![]() কর্মসংস্থানের বিষয়টি দেশের সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() স্বাধীনতার পর দেশে ধনী-দরিদ্রের সম্পদের বৈষম্য যেখানে ছিল ২.৪ শতাংশ, সেখানে এখন তা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। দেশে ধারাবাহিকভাবে দারিদ্র্যের হার কমলেও বেড়েছে আয়বৈষম্য। দেশের পরিসংখ্যানভেদে প্রায় ২০ লাখ তরুণ প্রতিবছর কর্মবাজারে প্রবেশযোগ্যতা লাভ করেন।তাঁদের মধ্যে অনেকেই কাজ পান না,অনেকে পেলেও যোগ্য কাজটি পান না কিংবা অনেকেরই আকাঙ্ক্ষিত পারিশ্রমিক মেলে না। বিনিয়োগ-কর্মসংস্থান আর দারিদ্র্য বিমোচন যেহেতু একই সূত্রে গাঁথা, তাই এখানে ক্রমাগত বিনিয়োগও প্রণিধানযোগ্য ভূমিকা পালন করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে, বিশেষত ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা সংকট চলছে। ডলার-সংকট ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে তাঁদের ওপর আর্থিক চাপ বেড়েছে। উল্লেখযোগ্য হারে ঋণ ও বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি হয়নি। বিদেশি বিনিয়োগও খুব বেশি বাড়ছে না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থানের ওপর, সেভাবে নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে না। যদিও প্রতিবছর কর্মক্ষম বিপুলসংখ্যক মানুষ চাকরির বাজারে যুক্ত হচ্ছেন। তাঁদের একটি বড় অংশই কাজ না পেয়ে বেকার থাকছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) শ্রমশক্তি জরিপে দেখা গেছে, গত বছরের শুরুতে বেকার মানুষ কম থাকলেও বছরের শেষে ধারাবাহিকভাবে এ সংখ্যা বেড়েছে। ওই জরিপ অনুযায়ী, দেশে ২৬ লাখ ৬০ হাজার বেকার আছেন। ২০২৩ সালের একই সময়ে গড় বেকারসংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার। এদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এক দশকে দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বেড়েছে গড়ে দেড় শতাংশ হারে। যদিও একই সময়ে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাবে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। যদিও তাঁদের বেশির ভাগই ছায়া বা প্রচ্ছন্ন বেকার বা আংশিক বেকার। অর্থাৎ তাঁদের শ্রমশক্তি পুরো কাজে আসছে না। বর্তমানে তাই বেকারত্বও বড় ধরনের সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতির জন্য। মূলত অর্থনীতির প্রতিটি খাত এভাবে চক্রাকারে একে অন্যকে প্রভাবিত করে। তাই একটা সমস্যার সমাধান ছাড়া অন্য সংকট থেকে উত্তরণ কঠিন হয়ে পড়ে। বেকারত্ব দূর করতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান। নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টিতে বিনিয়োগও আবশ্যক। আর বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে প্রয়োজন এর প্রতিবন্ধকতাগুলো, যেমন জ্বালানিসংকট, আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দূর করা। অর্থাৎ কর্মসংস্থানের বিষয়টি দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে জড়িত। গত দেড় দশকে সেভাবে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি হয়নি। এমনকি তথাকথিত উচ্চ প্রবৃদ্ধির সময়েও জিডিপির অনুপাতে কর্মসংস্থান বাড়েনি। আবার শ্রমবাজারে শোভন চাকরির অভাব রয়েছে। কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সিংহভাগই রয়েছেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। ঋণ প্রবৃদ্ধি না হওয়া, বিনিয়োগ স্বল্পতা, জ্বালানির অভাব ইত্যাদি কারণে বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হলেও সরকারি খাতেও খুব বেশি কর্মসংস্থান সৃজন হয়নি। এদিকে দেশের অর্থনীতির বড় অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক হওয়ায় উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। কারণ, তাঁরা উৎপাদন খাত ও কারখানা পর্যায়ে কাজ করতে সেভাবে আগ্রহী নন। আবার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মে নিশ্চয়তা নিয়ে ঝুঁকি রয়েছে এবং মজুরিও তুলনামূলক কম থাকায় এ খাতে উচ্চশিক্ষিত তরুণেরা যুক্ত হতে চান না। যদিও সরকারি চাকরিতে পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় একসময় মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের দিকে ঝুঁকে পড়েন। আবার বেসরকারি ও সরকারি চাকরিতে সুযোগ-সুবিধাজনিত ব্যবধান বাড়ায় তরুণেরা ঝুঁকেছেন সরকারি চাকরির দিকে। যদিও বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৩ অনুযায়ী,কেবল ৫ শতাংশ কর্মরত সরকারি চাকরিতে।যেখানে দেশে কোনো না কোনো কাজে যুক্ত থাকার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছেন সাত কোটির বেশি মানুষ, সেখানে সরকারি চাকরিতে জনবলের সংখ্যাও খুবই নগণ্য। মূলত এটি নির্দেশ করে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের অভাবকে। বিবিএসের ওই জরিপ বলছে, দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যুক্ত শ্রমজীবীর হার ৮৪। আর প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন মাত্র ১৬ শতাংশ। এ বাস্তবতায় সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টি বেকার সমস্যার সমাধানে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। এর জন্য শ্রমঘন শিল্পে বিনিয়োগের পাশাপাশি দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন খাতে জনবল নিয়োগ পরিকল্পনা নিতে হবে। বিশেষজ্ঞদেরও মতে, দেশে সরকারি চাকরিজীবীর হারও বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। তাই এ খাতে আরও বেশি লোকবল প্রয়োজন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আইনশৃঙ্খলার মতো জায়গায়ও আরও জনবল প্রয়োজন। তা ছাড়া সরকারি খাতে জনবল কম থাকার বেশ কিছু জটিলতা রয়েছে। বিভিন্ন খাতে সেবা প্রদান ও নীতিমালা বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। সরকারি খাতে পর্যাপ্ত জনবল না থাকলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, আইনশৃঙ্খলা ও সামাজিক নিরাপত্তা সেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোয় সেবা প্রদান বাধাগ্রস্ত হয়। আরেকটি প্রায় নির্মম বাস্তবতা হলো দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার বিচারে সবার জন্য চাকরির সুযোগ তৈরি করা সম্ভব নয়। তাই অধিকসংখ্যক উদ্যোক্তা তৈরির দিকেও নজর দিতে হবে। এ জন্য অন্যতম সম্ভাবনাময় হতে পারে বৃহত্তর কৃষি খাত-খামার ও অখামারি কৃষি খাত। একসময় জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল বেশি। দেশের শ্রমশক্তিও ছিল কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু গত অর্ধশতকে দেশের অর্থনীতির কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। কৃষিনির্ভরতা কাটিয়ে শিল্পের দিকে এগিয়েছে দেশ। জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান কৃষিকে ছাড়িয়ে গেলেও তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না শ্রমবাজারে। এ পরিস্থিতিতে কৃষিতে আধুনিকায়ন, যথাযথ প্রশিক্ষণ ও উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য উৎপাদনের সুযোগ থাকলে এ খাতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে। প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগেও বাংলাদেশের খুব বেশি মানুষ প্রযুক্তিনির্ভর আয়ের উৎসের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে পারছে না। দেশে নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অনেক এবং এই জনগোষ্ঠীর পক্ষে প্রযুক্তিগত জ্ঞান আহরণ বেশ কঠিন। জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হওয়া সত্ত্বেও দেশে নারীবান্ধব কর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধা বেশ নগণ্য। তাই পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজব্যবস্থায় বাংলাদেশের বেশিরভাগ নারীই গৃহবন্দি। প্রতি অর্থবছরে জরিপ চালাতে হবে দেশে কত শতাংশ মানুষ বেকার তার সঠিক তথ্য রাখার জন্য। বেকার জনগোষ্ঠীর সঠিক সংখ্যা, কারণ খুঁজে বের করলে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া সহজতর হবে। দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য সরকারকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগী হতে হবে। বাজেটে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে দক্ষ ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানে সমৃদ্ধ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলায়। গ্রাম ও শহরে যুবকদের পর্যাপ্ত মূলধনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে, যাতে তারা উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে। কেননা অনেকেই শুধু মূলধনের অভাবে নিজেদের দক্ষতা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেরও এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করি। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় গঠনমূলক পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অর্জিত জ্ঞান সহায়ক হয় পড়াশোনা শেষে কর্মসংস্থানে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানসংশ্লিষ্ট সেমিনার ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে এবং তরুণদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এসব অনুষ্ঠানে তাদের দক্ষ হয়ে গড়ে ওঠার জন্য এবং আয়ের নানাবিধ প্রয়োজনীয় গাইডলাইন দেওয়া হবে। দেশকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে নারীদের কর্মসংস্থানের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিতকরণ বিশেষভাবে জরুরি। এ ক্ষেত্রে পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা প্রয়োজন। দেশে যতদিন বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকবে ততদিন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ভাবে উন্নয়ন লাভ করতে পারবে না। প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্বে টিকে থাকার জন্য তাই যুবকদের কারিগরি দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জনের সুব্যবস্থা করে দেওয়ার বিকল্প নেই। কেননা তারাই অদূর ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, বেকারত্ব বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। তাই দেশের উন্নতি অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ সরকারকে বেকারত্ব নির্মূলের প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টিপাত করতে হবে। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |