![]() ইতিহাসের আলোকে বৈশাখ, মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বাঙালি সংস্কৃতি: ধর্মীয় বিশ্লেষণ
মাহফুজ বিন মোবারকপুরী:
|
![]() প্রাক-মুঘল বাংলায় নববর্ষ হিন্দু ঐতিহ্যের ছায়া: মুঘল আমলের পূর্বে বাংলায় নববর্ষের ধারণা হিন্দু ধর্মীয় ও কৃষিভিত্তিক রীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। চৈত্র সংক্রান্তি এবং পহেলা বৈশাখ হিন্দু জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত্তিতে পালিত হতো। চৈত্র সংক্রান্তি ছিল সূর্যের মীন রাশি থেকে মেষ রাশিতে স্থানান্তরের সময়, যা বিগত বছরের শুদ্ধিকরণ এবং নতুন শুরুর প্রতীক হিসেবে গণ্য। এই সময়ে হিন্দু সম্প্রদায় গঙ্গাস্নান, সূর্য আরাধনা, শিবের গাজন, নীল পূজা এবং চড়ক পূজার মাধ্যমে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করত (বাংলাপিডিয়া, চৈত্র সংক্রান্তি)। পদ্মপুরাণে বৈশাখ মাসে গঙ্গাস্নানের মহিমা বর্ণিত, যা এই উৎসবের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব বৃদ্ধি করে। পহেলা বৈশাখ মেষ সংক্রান্তির সঙ্গে যুক্ত হিন্দু ধর্মে এটি নতুন বছরের সূচনা হিসেবে বিবেচিত। এই দিনে লক্ষ্মী-গণেশ পূজা, সূর্য আরাধনা এবং গঙ্গা পূজা সমৃদ্ধি ও মঙ্গলের প্রতীক হিসেবে পালিত হতো। হালখাতা বণিকদের নতুন হিসাব খোলার রীতি, লক্ষ্মী পূজার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল এবং হিন্দু ধর্মের অর্থনৈতিক সম্পন্নতার ধারণাকে প্রতিফলিত করত। এই প্রাক-মুঘল ঐতিহ্য মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ধর্মীয়ভাবে অপ্রাসঙ্গিক ছিল। সুলতানি আমলে (১৩৩৮–১৫৭৬) এই উৎসব হিন্দু জমিদার ও কৃষকদের মধ্যে সীমিত ছিল, এবং মুসলিম শাসকরা এর প্রতি উদাসীন ছিলেন। মুঘল আমলের রূপান্তর ও সমন্বয়: মুঘল আমলে বাংলা সন প্রবর্তনের পর পহেলা বৈশাখ ক্রমশ একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়। হালখাতার প্রথা মুসলিম ও হিন্দু ব্যবসায়ীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে, এবং মেলাগুলো সব সম্প্রদায়ের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। আকবরের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির ফলে বাংলা নববর্ষ একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক উৎসবে রূপ নেয়। আধুনিক যুগে পহেলা বৈশাখের উদযাপন মুঘল আমলের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তি এবং প্রাক-মুঘল হিন্দু ঐতিহ্যের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে শুরু হয়, প্রায়শই হিন্দু পুরাণের প্রতীক যেমন পেঁচা (লক্ষ্মীর বাহন) বা সূর্যের মূর্তি ব্যবহার করে, যা হিন্দু ধর্মের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। একইভাবে ছায়ানটের বটমূলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের গান বাঙালি পরিচয়কে উৎসর্গ করলেও, এর আধ্যাত্মিক সুর হিন্দু দর্শনের সঙ্গে মিলে যায়। ইসলামের দৃষ্টিকোণ, তাওহিদ ও ধর্মীয় পবিত্রতা: ইসলাম তাওহিদ বা একেশ্বরবাদের উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। কুরআনে বলা হয়েছে, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করেছি” এই পূর্ণতা মুসলিমদের জীবনের সব ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ এবং রাসূলের (সা.) সুন্নাহ অনুসরণের নির্দেশ দেয়। রাসূল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি অন্য কোনো সম্প্রদায়ের সঙ্গে সাদৃশ্য স্থাপন করে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত”। এই হাদিস মুসলিমদের ইসলামের স্বকীয়তা রক্ষায় উৎসাহিত করে। পহেলা বৈশাখের উদযাপন হিন্দু ধর্মীয় আচার যেমন, সূর্য আরাধনা, গঙ্গাস্নান বা লক্ষ্মী-গণেশ পূজার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় এগুলো তাওহিদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। চৈত্র সংক্রান্তির আচার যেমন শিবের গাজন, নীল পূজা বা চড়ক পূজা, হিন্দু তান্ত্রিক সাধনার সঙ্গে জড়িত, যা ইসলামের একেশ্বরবাদের পরিপন্থী। মঙ্গল শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত প্রতীক যেমন পেঁচা বা সূর্য, হিন্দু পুরাণের সঙ্গে যুক্ত এবং মুসলিমদের জন্য ধর্মীয় সীমা অতিক্রম হিসেবে বিবেচিত। হালখাতা মুঘল আমলে ধর্মনিরপেক্ষ প্রথা ছিল, যা প্রায়শই লক্ষ্মী পূজার সঙ্গে মিশে যায় এবং এটাও ইসলামের দৃষ্টিকোণে অগ্রহণযোগ্য। ইসলাম সামাজিক মেলামেশা বা সাংস্কৃতিক রীতি পালনে বাধা দেয় না, যতক্ষণ তা তাওহিদ ও ধর্মীয় পবিত্রতার সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি না করে। কুরআনে বলা হয়েছে, “তোমরা মানুষের সঙ্গে সুন্দরভাবে কথা বলো”। মুসলিমরা তাদের হিন্দু প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে পারে, তাদের উৎসবে সম্ভাষণ জানাতে পারে। তবে পূজা বা ধর্মীয় আচারে অংশগ্রহণ ইসলামের নির্দেশনার বিপরীত। “হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি” একটি বিভ্রান্তিকর ধারণা: “হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি” হিসেবে পহেলা বৈশাখকে উদযাপনের ধারণা প্রায়শই হিন্দু ধর্মীয় ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় শিল্প ও সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত উপাদান প্রায়শই হিন্দু পুরাণের প্রতীক বহন করে। এটি বাঙালি সংস্কৃতির সর্বজনীনতার পরিবর্তে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে। ইসলামের দৃষ্টিকোণে এই ধরনের উৎসব পালন মুসলিমদের জন্য বিভ্রান্তিকর, কারণ এটি তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ইসলাম মুসলিমদের জন্য আনন্দ ও উৎসবের নির্দিষ্ট সময় ও পদ্ধতি নির্ধারণ করেছে। পহেলা বৈশাখের হিন্দু ধর্মীয় আচার বা মঙ্গল শোভাযাত্রার বহুত্ববাদী প্রতীক মুসলিমদের জন্য তাওহিদের পূর্ণতার পরিপন্থী। মুসলিমরা পহেলা বৈশাখে তাদের হিন্দু বন্ধুদের শুভেচ্ছা জানাতে পারে, তাদের আনন্দে সহযাত্রী হতে পারে, তবে পূজা, তান্ত্রিক প্রথা বা হিন্দু পুরাণের প্রতীকে অংশগ্রহণ ইসলামের শিক্ষার বিপরীত। উপসংহার: পহেলা বৈশাখ বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য একটি সমৃদ্ধ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হলেও, বাঙালি মুসলিমদের জন্য এটি ইসলামের তাওহিদ ও ধর্মীয় পবিত্রতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। মুঘল আমলে প্রবর্তিত বাংলা সন ধর্মনিরপেক্ষ উদ্দেশ্যে শুরু হলেও, আধুনিক সময়ে এর উদযাপন প্রায়শই হিন্দু ধর্মীয় প্রথা, যেমন সূর্য আরাধনা, লক্ষ্মী পূজা বা তান্ত্রিক আচারের সঙ্গে মিশে গেছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা ও “হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি”র ধারণা এই হিন্দু ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটায়, যা মুসলিমদের জন্য ধর্মীয় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। বাঙালি মুসলিমদের সংস্কৃতি ইসলামের শান্তি, তাওহিদ এবং মানবতার শিক্ষায় নিহিত। বাংলার মাটিতে শান্তি ও সম্প্রীতির স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য মুসলিমদের উচিত ইসলামের নির্দেশনা অনুসরণ করা, যা তাদের পরিচয় ও ঐতিহ্যের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটায়। মাহফুজ বিন মোবারকপুরী: প্রাবন্ধিক, ইতিহাস পাঠক, সমালোচক। |