস্তিনে ঈদ : ভুলুন্ঠিত মানবতা : নিরব বিশ্ব বিবেক
এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া:
|
![]() মানুষ হাসবে, কাঁদবে, সংগ্রাম করবে, হারবে, জিতবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ফিলিস্তিনে যা হচ্ছে, তা স্বাভাবিক নয়। সেটা নির্মম, ভয়াবহ এবং মানবতার চূড়ান্ত বিপর্যয়। মোট কথা সেখানে ন্যূনতম মানবতা অবশিষ্ট নেই। পুরোটাই ভূলুণ্ঠিত হয়ে গেছে। মানুষ নিজের দুঃখ, যন্ত্রণা, লাঞ্ছনা, বেদনা সব সহ্য করতে পারে। কিন্তু অবুঝ শিশুর কান্না সহ্য করতে পারে না। অথচ ফিলিস্তিনের শিশুরা শুধু কাঁদছে না, প্রতিদিন লাশ হচ্ছে। তাদের রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাটি, ভেসে যাচ্ছে বাবা-মায়ের কোল। ফিলিস্তিনে প্রতিদিন এমন অনেক শিশু মারা যাচ্ছে, যারা মৃত্যুর আগে জেনেও যেতে পারেনি কী তাদের মৃত্যুর কারণ। কী তাদের অপরাধ। আর এমন অনেক শিশু এতিম হচ্ছে, যারা জানে তাদের বাবা-মা আবার ফিরে আসবে। আবার তাদের বুকে টেনে নেবে। আবার ভালোবাসবে, মুখে খাবার তুলে দেবে। বিশ্বনেতারা মানবতা ও মানবিকতার কথা প্রায়ই বলেন। তবে তাদের সেই মানবিকতা ভূলুণ্ঠিত হয় ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে। ফিলিস্তিনের ভাগ্য ও এর ভবিষ্যৎ কী হবে-এ প্রশ্ন কেবল মধ্যপ্রাচ্যের নয়, বরং পুরো বিশ্বের। ফিলিস্তিন সমস্যা একটি জটিল ও বহুমাত্রিক সংকট, যা বছরের পর বছর ধরে বৈশ্বিক রাজনীতি এবং মানবাধিকার ইস্যুর কেন্দ্রে অবস্থান করছে। ইসরাইলের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ফিলিস্তিনিদের দ্বন্দ্বের ফলে সৃষ্টি হওয়া মানবিক ও রাজনৈতিক সংকট আজও সমাধানের অপেক্ষায়। ফিলিস্তিন সংকটের ইতিহাস শতাব্দী প্রাচীন। এটি মূলত ১৯১৭ সালে বেলফুর ঘোষণা ও পরে ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই প্রকট আকারে দেখা দেয়। ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হয়, যার ফলে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি নিজেদের ভূমি হারিয়ে শরণার্থী হয়ে যায়। এ ইতিহাস বর্তমান সংকটের শিকড়, যেখানে ইহুদি জনগণের জন্য একটি নিজস্ব রাষ্ট্রের চাহিদার মুখোমুখি আরব জনগোষ্ঠীর ভূমির অধিকার খর্ব হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের গাজার বাসিন্দাদের যখন গভীর ঘুমে, যখন কেউ কেউ পবিত্র রমজানের প্রস্তুুৃতি গ্রহন করছে, ঠিক সেই সময় যুদ্ধবিরতি ভেঙ্গে গাজা উপত্যকাজুড়ে ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর বিমান হামলা চলছে। এসব হামলায় হাজার হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনি নিহত ও আহত হয়েছেন। গাজায় খাদ্য ও ওষুধের ওপর চলমান অবরোধের মধ্যেই বিশ্ব শান্তির বিষফোড়া ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এ হামলা পরিচালনা করেছে। এ হামলা অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে ‘গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূলের ধারাবাহিকতা’ মাত্র। ইসরাইল যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গ করে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।’ গাজায় ইসরাইলের এই হামলাগুলো বিশ্বে অস্থিতিশীলতা বয়ে আনতে পারে। নেতানিয়াহুর সরকার আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে মানবতাকে করেছে পদদলিত। এ সকল হামলা প্রমাণ করে, নেতানিয়াহু সরকারের গণহত্যা নীতি একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইল আবারও গাজার নিরপরাধ মানুষের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে। যারা আগে থেকেই সহায়-সম্বল ও স্বজন হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছিলেন। আজ আবারও বোমাবর্ষণ করে ইসরায়েল তাদের দুঃখ-দুর্দশাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছে। দখলদার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী পুনরায় যুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দিয়ে এ হামলা চালিয়ে নিজেদের জঙ্গি মনোভাবই প্রকাশ করলো। নিয়ম ভঙ্গ করে, পবিত্র রমজান মাসেও মনুষ্যত্ব ভুলুণ্ঠিত করে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে এ সন্ত্রাসী বাহিনী। এ হামলা ও আক্রমণ করে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সরাসরি যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে; যা গুরুতর অপরাধের শামিল। যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা বিশ্বের মদদে ইসরাইল যুগের পর যুগ ধরে গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে। ফিলিস্তিনীদের একমাত্র অপরাধ তারা মুসলমান। আন্তর্জাতিক বিশ্ব ইসরাইলকে যুদ্ধ বন্ধে বাধ্য করতে ব্যার্থ হয়েছে। মুসলমানরা বার বার জাতিসংঘ, ওআইসি, আরবলীগ সহ মানবাধিকার রক্ষাকারী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি ফিলিস্তিনে গণহত্যার দায়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানালেও কার্যত কোন পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয় নাই। ইসরাইলকে যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য করা সহ গণহত্যার দায়ে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি জানাচ্ছি। উদ্বাস্তুদেরকে মানবিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানালেও দৃশ্যত খুব বেশী উদ্যোগ দেখা যায় নাই। মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোড়া রক্তখেকো, রক্তচোষা নেতানিয়াহু মানব সভ্যতার দুশমন। বাংলাদেশের পাসপোর্টে ইজরাইলের গমন নিষিদ্ধ ছিল। সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইজরাইলের দোসর পতিত সরকার গোপনে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়ে ইজরাইলে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। মুসলিমদের টাকায় ইজরায়েল অস্ত্র তৈরি করে সেই অস্ত্র দিয়ে আমাদের মুসলিম ভাই-বোনদের হত্যা করবে তা মেনে নেওয়া যায় না, যাবে না। ইজরায়েলের উপর অর্থনৈতিক চাপ, আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির ছাড়া কোন বিকল্প নাই। ইজরাইল ভিক্ষুকরূপে আরব বুকে একটু ভূখন্ড চেয়েছিল। তাদেরকে ভূখন্ড দেওয়ার পর তারা মুসলমানদের প্রথম কাবা দখল করে নেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। এজন্যই তারা ফিলিস্তিনের নাগরিকদের উপর বর্বরোচিত হামলা চালাচ্ছে। এ যাবৎ ‘ইসরাইল-ফিলিস্তিনি সংঘাত’ হাজার হাজার মানুষের প্রাণ নিয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে এবং এর শিকড় রয়েছে এক শতাব্দীরও বেশি আগে পরিচালিত একটি ঔপনিবেশিক কর্মে। ১৯৪৮ সালে, জাতিসংঘ ২-রাষ্ট্র নীতি ঘোষণা করে-ইসরাইল স্বাধীনতা পেয়েছিল কিন্তু ফিলিস্তিন পায়নি। তারপর থেকে পুরো বিশ্ব দেখছে কীভাবে ফিলিস্তিন ‘ইসরাইলি সন্ত্রাসবাদের’ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে ও নিরীহ মানুষ জীবন দিচ্ছে। শুধু তাই নয় ইসরাইল ফিলিস্তিনের জমি দখল করতে থাকে একের পর এক। কিন্তু শক্তিশালী পশ্চিমারা তা কখনোই দেখেও দেখে নাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব কখনই ইসরাইলকে সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত করে নাই। কিন্তু ফিলিস্তিনীরা যখন পাল্টা জবাব দেয়, তখন তারা সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত হয়-এটাই দুঃখজনকভাবে বাস্তবতা। বিশ্ব দেখতে শুরু করে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। ইসরাইল ও পশ্চিমা বিশ্ব দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনিরা সন্ত্রাসবাদী বলে প্রচারণা চালিয়ে তাদের ওপর ইসরাইলী সামরিক অভিযান ও হত্যাযজ্ঞকে বৈধতা দিচ্ছে, অথচ সত্য হচ্ছে, ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্মই হয়েছে সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডের মাধ্যমে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে হাগানাহ, ইরগুন ও স্টার্ন গ্যাং একীভূত হয়ে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে ও পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন নিয়ে বৈশ্বিক নিয়মনীতি অবজ্ঞা করে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে উদ্বাস্তু বানিয়ে এবং নিজ ভূমে তাদের অবরুদ্ধ করে ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞাকে পদদলীত করে (সুনির্দিষ্ট ভূ-সীমা) ইসরায়েল প্রচন্ড দাপটের সাথে টিকে আছে। অথচ ফিলিস্তিন দিনের পর সংকুচিত হতে হতে এবং ইসরাইলের আক্রমনে লন্ডভন্ড হয়ে অস্তিত্ব হারানোর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। হাজার হাজার সাধারণ নিরীহ মানুষ তাদের প্রাণ হারিয়েছে। গাজায় প্রতিদিন নিহতের সংখ্যা বাড়ছে। নিরীহ মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে গাজায়। পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, খাবার নেই- আছে শুধু মানুষের হাহাকার। প্রাণ বাঁচাতে আকুতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রত্যক্ষ মদদ না থাকলে ইসরাইল দিনের পর দিন এভাবে নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে পারতো না। পারতো না অবরুদ্ধ করে রাখতে। জায়নবাদী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান থিওডর হার্জল ১৮৯৬ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের উপনিবেশের একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই উপনিবেশ হবে বর্বরদের বিপরীতে সভ্য সমাজের একটা ঘাঁটি। জায়নিস্ট অর্গানাইজেশনের প্রধান হাইম ওয়াইজম্যান এসেছিলেন বেলারুশ থেকে। ১৯৩৬ সালে তিনি ফিলিস্তিনিদের ‘ধ্বংসবাদী শক্তি’, ‘মরু বাহিনী’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর ভাষায়, ইহুদি ঔপনিবেশিকেরা ছিল, ‘সভ্যতা’ ও ‘সৃষ্টি’কামী। ওয়াইজম্যান পরে ইসরাইলের প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। জায়নবাদীদের ফিলিস্তিন দখল প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘এটা মরু বাহিনীর বিরুদ্ধে সভ্য জাতির পুরোনো যুদ্ধ। আমাদের কেউ থামাতে পারবে না।’ সাধারণ ফিলিস্তিনি নেতারা জানবাদী বসতিস্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু আল-কাসসাম উভয়ের বিরুদ্ধে লড়াইকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। অধিকাংশ ফিলিস্তিনি নেতা ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের সমর্থক হলেও আল-কাসসাম ফিলিস্তিনের সংঘাতকে ধর্মীয় সংগ্রাম হিসেবে দেখতেন। ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসন এবং জায়নবাদীদের আধিপত্য উৎখাতের জন্য আল-কাসসাম নৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক জিহাদের পক্ষে ছিলেন। তিনি মুসলিমদের জমি বিক্রয়ের ব্যাপারেও সতর্ক করেন। বিশ্বজুড়ে যারা মানবতার বুলি আওড়ায়, তারাই বর্বর হামলার সহযোগিতা করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বকেই তাই দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে এই প্রাণঘাতী যুদ্ধ বন্ধের জন্য। সারা বিশ্বকেই এগিয়ে আসতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বকে চাপের মধ্যে রাখতে। ইসরাইল-ফিলিস্তিনে চিরস্থায়ী শান্তি আসবে সেইদিন যেদিন ফিলিস্তিনিরা পাবে তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব চাইলেই তা এই মুহূর্তেই সম্বভ। ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ কোনো সহজ বা সোজা পথে নয়। ‘কোন পথে ফিলিস্তিন’-এ প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সংলাপ, ন্যায়বিচার এবং সম্মানের ভিত্তিতে একটি কার্যকর ও টেকসই সমাধান প্রতিষ্ঠার ওপর। ফিলিস্তিন এমন একটা দেশ। যাদের প্রধানমন্ত্রী আছে, বিভিন্ন দেশে দূতাবাস আছে কিন্তু পৃথিবীতে তারা একমাত্র জাতি যাদের কোনো ভূমি নেই। আর এটি ঘটছে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যের ষড়যন্ত্রের কারণে। দীর্ঘদিন যাবৎ ফিলিস্তিনের জনগণ এই অধিকারের জন্য লড়াই করছে। তাদের মাতৃভূমি থাকতেও তাদের কোনো দেশ নেই। তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আমরা সমর্থন জানাই। (লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও চেয়ারপার্সন, ভয়েস অব কনসাস সিটিজেন-ভিসিসি) |