![]() দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি ও হালুয়া-রুটির ভাগাভগি এবং সাধারণ জনগণ
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() সর্বোপরি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সরকারি অফিসগুলো হতে হবে ব্যবসা সহায়ক। তা হলে দেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধ হবে এবং বাংলাদেশে বিদেশি পুঁজি আসবে। বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার ১৬ বছর ধরে নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের দেশের দেশপ্রেমিকগণ টাকা পাচার করতে শুরু করেন। বৈশ্বিক আর্থিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গড়ে প্রতি বছর ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। এরমধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বড় অংশই দেশ থেকে পাচার হয়। পাচার হওয়া গন্তব্য দেশগুলো হচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, হংকং ও থাইল্যান্ড।বিদেশি প্রভুরা আমাদের পরামর্শ দেন। উপদেশ দেন। খবরদারি তো আছেই! তাদের উপদেশ দেয়ার সংস্কৃতি দেশ জন্মের পর থেকেই শুরুর কথা শুনেই আসছি। আমাদের অর্থনীতি সমৃদ্ধের পথে কেন যেন হাঁটতে পারে না! সফরকৃত যুক্তরাষ্ট্রের ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের চেয়ার অ্যালেক্স সোরোস ও প্রেসিডেন্ট বিনাইফার নওরোজির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ক’দিন আগে বৈঠক করেন বর্তমান সরকারপ্রধান। অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, উত্তরাধিকারসূত্রে তার সরকার বিপর্যস্ত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি অর্থনীতি পেয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠকে শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে বলে তথ্য তুলে ধরেন। তা ফিরিয়ে আনার জন্য সম্পদ শনাক্তকরণ কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশকে সহায়তা করার অনুরোধ জানান।ওয়াশিংটনভিত্তিক আর্থিক খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটির (জিএফআই) পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতি বছর ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। শুধু ব্যক্তি উদ্যোগেই নয়, অর্থপাচার প্রক্রিয়ায় পরোক্ষ ভাবে যুক্ত হয়েছে দেশের একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারি বেসরকারি ব্যাংকও। দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, গেল প্রায় দেড় যুগে দেশীয় ১৯টি ব্যাংকে আত্মসাৎ করা মাত্র ২৪টি ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমেই প্রায় একশ হাজার কোটিরও বেশি টাকা পাচার হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আর্থিক খাতে সংস্কারের কাজ শুরু হয়। সে ধারাবাহিকতায় বিগত ১৬ বছরে অনিয়ম ও দুর্নীতি নিরুপণের উদ্দেশ্যে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড.দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত কয়েক বছরে অর্থপাচার বাংলাদেশে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। বিগত সরকারের আমলে অর্থনীতি ও সম্পদের বড় অংশ এই ক্ষতিকর অবস্থানে পড়ে। টাকা পাচারের জন্য দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের ক্রীড়নক, আমলাদের মধ্যে একধরনের অনৈতিক চক্র গড়ে ওঠে। ঘুষ-দুর্নীতি, আর্থিক অপরাধ, মিথ্যা ঘোষণার আড়ালে বাণিজ্য ব্যাংক থেকে চুরি করা টাকা, খেলাপিঋণের অর্থ, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে দেখানো, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, কর ফাঁকি এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হয়।২০২৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ৩ হাজার ৬০০ বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে মনোনীত হয়েছেন। ২০২৩ সালে ইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে ৮১৫ কোটি ডলার পাচার হয়। সরকারি বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন পণ্য ও সেবা কেনা হয়েছে, তাতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা। এই অর্থ সড়ক, সেতু, বিদ্যুৎ অবকাঠামো, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ইত্যাদি খাতে ব্যয় হয়েছে। এ থেকে ঘুষ হিসেবেই দিতে হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি থেকে দুই লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো। এ ঘুষ নিয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, আমলা ও তাদের সহযোগীরা। এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘুষের টাকার মধ্যে ৭৭ হাজার থেকে ৯৮ হাজার কোটি টাকা গেছে আমলাদের কাছে। রাজনৈতিক নেতা ও তাদের সহযোগীদের কাছে গেছে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। আর ঠিকাদারেরা দেশে ও বিদেশে এ অর্থ পৌঁছে দিয়েছেন রাজনীতিবিদ ও আমলাদের পরিবারের সদস্যদের কাছে। তাদের বড় অংশ থাকেন বিদেশে। প্রধান উপদেষ্টা যথার্থই বলেছেন যে বিপর্যস্ত অর্থনীতি আমাদের। বলতেই হয়, ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নাজুক অবস্থা। পুঁজিবাজার পতনবৃত্তে হাবুডুবু খাচ্ছে। রফতানির চাকা ঘুরছে না। বিনিয়োগ আশাব্যঞ্জক নয়। শুধু প্রবাসী আয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছাড়া দেশ অর্থনীতির সকল সূচকই নিম্নমুখী। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে তো বাড়ছেই। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে যা পরিবহন খরচ বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করবে। এতে প্রভাব পড়বে দ্রব্যমূল্যের ওপর। দুর্নীতিতে বিশ্বে আমরা শীর্ষস্থানে ১৬ বছর ধরে নয়। আগেও আমরা এ জন্য বিশ্বদরবারে বেশ সমালোচিত ছিলাম। ৫৩ বছরে এ পর্যন্ত দেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থপাচার হয়েছে তার হিসাব বের করা জরুরি। দেশের ব্যাংক লুট করে বিদেশি ব্যাংকগুলোতে দেশপ্রেমিকেদের জমাকৃত সে অর্থ বের করে নিয়ে আসা যায় কি না। এই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি আমাদের মধ্যে দেশপ্রেম নেই। নিজ স্বার্থরক্ষায় কাজ করি। দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও। হালুয়া-রুটির ভাগাভগি। আখের গোছানো আমাদের ধর্ম। অর্থনীতিতে অমিত সম্ভাবনার সুজলা সুফলা সোনার বাংলাকে বঞ্চিত করে বিদেশকে আমরা ভালোবেসেছি। সেকেন্ড হোম বা দ্বিতীয় বাড়ির মোহ দেশকে উন্নতির পথে নেয়নি মোটেও। প্রভু দাতাদের তোষামোদ করছি; বিদেশি ঋণে নিজেদের দায় ভারী করছি। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলোকে বেসরকারিকরণের নামে বিশৃঙ্খলিত করেছি। বিনিয়োগের নামে অনাবাসী বাংলাদেশি এবং প্রভুদের নানা ধরনের সহায়তাদানের নীতি দেশের অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করেছে। যারা অর্থের মালিক তাদের কাছে পুঁজির নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে অন্যায় ও দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত টাকার বেলায় শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং সেটিও প্রকৃত অর্থে হবে ব্যবসা সহায়ক। কারণ সরকারি কর্মকর্তারা দুর্নীতিমুক্তভাবে কাজ করলে দেশে ব্যবসায়িক পরিবেশ অধিকতর পরিচ্ছন্ন হবে। যারা বিদেশে টাকা পাচার করে, তারা দেশে টাকা রাখা নিরাপদ মনে করে না। সৎ ব্যবসায়ী ও অন্য পেশার নাগরিকরা যাতে তাদের অবস্থান এবং চলাফেরা নিরাপদ ভাবতে পারেন সেই ব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশে টাকা পাচার করা মানে আমাদের দেশপ্রেম পাচার করা। যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া একটি দেশের নাগরিকদের পূর্ণ দেশপ্রেম থাকাই স্বাভাবিক। আমরা কাজ করব আমাদের দেশের জন্য। যারা পুঁজির নিরাপত্তাজনিত কারণে বিদেশে টাকা পাচার করেন, তাদের মূল সমস্যা সম্পর্কে জেনে যদি পরিবেশ অনুকূল করা যায়, তা হলে এ সমস্যার কিছুটা সমাধান হতে পারে। আবার যারা অবৈধভাবে টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত হয়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। একটি দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গড়ে তুলে এ দেশে থাকা ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা নিরাপদ করতে হবে। তা হলেই এখানে সৃষ্টি হবে বিনিয়োগের স্বর্গরাজ্য। তখন বিদেশে পাচারকৃত অর্থ আবারও আমাদের চোখের অন্তরালে থেকে চলে আসবে বাংলাদেশে। বিদেশি বিনিয়োগ- কারীরাও তাদের অর্থ বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নেবে। দীর্ঘায়িত উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানসিক চাপ বাড়ছে সাধারণ মানুষের। বাড়ছে ঋণের বোঝা। দ্রব্যমূল্য দিনে দিনে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি এখন এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, যেখানে মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তে পরিণত হচ্ছে। তাহলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষদের সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার কি কোনো অধিকার নেই? রাজা-রানি আসে আর যায় কিন্তু এদের কথা ভাবার মানুষ কোথায়? তেলে মাথায় তেল দেন ক্ষমতাবান এবং নীতিনির্ধারকেরা। দিনে দিনে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মানুষ নিঃস্ব ও দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষদের দুঃখগাথার মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দিনবদলের সরকারের গভীরভাবে ভাবার সময় এখনই। কেননা, কষ্টে থাকা সৎ মানুষেরাও তো ক্ষমতার শক্তি। তাঁদেরও আছে শৃঙ্খলিত ও শান্তিপূর্ণভাবে বাঁচার অধিকার। আমরা সেই দিনের প্রত্যাশায় আছি, যখন কেউ দেশপ্রেম পাচার করে দেবে না। বরং দেশপ্রেম অঙ্কুরিত হবে, পল্লবিত হবে, মানুষের ভেতর সৃষ্টি হবে নতুন এক আকাক্সক্ষা, তারা দেশ এবং দেশের মানুষকে ভালোবাসতে শিখবে। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |