/ শিল্প ও সাহিত্য / যৌনতা, বইয়ে নিষেধাজ্ঞা, বিতর্ক তুঙ্গে
যৌনতা, বইয়ে নিষেধাজ্ঞা, বিতর্ক তুঙ্গে
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
রঙিন প্রচ্ছদে বড় অক্ষরে লেখা বইয়ের নামটিই বেশ ঝাঁঝালো। ‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’-এক্টিভিস্ট ও তরুণ লেখিকা জান্নাতুল প্রীতির লেখা নতুন বইটি শুরু থেকেই ছিল আলোচনায়। লেখিকার ব্যক্তিগত জীবনের খোলামেলা বিবরণে সাজানো বইটি নিয়ে পাঠক মহলেও সাড়া পড়ে। নালন্দা প্রকাশনী থেকে বের হওয়া বইটি অল্প সময়ের মধ্যে উঠে এসেছিল পাঠক চাহিদার শীর্ষে। তবে কাটতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বইটি বিতর্কের মুখে পড়ে এর ভেতরে থাকা দেশের বিনোদন জগতের বেশ কয়েকজন সেলিব্রেটি, রাজনৈতিক নেতা সম্পর্কে স্পর্শকাতর তথ্যের কারণে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সব মহলে এ নিয়ে ক্রমাগত আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিতর্কের মুখে গ্রন্থমেলা থেকে বইটি নিষিদ্ধ করে মেলা তদারকিতে গঠিত টাস্কফোর্স। এর আগে আদর্শ প্রকাশনীর একটি বইয়ের ব্যাপারে আপত্তি তোলে বাংলা একাডেমি। ‘নীতিমালা লঙ্ঘন’ হওয়ার কারণ দেখিয়ে জান্নাতুল প্রীতির বইটির উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় বইমেলায় গঠিত টাস্কফোর্স। অশ্লীলতা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন না অন্য কোনোভাবে সেটি লঙ্ঘিত হয়েছে সে ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি তাদের পক্ষ থেকে।
বইটি ইতিমধ্যে সংগ্রহ করে পড়েছেন এমন অনেকের মতে- খোলামেলা লেখনীর পাশাপাশি দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেকের নাম আসায় বইটি নিষিদ্ধের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের উপর চাপ থাকতে পারে। লেখিকা জান্নাতুল নাঈম প্রীতি বর্তমানে প্যারিসে অবস্থান করছেন। গণমাধ্যম থেকেই তিনি তার বইয়ের উপর দেয়া নিষেধাজ্ঞার খবর জানতে পারেন। নিষিদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় টেলিফোনে এই তরুণ লেখিকা বলেন, একটি বই ভালো না খারাপ সেই সিদ্ধান্ত বইটি পড়ে পাঠক জানাবেন। তাদের সেই সুযোগ না দিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রক্রিয়া অনুসরণ করা ছাড়াই রাতারাতি যেভাবে আমার লেখা বইটি নিষিদ্ধ করা হলো সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক। বাংলাদেশে যে একজন সাধারণ মানুষের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই এর মাধ্যমে তা আরও একবার প্রমাণিত হলো। তবে বই নিষিদ্ধ হলেও নিজ চিন্তা ও দর্শনের প্রতিফলন আগামীতেও লেখনীতে তুলে আনবেন বলে জানান এই লেখিকা। ‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’ বইটি নিষিদ্ধের ব্যাপারে বইমেলা তদারকিতে গঠিত টাস্কফোর্সের সভাপতি ও বাংলাদেশ শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অসীম কুমার দে বলেন, বইটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের পর আমাদের মনে হয়েছে সেটি বইমেলার নীতিমালা মেনে প্রকাশিত হয়নি। এতে একাধিক সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গের নামে আপত্তিকর ও অপমানজনক তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। তাই প্রকাশককে বইটি স্টল থেকে সরিয়ে ফেলতে মৌখিকভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে কোনো মহলের চাপ ছিল কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্যদের ছিল কি-না জানি না তবে আমার ওপর কোনো ধরনের চাপ ছিল না। নিষিদ্ধের পরেও জান্নাতুল প্রীতির লেখা বইটি নিয়ে বিতর্ক থামেনি। বইমেলা থেকে বইটি সরিয়ে নেয়ার পর থেকে এর পক্ষে-বিপক্ষে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ব্যাপারে মতামত দিতে গিয়ে অনেকে বইমেলা কর্তৃপক্ষের নেয়া এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। তাদের ভাষ্য, নিষিদ্ধের মাধ্যমে কোনো বইকে পাঠকের মন থেকে মুছে ফেলা যায় না। তবে অনেকে আবার লেখিকার সমালোচনা করছেন, যথার্থ তথ্য-উপাত্ত ও প্রমাণ ছাড়া সেলিব্রেটিদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে স্পর্শকাতর তথ্য দেয়া কতোটা যুক্তিযুক্ত সে প্রশ্নও তুলছেন অনেকে। যুক্তরাষ্ট্রের বার্ড কলেজের ভিজিটিং প্রফেসর ফাহমিদুল হক ‘(অ) প্রীতিকর বিতর্ক’ শিরোনামে দেয়া ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘যৌনতা নিয়ে প্রীতির যে দর্শন, তা নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই, এ তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে ‘বিখ্যাত’ লোকগুলো সম্পর্কে সে যা যা লিখেছে, তার কতকগুলো দিক নিয়ে আমার অনাপত্তি থাকলেও, কতকগুলো দিক নিয়ে অবজারভেশন বা আপত্তি আছে।’ ফাহমিদুল হকের মতে, কোনো বিচারই একটা বই নিষিদ্ধ হতে পারে না। একটি বইয়ে যদি ’ক্ষতিকর’ উপাদান থাকে বলে মনে হয়, তবে তাকে কনডেম করা যাবে, বকাঝকা করা যাবে, আরও লেখালেখি করা যাবে তা নিয়ে, কিন্তু সীমিত আকারে হলেও, নিষিদ্ধ করা যাবে না। ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের জন্য বই নিষিদ্ধ করার পক্ষে নন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট লেখক ড. আসিফ নজরুল। তার মতে, বইয়ে কারও বিরুদ্ধে আপত্তিকর কিছু লেখা হলে তিনিও প্রতি-উত্তরে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বই লিখতে পারেন। কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যমে বিবৃতি দিতে পারেন। বইয়ের মুদ্রিত কপি নিষিদ্ধ করে কোনো তথ্যকে চেপে রাখা যায় না। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বইয়ের পিডিএফ কপি হাজার হাজার মানুষের কাছে চলে যায়। ডিজিটাল যুগে বই নিষিদ্ধ করে লাভ হয় না। বইয়ে ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে অপরাধ কি-না-এমন প্রশ্নের জবাবে ড. আসিফ নজরুল বলেন, এই ধরনের ঘটনায় সংক্ষুব্ধরা মানহানি মামলা করতে পারেন। যদিও আমাদের দেশে মানহানি মামলার সংখ্যা খুব কম। তাই বই প্রকাশের কারণে মামলার বিষয়টি জটিল। এক্ষেত্রে তথ্য-প্রমাণ হিসেবে কী দেখানো হচ্ছে তা বিবেচনার বিষয়। প্রকাশিত তথ্যের বিপরীতে বাদী-বিবাদীরা কী ধরনের সাপোর্টিং ডকুমেন্ট দিতে পারবে সেটাও দেখতে হবে। প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করে লেখা বই প্রকাশের অভিযোগে এবারের একুশে বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ থেকে বিরত থাকে বাংলা একাডেমি। বইটি হচ্ছে- ফাহাম আবদুস সালামের লেখা ‘বাঙালির মিডিওক্রিটির সন্ধানে’। জিয়া হাসানের ‘উন্নয়ন বিভ্রম’ এবং ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের ‘অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবনীয় কথামালা’ নিয়েও বিতর্ক তৈরি। পরবর্তীতে হাইকোর্ট শর্তসাপেক্ষে আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দের নির্দেশ দিলেও আপিল বিভাগ তা স্থগিত করে দেন। |