/ মতামত / যে কারণে থাইল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী হলেন পেতংতার্ন
যে কারণে থাইল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী হলেন পেতংতার্ন
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
থাইল্যান্ড এখনও একটি ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রে ভরা দেশ। গত বছরের ২০ মার্চ তাই পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, এবং পরের ৪৫ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার কারণে ১৪ মে নির্বাচনের দিন ঘোষিত হয়েছিল। সঙ্গেসঙ্গেই তার জন্য প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রয়ুত চ্যান-ও-চা’র অধীনে আধা-সামরিক নেতৃত্বের শাসনের অবসানের দাবিতে তাইল্যান্ডে বর্তমানে নাগরিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক রাজনৈতিক প্রার্থীদের মধ্যে ছিলেন পেতংতার্ন শিনাওয়াত্রা। ইনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার কন্যা এবং তাইল্যান্ডের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইংলাক চিন্নাওয়াতের দাদার মেয়ে, যাঁদের দুজনকেই যথাক্রমে ২০০৬ ও ২০১৪ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হয়েছিল৷ এই ধরনের ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে তাই জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যতের জন্য বাজিগুলি এখন উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চমাত্রার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই জাতীয় রাজনীতির অস্থির গতিশীলতা ফেউ তাইয়ের পক্ষে সামরিকপন্থী জোটের দ্বারা প্রভাবিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতাবস্থা ভাঙতে একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে কাজ করে। পেতংতার্নের মনোনয়নকে জনসাধারণ একটি ইতিবাচক ও স্বাগত ঘটনা হিসাবে দেখা হয়েছিল। তাই, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও, সামরিক প্রভাবকে উল্লেখযোগ্য ভাবে কমাতে না পারলে বিরোধীরা আকস্মিকভাবে এই ধরনের পরিবর্তন করতে সক্ষম হবে না বলে ধারণা করেছিলেন বিশ্লেষকরা। শেষ পর্যন্ত থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ধনকুবের থাকসিন সিনাওয়াত্রার মেয়ে পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রাকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করেছে দেশটির পার্লামেন্ট। ৩৭ বছর বয়সী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা হবেন দেশটির সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী। এর আগে তার ফুফু ইংলাক সিনাওয়াত্রা থাইল্যান্ডের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্রেথা থাভিসিনকে সাংবিধানিক আদালত পদচ্যুত করেছেন। এর দুদিন পর পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রাকে নতুন ও সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেছে দেশটির পার্লামেন্ট। নতুন ও সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন। ফিউ থাই পার্টির নেতা স্রেথা থাভিসিনকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণে পার্লামেন্টের ৪০ জন সিনেটর একটি পিটিশন দাখিল করেছিলেন। চলতি বছর সাংবিধানিক আদালতের বিচারকেরা ছয়-তিন ভোটে পিটিশনটি গ্রহণ করেন। স্রেথার বিরুদ্ধে অভিযোগ, দুর্নীতি ও আদালত অবমাননার দায়ে ২০০৮ সালে ছয় মাসের কারাদণ্ড পাওয়া সাবেক আইনজীবী পিচিট চুয়েনবানকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন তিনি। পিচিটের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি আদালতের কর্মীদের একটি ব্যাগে ২০ লাখ বাথ অর্থাৎ ৫৫ হাজার ২১৮ ডলার ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করেন। ওই সিনেটরদের যুক্তি, দণ্ডপ্রাপ্ত পিচিটকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে নৈতিকতার মান লঙ্ঘন করেছেন স্রেথা। সমালোচকদের অনুমান ছিল এটি।২০০৭ সালে ফিউ থাই পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও ধনকুবের থাকসিন সিনাওয়াত্রার সঙ্গে পিচিটের যোগাযোগ তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হতে সহায়তা করে। সম্প্রতি স্রেথাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অপসারণ করেন ব্যাংককের সাংবিধানিক আদালত। গত ১৬ বছরের মধ্যে তিনি হলেন থাইল্যান্ডের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী, যাঁকে সাংবিধানিক আদালত ক্ষমতাচ্যুত করলেন। যদিও পদচ্যুত প্রধানমন্ত্রী স্রেথাও একই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পার্লামেন্টের ৪৯৩ আসনের মধ্যে তাঁর দল ও জোটের আসন ৩১৪টি। প্রধানমন্ত্রী হতে বর্তমান আইনপ্রণেতাদের অন্তত অর্ধেক সংখ্যকের সমর্থন প্রয়োজন ছিল তাঁর। পার্লামেন্টে অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে পেতংতার্নের পক্ষে ৩১৯টি ভোট পড়ে, আর বিপক্ষে পড়ে ১৪৫টি। তাই সহজেই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন পেতংতার্ন। পেতংতার্ন ব্যাংককের চুলালংকর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। উং-ইং ডাকনামেও পরিচিত পেতংতার্ন। তিন বছর আগে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তিনি। এর আগে তিনি পারিবারিক হোটেল ব্যবসা পরিচালনায় সহায়তা করতেন।পেতংতার্নের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ২০২১ সালে। ওই সময় ফিউ থাই পার্টির ইনক্লুশন অ্যান্ড ইনোভেশন অ্যাডভাইজরি কমিটির প্রধান হন তিনি। ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে দ্বিতীয় সন্তানের মা হন পেতংতার্ন। নির্বাচনে তিনি ছিলেন একজন জনপ্রিয় প্রার্থী।পেতংতার্ন থাকসিন পরিবার থেকে দেশের শীর্ষ পদে আরোহণ করা তৃতীয় ব্যক্তি। তাঁর বাবা থাকসিন থাই রক থাই পার্টি থেকে ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০৬ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগপর্যন্ত এ পদেই ছিলেন তিনি। থাকসিনের বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রা ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী হন। ২০১৪ সালে সাংবিধানিক আদালত তাঁকে এ পদ থেকে অপসারণ করেন। একই বছর আরেক সামরিক অভ্যুত্থানে কয়েক মাসের জন্য রাজনৈতিক অস্থিরতায় পড়ে থাইল্যান্ড। ওই ঘটনার পর গ্রেপ্তার এড়াতে থাকসিন ও ইংলাক দুজনই দেশ ছেড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যান। গত বছরের আগস্টে দেশে ফেরেন থাকসিন। এখন পেতংতার্ন থাইল্যান্ডের সবচেয়ে কনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিলেন। তা ছাড়া তিনি হচ্ছেন দেশটির দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রীও। এর আগে তাঁর ফুফু ইংলাক সিনাওয়াত্রা দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। রাজ পরিবারের প্রতি অনুগত সামরিক বাহিনী ও ফিউ থাই পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনতুষ্টিবাদী দলগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার লড়াই চলার মধ্যে নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন পেতংতার্ন। ২০১৪ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর সেনাপ্রধান জেনারেল প্রায়থ চান-ও-চা বলেন, তিক্ত রাজনৈতিক বিভক্তি ও সরকারের মধ্যে অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে তাঁরা হস্তক্ষেপ করেছেন। তিন বছর পর ২০১৭ সালে সামরিক সরকার নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করে জান্তা সরকার। দীর্ঘ বিলম্বের পর ওই বছর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সদ্য পদচ্যুত প্রধানমন্ত্রী স্রেথার অধীন ফিউ থাই পার্টি ২০২৩ সালে সেনাবাহিনীর সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে। এ বাহিনীই ২০১৪ সালে ফিউ থাই পার্টির সরকারকে উৎখাত করেছিল। এর আগে স্বঘোষিত গণতন্ত্রপন্থী ফিউ থাই পার্টি ‘মুভ ফরওয়ার্ডস পার্টি’র (এমএফপি) সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। কিন্তু ২০২৩ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তিন মাস পর এমএফপি জোট ছাড়ে। রাজতন্ত্রের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নেয় এমএফপি। ২০২৩ সালের নির্বাচনে দলটি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলেও সামরিক বাহিনী সমর্থিত সিনেট তার সরকার গঠনের পথ আটকে দেয়। পরে ফিউ থাই সরকার গঠন করে। এরপর গত ৭ আগস্ট সাংবিধানিক আদালত এমএফপিকে ভেঙে দেন এবং এর নির্বাহী পর্ষদের সদস্যদের ১০ বছরের জন্য রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করেন। থাইল্যান্ডের কঠোর রাজকীয় মানহানি আইন সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দলটি। পেতংতার্ন গত বছর প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য প্রচার চালান।ওই সময় তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে ছিল ব্যাংককে গণপরিবহনের খরচ কমানো, স্বাস্থ্যসেবার আওতা বাড়ানো এবং দৈনিক ন্যূনতম মজুরি দ্বিগুণ করা।প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম দায়িত্বপালনকালে পেতংতার্নকে দেশের ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি, তাঁর দলের প্রতি জনসমর্থন কমে যাওয়া, বিরোধীদের সম্ভাব্য উত্থানের মতো বিষয়গুলো মোকাবিলা করতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। পিচিটকে ২০০৮ সালে দুর্নীতির দায়ে যে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, তা স্রেথার অজানা থাকার কথা নয় বলে মন্তব্য করে বিচারক পুণ্য বলেন, কিন্তু তা বিবেচনায় না নিয়ে পিচিটকে মন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে স্রেথা অসততার পরিচয় দিয়েছেন এবং নৈতিক মানদণ্ড লঙ্ঘন করেছেন। স্রেথার বিরুদ্ধে নৈতিকতার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠার পর পিচিট মন্ত্রিসভা থেকে আগেই পদত্যাগ করেছিলেন।উল্লেখ্য,প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে স্রেথাকে সরিয়ে দিতে গত মে মাসে প্রায় ৪০ জন সিনেটর আবেদন করলে আদালত তা গ্রহণ করেন।এদিকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সাংবাদিকদের স্রেথা বলেন,'আমি আদালতের রায়কে সম্মান করি। তবে আমি আবারও জোর দিয়ে বলছি, প্রায় এক বছরের মতো যে সময়টা আমি ক্ষমতায় ছিলাম, ভালো মনমানসিকতা নিয়ে সৎভাবেই দেশ শাসন করতে চেয়েছিলাম।’স্রেথাকে পদচ্যুত করার এক সপ্তাহ আগে দেশটির প্রধান বিরোধী দল মুভ ফরোয়ার্ড পার্টিকে (এমএফপি) বিলুপ্ত ঘোষণা করেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজতান্ত্রিক দেশটির এই একই আদালত। তখন প্রগতিশীল দলটির সাবেক প্রধান পিটা লিমজারোয়েনরাতকেও রাজনীতি থেকে এক দশকের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এক বছরের কম সময়ের মধ্যে স্রেথা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদচ্যুত হওয়ায় দুই দশক ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভোগা দেশটিতে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। গত ২০ বছরে সেনাবাহিনী, রাজতন্ত্রের অনুগত রাজনৈতিক দল ও প্রগতিশীল দলগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে দেশটিতে কয়েকবার সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে, বড় বড় বিক্ষোভ হয়েছিল। যার ফলশ্রোতিতে থাইল্যান্ডের এই পরিবর্তন এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর পেতংতার্ন বলেন, দেশের অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে আমাদের দল ও জোটের শরিকেরা নেতৃত্ব দেবে, এ বিষয়ে আমরা আত্মবিশ্বাসী। এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে তাঁর এই স্থিতিশীলতা কতদিন থাকে সেটাই এখন দেখার বিষয়। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |