/ অপরাধ / ‘আমাদের স্বজনদের ফিরিয়ে দাও’
‘আমাদের স্বজনদের ফিরিয়ে দাও’
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
১২ বছর আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৬ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর চৌধুরী আলম গুম হয়েছিলেন। গুম হওয়ার পর স্বজনরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে তাকে খোঁজাখুঁজি করেছেন। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাননি স্বজনরা। এখনও স্বজনরা তার অপেক্ষায় দিন পার করছেন। তার ছোট ভাই খুরশিদ আলম মিন্টু বলেন, আজ ১২ বছর ধরে আমার ভাই নিখোঁজ। তিনি দীর্ঘ ১৮ বছরের কাউন্সিলর ছিলেন। বিএনপি’র জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। এই সরকারের আমলে এমপি, কাউন্সিলর গুম হয়ে যান। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই আমার ভাই যদি বেঁচে নাও থাকে তবে তার লাশটা অন্তত দেন। আমরা তার কবরে একমুঠো মাটি দেয়ার অধিকার রাখি।
শুধু খুরশিদ আলম মিন্টু তার ভাইয়ের জন্য নয়, হাফসা ইসলাম রাইতাও তার বাবা মাজেদুল ইসলাম সুমনের সন্ধান পেতে এমন আকুতি জানিয়েছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে রাইতা বলেন, আমাকে আমার বাবার মতো গুম করে দেন। তাহলে আমার বাবার সঙ্গে দেখা হবে। আমার বাবাকে যদি মেরে ফেলা হয় তবে বাবার লাশটা দেন। আমি আমার বাবার লাশটা দেখতে চাই। তাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে চাই। গতকাল বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের ব্যানারে বিভিন্ন সময় গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের স্বজনরা মিলিত হয়ে মানববন্ধন করেছেন। মানববন্ধনে নিখোঁজ ব্যক্তিদের জন্য স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়েছিল প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণ। তাদের দাবি একটাই, নিখোঁজ স্বজনের ফেরত চান। হয় জীবিত না হয় অন্তত লাশটাও তারা ফেরত চান। হাতে ব্যানার, চোখে জল নিয়ে অন্তত অর্ধশতাধিক গুম হওয়া ব্যক্তির মা, বাবা, স্ত্রী ও সন্তানেরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নাগরিক সমাজ, শিক্ষক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এর আগেও অনেক স্থানে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা বলেছেন স্বজন হারিয়েছি তাদের ফেরত চাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করেছেন, মিনতি করেছেন আপনিতো নিজেও স্বজন হারিয়েছেন। স্বজন হারানোর দুঃখ আপনি বুঝেন তাই আমাদের স্বজনদের ফিরিয়ে দেন। আমি আগেও বলেছি এখনও বলছি ভবিষ্যতেও বলবো। একটা পরিবারের একজন সদস্য নিখোঁজ হয়েছে। অথচ পুলিশের কাছে গেলে পুলিশ বলছে মামলা-জিডি নিবে না। দেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের দেশে কোনো গুম নাই। কিছু কিছু লোক আছে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, ঋণ করতে পারছে না বা জমিজমা নিয়ে মামলা আছে সেই ভয়ে পালিয়ে গেছে। দেখেন কোনো ধানক্ষেতে লুকিয়ে আছে। তিনি বলেন, মানবতার পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হয়েছে এই ভুক্তভোগী মানুষগুলোর কাছে যান তারা কি করছে, কতটুকু কষ্টে আছে। কিন্তু যাননি। জাতিসংঘ থেকে সরকারকে ৫৪ জনের একটি তালিকা দিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল এই মানুষগুলো এখন কোথায় আমরা জানতে চাই। আজ পর্যন্ত কোনো তথ্য দেয়া হয়নি। পরে মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় কর্মকর্তা দেশে এসেছিলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাকে শুনিয়েছেন ’৭৫-এর পরে দেশে কীভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, যারা এখানে দাঁড়িয়ে স্বজন ফিরে পাওয়ার জন্য কান্না করছেন তাদের ফরিয়াদ তারা এক কান দিয়ে শুনবে আর আরেক কান দিয়ে বের করবে। কেউ স্বজন ফিরে পাবে না। স্বজনরা যে জীবিত আছেন তার কোনো গ্যারান্টি নাই। তবে একটা জিনিস বোঝা গেল আয়না ঘর আবিষ্কারের পরে। এভাবেই মানুষকে গুম করে রাখা হয়। শুধু ওই আয়না ঘর নয়, সব বাহিনীরই আয়না ঘর আছে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী খুবই ভাগ্যবতী। তিনি সম্প্রতি বলেছেন বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয় তখন এত বড় আওয়ামী লীগ পালিয়ে গিয়েছিল। কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু তিনি ভাগ্যবতী কারণ ওনার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী সত্য কথা বলেছেন। আমি তার বিচার চাচ্ছি না। সত্য কথা বলার জন্য তাকে অভিনন্দন জানাই। দ্বিতীয় আরেকটা ব্যক্তি থাকতে পারেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল। তিনি বলেন, আপনাদের যে যাবার সময় হয়েছে সেটি প্রতিটা পদক্ষেপে আপনি বুঝতে পারছেন। আপনার হুকুম পুলিশ মানছে না। মায়ের ডাকের ব্যানারে যারা আজকে এখানে এসেছেন তাদের পাশে দাঁড়ানো সবার নৈতিক দায়িত্ব। আমারও নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। আজকে আমার ডায়ালাইসিস ছিল। সেটা বাদ দিয়ে আমি এখানে এসেছি। সংহতি প্রকাশ করার জন্য। তিনি বলেন, অত্যাচার করে কিছুদিন থাকা যায়। সবসময় থাকা যায় না। আমাদের দুর্ভাগ্য শত শত মা-বোন সন্তান তাদের স্বজনকে পাচ্ছে না। কী অপরাধ ছিল তাদের? শুধু স্ল্লোগান দিয়েছিল। জাফরুল্লাহ বলেন, আমাদের সরকারতো জনগণের ভোটের সরকার না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সহজ- সরল ব্যক্তি। মুখ ফসকে সত্য কথাটা বের হয়েছে। মনের কথাটাই বলেছেন। তাকে পুরস্কৃত করে ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার করা দরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল বলেন, সরকারের কাছে যখন গুমের অভিযোগ করা হয় তখন তারা অস্বীকার করে বলে, এই লোকগুলো মামলা ও ঋণের ভয়ে পালিয়ে আছে। কিন্তু তাদের শিশু-সন্তানের চোখে পানি দেখি, বাবা-মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ দেখি কোনো বিচার চাইনা লাশটা অন্তত এনে দেন। আমি দোয়া করতে চাই। এ সবের পরেও যখন মন্ত্রীদের এসব কথা শুনি তখন মনে হয় কতটুকু নিষ্ঠুর পাষাণ হলে চোখের পানির দিকে তাকিয়ে এসব কথা বলা যায়। বিপ্লবী ওয়াকার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, নেত্র নিউজ আয়না ঘরের যে সংবাদটা প্রকাশ করেছে এজন্য আমাদের দলের পক্ষ থেকে শুরু করে গণতন্ত্র মঞ্চ ও প্রত্যেকটা বিরোধী দল দাবি করেছে গুম ব্যক্তিদের কীভাবে অত্যাচার করা হচ্ছে, কীভাবে তাদের একেকটা দিন-রাত কেয়ামতের মতো গজব নেমে আসছে। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করতে চাই এতদিন পার হয়েছে আয়না ঘরের ব্যাপারে আপনাদের বক্তব্য কী? এটা নিয়ে আপনাদের সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বিবৃতি দিয়েছেন? কোনো ব্যাখ্যা দিয়েছেন বা বিকল্প কোনো তথ্য হাজির করেছেন? গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকি বলেন, বারবার এখানে এসে আমাদেরকে একই কথা বলতে হচ্ছে। গুম পৃথিবীর ইতিহাসে নিকৃষ্টতম অপরাধ। মানুষকে নাই করে দেয়া। আজকে সরকার এই গুমকে নানাভাবে জায়েজ করছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জঙ্গি দমন নানা কথা তারা বলে। একটা রাষ্ট্র বল প্রয়োগ করার জন্য কতগুলো বাহিনী তৈরি করে। আর তারা যদি আইন ভঙ্গ করে গুলি করে, মানুষ হত্যা করে তবে এই বাহিনীর আর কোনো ন্যায্যতা থাকে না। ওই রাষ্ট্রেরও কোনো ন্যায্যতা থাকে না। এই সরকার গদি রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের ন্যায্যতাকে আজ ধ্বংস করে দিয়েছে। সবাই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা বলছে। আমি তাকে ধন্যবাদ দেই ঠিকই। কারণ তিনি সত্য কথাটা পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি যা বলেছেন তা অপরাধ। কারণ তিনি দেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে হস্তক্ষপ করার আহ্বান জানিয়েছেন। দিল্লীতে গিয়ে শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখার অনুরোধ জানিয়ে এসেছেন। শুধু তাই নয় এই সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার সেটিও বলে এসেছেন। এজন্য তাকে তার পদ থেকে অপরসারণ করে বিচারের মুখোমুখি করার কথা। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী ও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে মামলা রুজু করার কথা। আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অপসারণ নয় তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। |