![]() বিমসটেক সম্মেলন ও ইউনূস-মোদি কথোপকথন
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম এ সময় এও আশা করেছিল, ভারত তার গত দেড় দশকের বাংলাদেশ-নীতি নির্মোহভাবে পুনর্মূল্যায়ন করবে; নয়াদিল্লি আন্তরিকভাবে বুঝতে চেষ্টা করবে বাংলাদেশের তরুণ সমাজের মধ্যে ভারতকে নিয়ে হতাশার বাস্তব কারণ রয়েছে কিনা। কিন্তু ভারতের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বিপরীত ধরনের মনোভাবই বজায় ছিল এতদিন। বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের সামাজিক ভিত্তি সম্পর্কে তাদের সঠিক তথ্য-উপাত্ত-উপলব্ধির ঘাটতি ছিল বলেই মনে হয়েছে। থাইল্যান্ড বৈঠকে সে অবস্থার একটা মোড় বদল ঘটাচ্ছে বলে আশা করা যায়। একই সঙ্গে ঢাকার বর্তমান সরকারের সঙ্গে বৈঠকের ব্যাপারে ভারতের সম্মতি বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতেও শুভ প্রভাব রাখবে। এখানে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানে এই বৈঠকের পরোক্ষ ইতিবাচক ভূমিকা থাকবে। বাংলাদেশের সব সরকারের জন্যই ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা একটা চ্যালেঞ্জ। পানিসহ দ্বিপক্ষীয় আরও কিছু বিষয়ের ন্যায্য ও প্রত্যাশিত সমাধান না পেয়ে বাংলাদেশের সমাজে ভারতের কেন্দ্রীয় শাসকদের বিষয়ে ক্ষোভ আছে। সেই ক্ষোভের সমাধান আগামীতে ভারতকে দিতে হবে। অর্থনীতি শক্তি হিসেবে ও আকারে ছোট প্রতিবেশী হলেও নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশকে বন্ধু হিসেবে পাওয়া ভারতের জন্য প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে ঢাকার যে কোনো সরকারের সঙ্গে ভারতকে কাজ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী একটি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সব সরকার বিগত দিনে কোনো ধরনের রক্ষণশীলতা ছাড়াই সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী ছিল, সচেষ্ট ছিল। ফলে ভারতকেও বাংলাদেশের যে কোনো মতাদর্শের সরকারকে দূরে ঠেলে রাখার সুযোগ নেই। ইউনূস-মোদি বৈঠকের মাধ্যমে সেই বাস্তবতা স্বীকৃত হলো। গণচীন সফরের স্বল্প সময়ের ভেতর বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে স্পষ্টত এ বার্তা দিলেন, বাংলাদেশ বিদেশনীতিতে অতীতের মতো আর কোনো একদিকে হেলে পড়ে থাকতে চায় না। এ বৈঠকের পর ভারত তার বাংলাদেশকেন্দ্রিক ভিসানীতি উদার করার উদ্যোগ নেবে বলে জনসমাজে তাৎক্ষণিক ভাবে আশাবাদ তৈরি হয়েছে। নয়াদিল্লির এই মুহূর্তটি ব্যবহার করা উচিত। চিকিৎসা নিতে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য এটি এ সময়ের জরুরি মানবিক চাওয়া। আবার ভারতও এতে লাভবান হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির এই বৈঠকের আঞ্চলিক তাৎপর্যও বিবেচনায় রাখার মতো। যুক্তরাষ্ট্র ও গণচীনের ঠান্ডা যুদ্ধ ও শুল্কযুদ্ধের পাশাপাশি মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের কারণে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে যে বাড়তি চাপ ও তাপ তৈরি হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ বোঝাপড়ার পরিবেশ থাকা প্রয়োজন ছিল।আরাকানে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে রাজি করাতে ভারত বাংলাদেশের পক্ষে ভূমিকা রাখতে পারে। অতীতে ভারত সে রকম ভূমিকা না রাখলেও এখনকার আরাকানে তার বিনিয়োগের স্বার্থেও স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশ যদি পরোক্ষ সম্পর্ক ভালো করতে পারে এবং রোহিঙ্গাদের সেখানে পুনর্বাসন করা যায়-সেটি নাফের ওপারে ভারতীয় বিনিয়োগ সুরক্ষায়ও ইতিবাচক হবে।সব মিলে ইউনূস-মোদি বৈঠকের তাৎপর্য।অনেক। যারা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে ভঙ্গুর অবস্থায় দেখতে চেয়েছিল, তাদের জন্য থাইল্যান্ড থেকে বেশ বড় খারাপ বার্তা গেল। ব্যাংককে অনুষ্ঠিত বিমসটেক ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলনে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। যার মধ্যে প্রথমবারের মতো গৃহীত হয়েছে ভিশন ডকুমেন্ট হিসেবে ব্যাংকক ভিশন ২০৩০। এতে বলা হয়, বিমসটেকের সদস্য রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের অংশগ্রহণে ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলন ৪ এপ্রিল থাইল্যান্ডের ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে, ২ এপ্রিল ২৫তম বিমসটেক ঊর্ধ্বতন সভা এবং ৩ এপ্রিল ২০তম বিমসটেক মন্ত্রিপর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়। ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের মূল ফলাফলগুলো, ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণাপত্র গ্রহণ, যা নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভবিষ্যতের সহযোগিতার জন্য তাদের সিদ্ধান্ত এবং নির্দেশনা প্রতিফলিত করে। বিমসটেকের প্রথম ভিশন ডকুমেন্ট, ব্যাংকক ভিশন ২০৩০ গৃহীত হয়েছে, যা সমৃদ্ধ, সহিঞ্চুতা এবং উন্মুক্ত বিমসটেকের দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ভবিষ্যত সহযোগিতার জন্য একটি বিস্তৃত এবং বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ প্রদান করে। সামুদ্রিক পরিবহন সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। সামুদ্রিক সংযোগ বৃদ্ধির জন্য আঞ্চলিক অংশীদারত্ব জোরদার করার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা সদস্য দেশগুলোর মধ্যে আরও বাণিজ্য এবং ভ্রমণ সক্ষম করবে। বিমসটেক এবং ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনের (আইওআরএ) মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর, যা আইওআরএ এবং বিমসটেকের মধ্যে ভবিষ্যৎ অংশীদারিত্বকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। বিমসটেক এবং জাতিসংঘের মাদক অপরাধ নিয়ন্ত্রক অফিসের (ইউএনওডিসি) মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর, যা ইউএনওডিসি এবং বিমসটেকের মধ্যে অংশীদারিত্বকে ভাগাভাগি করবে। বিমসটেক মেকানিজমের জন্য কার্যপ্রণালী গৃহীত। বিমসটেক সনদের সঙ্গে কার্যপ্রণালীর নিয়মাবলী, বিমসটেকের অধীনে আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করে, যা বৃহত্তর দক্ষতা এবং ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে।বিমসটেকের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা সম্পর্কিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের গোষ্ঠীর প্রতিবেদন গ্রহণ, যাতে বিমসটেককে সংস্কার ও পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বেশ কয়েকটি সুপারিশ রয়েছে। এ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং টোবগে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী জেনারেল মিন অং হ্লাইং, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ড. হারিনী আমারাসুরিয়া এবং থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পায়োংটার্ন সিনাওয়াত্রা। বিমসটেক নেতারা শীর্ষ সম্মেলনে তাদের বিবৃতিতে বিমসটেকের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।আঞ্চলিক সহযোগিতার অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত এবং সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব এবং উদ্যোগ উপস্থাপন করেছেন। তারা আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, সংযোগ, পর্যটন, সংস্কৃতি বিনিময়, জলবায়ু কর্মকাণ্ড, সবুজ ও নবায়নযোগ্য শক্তি, টেকসই কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তা বাড়াতে অগ্রগতি অর্জনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিমসটেক সহযোগিতাকে এগিয়ে নিতে অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতামূলক ভাবে কাজ করার জন্য বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তবে খুশির খবর হচ্ছে,আগামী দুই বছরের জন্য বঙ্গোপসাগরীয় দেশগুলোর আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট বিমসটেকের সভাপতিত্ব গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। থাইল্যান্ডের ব্যাংককে ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে এ দায়িত্ব বুঝে নেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় মিয়ানমারকে সম্পৃক্ত করার জন্য বিমসটেকভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে আরও দৃশ্যমান ও সক্রিয় ভূমিকা রাখান আহ্বান জানান। যেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে প্রত্যাবর্তনের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়।তাছাড়াও তিনি আঞ্চলিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন এগিয়ে নিতে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |