![]() রাজনৈতিক অস্থিরতা জাতীয় উন্নয়নের অন্তরায়
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() কোনো সন্দেহ নেই যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় না থাকায় দেশের সব স্তরের জনগণও কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক শক্তি ও জনগণ-এই দুই পক্ষ ছাত্রদের নেতৃত্বে মাঠে নামায় হাসিনার মতো নিপীড়ক শাসককে সরানো গেছে। এবারের গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনীতিতে ছাত্ররা শুরু থেকেই একটি শক্তি বা অংশীদার হিসেবে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে সচেষ্ট আছে। সব রাজনৈতিক দলের সম্মতিতে যে অন্তর্বর্তী সরকার হয়েছে, সেখানে কোনো দলের প্রতিনিধি না থাকলেও ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব আছে। এটা স্পষ্ট যে সেই ধারাবাহিকতায়ই ছাত্রদের নেতৃত্বে দল গড়ে উঠছে। ছাত্ররা শুরু থেকেই বলে আসছে যে গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়াকে তাঁরা ব্যর্থ হতে দিতে চান না। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে দেশে আবার আগের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ফিরে আসবে, সেই ভয় ছাত্রদের রয়েছে। নব্বইয়ের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিলে ছাত্রদের এই আশঙ্কা ফেলে দেওয়া যায় না। দেশের অর্থনীতির প্রধান চারটি খাত-কৃষি, উৎপাদন, নির্মাণ ও সেবা খাতভিত্তিক জরিপের মাধ্যমে প্রতি মাসে প্রকাশ করা হয় পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেক্স (পিএমআই)। ব্যবসায়ী সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ যৌথভাবে এ সূচক প্রকাশ করে। এতে ওই চার খাতের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়। পিএমআই মান ৫০-এর নিচে হলে দেশের অর্থনীতি সংকোচন ও ৫০-এর বেশি হলে সম্প্রসারণের ধারায় রয়েছে বলে বোঝানো হয়। আর মান ৫০ থাকার অর্থ হলো সংশ্লিষ্ট খাতে ওই মাসে কোনো পরিবর্তন হয়নি। সম্প্রতি গত মাসের পিএমআই প্রকাশ পেয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, গত মাসে জানুয়ারির তুলনায় ১ দশমিক ১ পয়েন্ট কমে ৬৪ দশমিক ৬-এ দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ দেশে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের গতি কমেছে। বিশেষত, প্রধান চার খাতের মধ্যে নির্মাণ ও সেবা খাতের সম্প্রসারণের গতি কমেছে। ফেব্রুয়ারির পিএমআই প্রতিবেদন অনুযায়ী, কৃষি ও উৎপাদন খাতের পিএমআই আগের মাসের তুলনায় যথাক্রমে ৭ দশমিক ৮ ও ৪ দশমিক ১ পয়েন্ট বেড়েছে। অন্যদিকে নির্মাণ খাতে আগের মাসের তুলনায় পিএমআই কমেছে ৩ দশমিক ৪ পয়েন্ট। আর সেবা খাতে কমেছে ৫ পয়েন্ট। বলা বাহুল্য, নির্মাণ ও সেবার মতো প্রধান দুই খাতের সম্প্রসারণ নিম্নমুখী হওয়ায় সামষ্টিক অর্থনীতির সম্প্রসারণের গতি ধীর হয়েছে। তবে এর পেছনে প্রধানত দায়ী দেশে আগে থেকে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট ও চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান এবং পরে চলমান সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। দীর্ঘদিন ধরে দেশের অর্থনীতির বড় উদ্বেগের জায়গা উচ্চ মূল্যস্ফীতি। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা প্রচেষ্টা ও নীতি-কৌশল নেয়ার পর উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেনি মূল্যস্ফীতির হার। এতে মানুষের জীবনযাপন ব্যয় বেড়েছে বহুগুণে। আবার বেসরকারি খাতে সেভাবে ঋণ ও বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি শ্লথ হয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে দেশের বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৪১ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২৬ শতাংশ, যা জানুয়ারিতে ৭ দশমিক ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে। একইভাবে বিনিয়োগেও মন্দা চলছে। বিগত সরকারের দীর্ঘ দেড় দশকের শাসনামলে অর্থনীতির ব্যাপক মাত্রায় রাজনৈতিকীকরণ হয়েছে। সেই সরকারের সুবিধাভোগী গোষ্ঠী নির্ভয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে গেছে, যার দরুন সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আর্থিক ও ব্যাংক খাত। যে কারণে মানুষের মাঝে আস্থাহীনতার সংকট তীব্র হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। সেই সঙ্গে জ্বালানি সংকটসহ নানা জনপরিষেবা পর্যাপ্ত না থাকার কারণেও দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধিও ঘটেনি এ খাতে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থান সম্প্রসারণে। গত ৫ আগস্ট বিগত সরকারের পতন ঘটিয়েছে ছাত্র-জনতা। জনমনে আশার সঞ্চার হয়েছিল নতুন বাংলাদেশের বিনির্মাণ ঘিরে। তবে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তী সরকার কোনো খাতেই তেমন স্থিতিশীলতা আনতে পারেনি। বরং কিছু উদ্যোগ অর্থনীতির গতি আরো শ্লথ করেছে। এক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি কমানোর কৌশল হিসেবে দফায় দফায় নীতি সুদহার বাড়ানোর কথা প্রাসঙ্গিক। এতে মূলস্ফীতি কমেনি, বরং বেসরকারি খাত আরো কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। আবার দেশে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি। এরপর রয়েছে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আইনি সুরক্ষার অভাব, সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও মাত্রাতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ, দুর্বল অবকাঠামো, ক্রয়ে জটিলতা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অংকের ঋণ জোগানে সক্ষমতার অভাব এবং স্থানীয়দের সঙ্গে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের যোগসূত্র ও সমন্বয়ের অভাব। এগুলোর বাইরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সুশাসনের অভাবও দায়ী। দেশে গত কয়েক মাসে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ, চাঁদাবাজি, বাজারে সিন্ডিকেট সক্রিয়তা, অনেক কারখানায় অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের মতো ঘটনা বেড়েছে। ফলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে পড়ে। এখনো আইন-শৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। মব ভায়োলেন্স, ছিনতাই, ডাকাতি, মানুষ হত্যা, ধর্ষণ এসব ঘটনা বেড়েই চলেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে খুন, অপহরণ, চুরি, ছিনতাই ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে মোট ৫ হাজার ৮৬২টি। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) বলছে, দেশে গণপিটুনির মাধ্যমে মানুষ হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতাকে পুঁজি করেও নানা হামলা সংঘটিত হচ্ছে। দায়িত্বরত পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরও হামলার ঘটনা বেড়েছে। একদিকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকার কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না, অন্যদিকে একজোটে বিগত সরকারের পতন ঘটানো ছাত্র ও রাজনৈতিক শক্তিগুলো জাতীয় ঐকমত্যের কথা বললেও বাস্তবে তা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সংস্কার নাকি নির্বাচন এ নিয়ে প্রায়ই বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ সরকারের সংস্কারের গতি ধীর। গতি ফেরেনি জনপ্রশাসনেও। জুলাই গণহত্যা ও আওয়ামী লীগ শাসনামলের অনিয়মের বিচারের গতি ধীর বলে অভিযোগ অভ্যুত্থানের অংশীজনের। এছাড়া বিগত মাসগুলোয় দেড় শতাধিক আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হয়েছে সরকারকে। যদিও যৌক্তিক-অযৌক্তিক দাবি নিয়ে সড়ক বন্ধ করে আন্দোলন সাধারণ মানুষকে ভোগালেও তা নিরসনে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতেও ব্যর্থ হয়েছে সরকার। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে দায়িত্ব নিয়েছে। বড় কোনো বিপর্যয়ের হাত থেকে দেশকে বাঁচালেও এখন পর্যন্ত জনজীবনে স্বস্তি আনতে পারেনি। জনপ্রশাসনকে আরো কার্যকর করা ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে মানুষ স্বস্তি পেত। অর্থনীতিও গতিশীল হতো। এসবকিছুই একে অপরের সঙ্গে জড়িত। অনেকেই তাই মনে করছেন প্রয়োজনীয় ও জরুরি সংস্কারের পাশাপাশি একটি নির্বাচনী রোডম্যাপ সামনে রেখে রাজনৈতিক রূপান্তরের দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। গণ-অভ্যুত্থান নতুন রাজনীতির আশা জাগিয়েছে। দেশের মানুষ আর পুরোনো রাজনীতিতে ফিরতে চায় না। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব যদি তা বুঝেও থাকেন, স্থানীয় পর্যায়ে বা সাধারণ কর্মী-সমর্থকেরা যে তা আমলে নিচ্ছেন না তা তাদের কর্মকাণ্ডেই স্পষ্ট। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, দ্রুত নির্বাচন এবং ক্ষমতায় এসে বিএনপি কি তার দলের নিয়ন্ত্রণহীন এসব নেতা-কর্মীদের সামলাতে পারবে? নাকি আগের পুরোনো ধারায় আওয়ামী লীগের বদলে বিএনপি-এই রাজনীতিই ফিরে আসবে? সাধারণ মানুষের মনে কিন্তু এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে এবং পুরোনো রাজনীতি ফিরে আসা নিয়ে তাদের মধ্যে ভয় আছে। দেশের বর্তমান রাজনীতিতে বেশ কিছু পক্ষের ভূমিকা থাকলেও গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রসমাজ ও সবচেয়ে বড় সহায়ক রাজনৈতিক শক্তি বিএনপিকে কেন্দ্র করেই বাকি পক্ষগুলোর হিসাব-নিকাশ চলবে। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বিএনপির যেকোনো বিরোধ, ভুল-বোঝাবুঝি বা সন্দেহ-অবিশ্বাস তাই দেশের রাজনীতিকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিতে পারে। তার কিছু লক্ষণ এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে। দুই পক্ষের মধ্যে মৌলিক ও ন্যূনতম কিছু ইস্যুতে মতৈক্যে আসার কোনো বিকল্প নেই। তা না হলে গণ-অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |