আজ শনিবার, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
 / ফিচার / লাদেন যেভাবে আফগান নেতা আহমদ শাহ মাসুদকে খুন করিয়েছিলেন
লাদেন যেভাবে আফগান নেতা আহমদ শাহ মাসুদকে খুন করিয়েছিলেন
নতুন বার্তা, ঢাকা:
Published : Monday, 16 September, 2024 at 1:47 AM
লাদেন যেভাবে আফগান নেতা আহমদ শাহ মাসুদকে খুন করিয়েছিলেনকাবুল বিমানবন্দরে বছর দুয়েক আগে পর্যন্তও সবথেকে প্রথমেই যেটা নজরে আসত সেটা আহমেদ শাহ মাসুদের একটা বিরাট বড় পোস্টার। শুধু তাই নয়, কাবুলের প্রধান ট্র্যাফিক সার্কেলের নামকরণও করা হয়েছিল তাঁর নামে। কিন্তু তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পরে সবকিছু বদলে গেছে।
প্রথমেই তো কাবুল বিমানবন্দরে তার ছবিটা ছিঁড়ে ফেলা হয় আর তার নামে যেসব জায়গার নামকরণ হয়েছিল, সেগুলোও বদলিয়ে ফেলা হল। তবে আফগানিস্তানের বহু মানুষের কাছেই তিনি এখনও জাতীয় বীর।

মাও, চে এবং মাসুদ

মার্কিন লেখক রবার্ট কেপলন একজন গেরিলা কমান্ডার হিসাবে আহমদ শাহ মাসুদকে মাও সে তুং এবং চে গুয়েভারার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
তার সম্প্রতি প্রকাশিত জীবনী ‘আফগান নেপোলিয়ন: দ্য লাইফ অফ আহমদ শাহ মাসুদ’-এর লেখক স্যান্ডি গল লিখেছেন: "এমনকি তার রাশিয়ান বিরোধীরাও তাদের এই প্রতিপক্ষের প্রাণশক্তির তারিফ করতেন, যাকে আট বছর ধরে অন্তত নয়টি রাশিয়ান হামলা সামলাতে হয়েছে। তিনি সারা জীবন তালেবানের সবচেয়ে বড় বিরোধী ছিলেন।
“বহু মানুষ তার বুদ্ধিমত্তা, নম্রতা, সাহস এবং ফার্সি সাহিত্যে তার জ্ঞানের প্রশংসা করেন। তার জীবনের ২২ বছর বয়স থেকে ৪৯ বছর পর্যন্ত পুরোটাই তার যুদ্ধ করেই কেটে গেল,” লিখেছেন স্যান্ডি গল।

তালেবান শিবির থেকে জীবিত ফেরা

তালেবানের মতো তিনিও আল-কায়েদার সঙ্গে কখনো আপস করেননি। আফগান প্রতিরোধের অন্যান্য যোদ্ধারা বিদেশী সমর্থনের আশায় দেশের বাইরে যেতেন, কিন্তু সোভিয়েত দখলদারি চলাকালীন তিনি কখনও নিজের দেশ ছেড়ে যান নি। পঞ্জশিরে খুব কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেই তিনি লড়াই চালিয়ে গেছেন।
ব্যক্তিগতভাবে তিনি সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন। তার বিরুদ্ধে কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার বা দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়নি।
একজন ব্রিটিশ অফিসার তাকে যুগোস্লাভিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মার্শাল টিটোর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
স্যান্ডি গল লিখেছেন, "তালেবানরা যখন কাবুলের দিকে এগোচ্ছে, তখন তিনি তার সহযোদ্ধাদের বারণ সত্ত্বেও একটা সমঝোতা করার জন্য তালেবান শিবিরে একাই চলে গিয়েছিলেন। তার সঙ্গীদের আশঙ্কা ছিল যে শিবিরে যাওয়া মাত্রই তাকে তালেবানরা মেরে ফেলবে কিন্তু তার ব্যক্তিত্বের প্রভাব এতটাই ছিল যে তিনি সেখান থেকে জীবিতই ফিরে এসেছিলেন।“
আহমেদ শাহ মাসুদকে জীবিত ফিরে যেতে দেওয়ার জন্য মোল্লা ওমর তার নিজের এক কমান্ডারকেই বরখাস্ত করেছিলেন।
তিনি বই পড়তে এতটাই ভালবাসতেন যে ১৯৯৬ সালে যখন তাকে কাবুল ছাড়তে হয়েছিল, তখন তিনি সঙ্গে করে দুই হাজার বই নিয়ে গিয়েছিলেন।

তালেবানের সামনে কখনো মাথা নিচু করেন নি

রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আহমদ শাহ মাসুদ একটি খুব সহজ কিন্তু কার্যকর কৌশল গ্রহণ করেছিলেন।
এ আর রোয়ান তার ‘অন দ্য ট্রেইল অফ লায়ন আহমেদ শাহ মাসুদ’ বইয়ে লিখেছেন, "রাশিয়ানদের ঘাঁটিতে রকেট ও মর্টার শেল ফেলার আগে শিবির থেকে প্রবেশ ও প্রস্থানের রাস্তায় অসংখ্য ল্যান্ডমাইন বিছিয়ে দিতেন, যা তার সৈন্যরা আগে থেকেই জানত। কিছুক্ষণ গোলা ছোঁড়ার পরে তারা ল্যান্ডমাইনগুলি এড়িয়ে তাদের (রাশিয়ানদের) ওপর হামলা চালাত। হামলা এড়াতে রুশ সৈন্যরা যখন বাইরে থেকে সহায়তা আনার চেষ্টা করত তখন তারা তারা সবাই ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণের শিকার হতো।“
কয়েক মাসের লড়াইয়ের পরে রাশিয়ানরা পঞ্জশির উপত্যকা ছেড়ে চলে যায়। পরে তারা এই উপত্যকায় নয়বার আক্রমণ করে এবং প্রতিবারই মাসুদ তাদের পিছু হঠতে বাধ্য করেন।
পাকিস্তানের বিপুল সমর্থন এবং সংখ্যায় তিনগুণ হওয়া সত্ত্বেও তালেবানরা কখনও মাসুদকে পরাজিত করতে পারেনি।
উপত্যকার মুখে অবস্থিত সালাং টানেলটি মাসুদ ডায়নামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেন এবং নিজেই নিজের এলাকায় অবরুদ্ধ করে ফেলেন। তারপর তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন যাতে তারা নিজেদের এলাকা রক্ষা করতে সর্বস্ব দিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকে।

বোমা হামলার মধ্যেও অবিচল

রাশিয়ার এক বিমান হামলার সময় স্যান্ডি গল আহমদ শাহ মাসুদের পাশে বসেছিলেন।
গল লিখেছেন, ''আমি যখন মাসুদের সঙ্গে হাত মেলালাম, তখন প্রথম যেটা লক্ষ্য করলাম তা হলো তার চোখ। সে দুটো ছিল একজন বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের চোখ। সে সময় তার চেহারায় যে বিচক্ষণতার ছাপ ছিল, সেটা ২৮ বছর বয়সী কোনও এক তরুণের মধ্যে খুব কমই দেখা যায়। আমরা যখন ঠিক বসতে যাচ্ছি, তখনই মাথার ওপর দিয়ে রাশিয়ার বিমান উড়ে গেল। মাসুদ ও তার সঙ্গীরা দ্রুত পাশের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল, ইশারায় আমাকেও সঙ্গে আসতে বলল।''
তিনি আরও লিখছেন, "বোমা হামলার মধ্যই চা খেতে খেতে মাসুদ কাছে আসা চিঠিগুলি পড়ে সেগুলোর উত্তর লিখেছিলেন। তার স্টাইল দেখে মনে হচ্ছিল যেন তিনি অর্ডার দিচ্ছেন। আমি তার আত্মবিশ্বাস আর সাহস দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন পরিস্থিতির ওপর তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তিনি কখনো ইংরেজি শেখেন নি, তবে তিনি খুব সাবলীলভাবে ফরাসি ভাষায় কথা বলতেন।“

সাংবাদিকের ভেক ধরে আসে খুনিরা

ওসামা বিন লাদেনও প্রাথমিকভাবে রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মি. মাসুদের সঙ্গেই ছিলেন, কিন্তু পরে মাসুদের সঙ্গে তার গভীর মতবিরোধ তৈরি হয় এবং তিনিই আহমেদ শাহ মাসুদকে খুন করান।
আরবের দুজন সাংবাদিক ২০০২ সালের আগস্টে আহমেদ শাহ মাসুদের সাক্ষাৎকার নিতে আসেন। তাদের কাছে বেলজিয়ামের পাসপোর্ট ছিল। পরে জানা যায়, তারা বেলজিয়াম দূতাবাস থেকে ওই পাসপোর্টগুলো চুরি করেছিল। আসলে মাসুদকে হত্যা করার জন্য আল কায়েদা তাদের পাঠিয়েছিল।
তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ৩৯ বছর বয়সী আব্দেসাত্তার দহমানে আর দ্বিতীয় ব্যক্তির নাম ছিল বোয়ারি-আল-কইর। তার বয়স ছিল ৩১ বছর। দুজনেই বেশ লম্বা আর ছিলেন। একজনের চেহারা বক্সারদের মতো ছিল। দুজনের কারোই দাড়ি ছিল না। প্যান্ট-শার্ট পরতেন দুজনেই। মাসুদের নির্দেশে ওই এলাকার কমান্ডার বিসমিল্লাহ খান তাদের নিতে একটি গাড়ি চেক পয়েন্টে পাঠিয়েছিলেন।
মাসখানেক আগে পশতুন নেতা আবদুল রসুল সায়েফ তার পুরনো মিশরীয় বন্ধু আবু হানির কাছ থেকে ফোন পান যাতে যে কোনও ভাবে তার দুই আরব বন্ধুকে আহমদ শাহ মাসুদের সাক্ষাৎকারের সুযোগ করে দেওয়া যায়। দুজনেই প্রথমে লন্ডন থেকে ইসলামাবাদে যান এবং সেখান থেকে কাবুলে পৌঁছন। সেখান থেকে তারা পৌঁছন পঞ্জশিরে। বেশ কয়েক দিন তারা সায়েফের অতিথি হয়ে ছিলেন।

খুনিদের সঙ্গে নাস্তা ব্রিটিশ লেখকের

স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে দেওয়া এক বিবৃতিতে আমরুল্লাহ সালেহ বলেন, “পঞ্জশেরি চালক আফগান কর্তৃপক্ষকে বলেছেন যে ওই দুই ব্যক্তি তাকে সাবধানে গাড়ি চালাতে বলছিলেন, কারণ তাদের কাছে কিছু নাজুক সরঞ্জাম ছিল।“
ওই এলাকার কমান্ডার বিসমিল্লাহ খান আরও উল্লেখ করেন যে, যদিও দুজনের দাড়ি ছিল না, তবে তাদের চিবুকের পাশের চামড়া হলুদ ছিল, যা থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে তাদের বড় দাড়িই ছিল, কিন্তু তা তারা সম্প্রতি কেটে ফেলেছিল। তিনি এটি লক্ষ্য করেছিলেন তবে সেই সময়ে বিষয়টি উপেক্ষা করে গিয়েছিলেন। কয়েক দিন সায়েফের অতিথি হয়ে থাকার পরে ওই সাংবাদিকদের উপত্যকায় নিয়ে আসা হয় এবং মাসুদের গেস্ট হাউসে রাখা হয়। সেখানেই একজন ব্রিটিশ পর্যটক ও লেখক ম্যাথিউ লেমিংয়ের সঙ্গে তাদের দেখা হয়েছিল।
পরে লেমিং 'দ্য স্পেকটেটর -এ ব্রেকফাস্ট উইথ দ্য কিলারস' শিরোনামে একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন, ''ওই দুজনকে আমার কাছে খুব চুপচাপ আর বেশ রহস্যজনক মানুষ বলে মনে হয়েছিল। মি. মাসুদের হত্যার পর আমি বুঝতে পারি যে আমি ওই খুনিদের সঙ্গে পাঁচ দিন কাটিয়েছি।''
''ডিনার টেবিলে, যখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে তারা কোথা থেকে এসেছেন, তারা জবাব দিয়েছিল যে তারা মরক্কো থেকে আসছে, তবে আসলে বেলজিয়ামের বাসিন্দা। আমি যখন মরক্কোর পর্যটন নিয়ে আলোচনা করতে চাইলাম, তখন তারা কথাবার্তায় আগ্রহ দেখায়নি। তারা দুজনেই প্রচুর ভাত ও মাংস খেতেন।''
তিনি আরও লিখেছেন, ''কয়েকদিন পর যখন তারা আমার কাছে কিছুটা মুখ খুললেন, তখন তারা জানতে চাইলেন যে আপনার কাছে জেনারেল মাসুদের নম্বর আছে? আমি বললাম, না। আমার মনে হয় না তিনি কাউকে নিজের নম্বর দেন। আমি যখন জানতে চাইলাম যে কেন তারা তার সঙ্গে দেখা করতে চায় তারা বলেছিল তাদের একটা টিভি তথ্যচিত্রের প্রয়োজনে।''

অবশেষে ডাক এলো

মাসুদের সবথেকে পুরনো বন্ধু মাসুদ খলিলি সেই সময়ে ভারতে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। কাজাখ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে তিনি ২০০১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর দিল্লি থেকে আলমাতি রওনা হন। মি. মাসুদ তাকে ফোন করে দেখা করার জন্য আমন্ত্রণ করেছিলেন।
খলিলি সাত সেপ্টেম্বর আলমাতি থেকে তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবেতে যান বিমানে চেপে। খলিলি হোটেলের ঘরে তখন ঘুমাতে যাবেন, এমন সময়ে আমরুল্লাহ শাহ তাকে ফোন করে বলেন যে মি. মাসুদ এসেছেন এবং তখনই তার সঙ্গে দেখা করতে চান।
খলিলি তার রাতপোষাক খুলে অন্যান্য পোশাক পরে মাসুদের ভাগ্নে ও সৈনিক অটেশো ওয়াদুদকে সঙ্গে নিয়ে মাসুদের কালো বুলেটপ্রুফ মার্সিডিজ গাড়িতে বসে তার বাড়িতে পৌঁছন।
"মাসুদ আর আমি কাশ্মীর এবং ভারতে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কথা বলছিলাম। রাত সাড়ে ১২টায় আমি মাসুদকে বিদায় জানালাম। সে আমাকে বিদায় জানাতে বাইরে এগিয়ে এসেছিল, যেটা খুব স্বাভাবিক ছিল না। তার সহকর্মীরা আমাকে বলেছিল যে পরের দিন আমরা ১০ টা থেকে ১১ টার মধ্যে আফগানিস্তানের উদ্দেশ্যে বিমানে রওনা হব। খোয়াজা বাহিউদ্দিন শহরে পৌঁছতে বিমানটি ৪০ মিনিট সময় নিয়েছিল। এরই মধ্যে আমি কমান্ডারের বেশ কিছু ছবি তুলেছিলাম।“
সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রোটোকল অফিসার ওয়াসিম এসে মাসুদকে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনি কি সৌদি আরবের সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করতে চান? নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের এলাকায় আসার তাদের পরে প্রায় এক মাস হয়ে গেছে আর গত নয় দিন ধরে তারা খোয়াজা বাহাউদ্দিনে আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছেন ।“

প্রশ্নগুলি আগাম জেনে নেওয়া হয়

পরদিন আহমদ শাহ মাসুদ তাদের সাক্ষাৎকারের জন্য সময় দেন। সেই রাতে তিনি এবং খলিলি একসঙ্গেই ছিলেন। রাত প্রায় দেড়টা পর্যন্ত তারা দুজনে গল্প করছিলেন। পরদিন বেলা ১১টার দিকে আহমেদ শাহ মাসুদ তার দপ্তরে পৌঁছন।
মাসুদ খলিলি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে বলেছিলেন, "আহমেদ শাহ একটা খাকি শার্ট এবং সামরিক জ্যাকেট পরেছিলেন। তার কিছুদিন আগে নতুন পাসপোর্ট পেয়েছিলাম। আমি যখন তাকে সেটা দেখাই, সে তারা আমাকে বলেছিল এটি আমার জামার পকেটে রাখতে, নাহলে হারিয়ে যেতে পারে। মাসুদ আমাকে বলে যে দুজন আরব সাংবাদিক দুই সপ্তাহ ধরে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি স্নান করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু মাসুদ আমাকে বাধা দিয়ে বলল যে এই সাক্ষাৎকারটি মাত্র পাঁচ-দশ মিনিটের।“
খলিলি আরও বলেন, “সাক্ষাৎকারের সময়ে আমি মাসুদের ডান দিকে বসেছিলাম। আমি তার এত কাছাকাছি ছিলাম যে আমাদের দুজনের কাঁধ লেগে যাচ্ছিল। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, 'আপনারা কোন সংবাদপত্র থেকে এসেছেন? জবাবে তারা বলেন, 'আমরা কোনো সংবাদপত্র থেকে আসিনি।''
''আমি ইউরোপের ইসলামিক সেন্টার থেকে এসেছি। আমি মাসুদকে বলেছিলাম, এরা তো সাংবাদিক নয়। মাসুদ আমাকে কনুই দিয়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘ওদের কাজ করতে দাও। তখন মাসুদ তাদের জিজ্ঞাসা করলো আপনারা কতগুলো প্রশ্ন করবেন? তারা একটা কাগজ বার করে আর তাদের প্রশ্নগুলি পড়তে শুরু করে। তাদের মোট ১৫টি প্রশ্ন ছিল। ওসামা বিন লাদেনকে নিয়ে আট-নয়টি প্রশ্ন ছিল।“

বেল্টে লুকনো বোমা

তাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল, আফগানিস্তানের পরিস্থিতি কেমন? খলিলি এটি অনুবাদ করার সঙ্গে সঙ্গেই একটি ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে।
"আমি বিস্ফোরণের শব্দ শুনিনি, কিন্তু দেখলাম আগুনের একটি নীল বল আমার দিকে আসছে। আমার মনে আছে, ততক্ষণ আমার জ্ঞান ছিল। আমি বুকে একটি হাতের ছোঁয়া পাই। সেটা ছিল আহমদ শাহ মাসুদের হাত। এরপর আর জ্ঞান আসে নি।“
বিস্ফোরণে পুরো ভবনটাই কেঁপে ওঠে। বিস্ফোরণটি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে আহমেদ শাহ মাসুদের সহযোগী আরেফ এবং জামশিদ ভেবেছিলেন যে হয়তো তালেবানরা সেখানে বিমান হামলা শুরু করেছে। সৌদি আরবের খুনিরা মাসুদের ঠিক সামনে ক্যামেরা রেখেছিল, কিন্তু আসলে বোমাটি লুকনো ছিল সাক্ষাৎকারীর বেল্টে।
 মাসুদের সব রক্ষীরা সেখানে ছুটে যায়। প্রায় অচেতন মাসুদ প্রথমে খলিলিকে ওঠাতে বলেন। মাসুদকে তৎক্ষণাৎ একটি গাড়িতে করে দ্রুত হেলিপ্যাডের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। মাসুদের রক্ষী আরেফ পরে তার সাক্ষ্যে এ কথা জানান।
"আহমদ শাহ মাসুদের সারা শরীরে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, আমি ও দেখেছি তার ডান হাতের একটি আঙুলের একটি ছোট অংশ বিস্ফোরণে উড়ে গেছে। মাসুদ, খলিলি ও আহতদের হেলিকপ্টারে করে নিকটবর্তী তাজিকিস্তানের ফারখার শহরে নিয়ে যাওয়া হয়”, সাক্ষ্য দেওয়ার সময়ে বলেছিলেন আরেফ।

তিনি মৃত, ঘোষণা ভারতীয় ডাক্তারের

মাসুদ খালিলির “মনে হচ্ছিল যেন আমি হেলিকপ্টারে আছি। আমি প্রায় ১০-১৫ সেকেন্ডের জন্য চোখ খুলতে পেরেছিলাম। মাসুদের মুখে আর চুলে রক্ত দেখতে পেয়েছিলাম। তারপর আমি আবার জ্ঞান হারাই। আমার জ্ঞান ফের আট দিন পরে, ততক্ষণে আমাকে জার্মানির একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমার স্ত্রী আমাকে জানান যে আহমেদ শাহ মাসুদ আর নেই।
খলিলির স্ত্রী যখন তার ব্যাগেজ খুলে দেখেন, সেখানে তার পাসপোর্টটি খুঁজে পান তিনি, যেটা আহমদ শাহ মাসুদ জোর করে শার্টের উপরের পকেটে রাখতে বলেছিলেন।
“আমার স্ত্রী আমার পাসপোর্ট খুলেছে। সেটার ১৫ তম পাতা পর্যন্ত অনেক বোমার স্প্লিন্টার ছিল। সেইজন্যই হয়তো আমি বেঁচে গেছি। যদি কমান্ডার আমার পাসপোর্টটি তার নিজের পকেটে রাখতেন! আফগানিস্তানকে আমার থেকে ওকে যে বেশি প্রয়োজন ছিল।“
 মাসুদকে যখন ফারখারে পৌঁছন হল, সেখানে হাজির এক ভারতীয় চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার রক্ষীরা জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের কয়েক মিনিটের মধ্যেই আহমেদ শাহ মাসুদ মারা যান।

হত্যার খবর চেপে যাওয়া হয়

এই ঘটনা কয়েক দিন বাইরের দুনিয়া থেকে গোপন রাখা হয়েছিল, যাতে এই সুযোগে তালেবানরা নর্দান অ্যালায়েন্সের বিরুদ্ধে নতুন করে সামরিক অভিযান শুরু না করতে পারে। মাসুদকে ৯/১১ এর দুদিন আগে কে হত্যা করা হয়েছিল, কিন্তু ৯/১১ এর কারণে এই ঘটনা যথেষ্ট আলোচিত হয়নি। মাসুদ খালিলি মনে করেন, ওই হত্যাকাণ্ডের পেছনে আল কায়েদার হাত ছিল।
তিনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে বলেছিলেন, “ওসামা বিন লাদেন পুরো আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়া জুড়ে এক ধরনের ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। আহমদ শাহ মাসুদকে না সরালে সেটা সম্ভব হতো না।
"ওসামা জানতেন যে নিউইয়র্কে তিনি যা করতে চলেছেন তার পরে তার সুরক্ষার প্রয়োজন হবে। কমান্ডার মাসুদকে হত্যা করা একভাবে তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের জন্য একটি উপহার ছিল যাতে ভবিষ্যতে প্রয়োজনে তিনি ওসামাকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিতে পারেন।“


পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ


এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
 
অতিরিক্ত ডিআইজি মশিউর রহমান গ্রেপ্তার
অতিরিক্ত ডিআইজি মশিউর রহমান গ্রেপ্তার
পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মশিউর রহমানকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ। বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) রাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক ...
ঢাবিতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আটক ছয়জনের পাঁচজনই ছাত্রলীগের
ঢাবিতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আটক ছয়জনের পাঁচজনই ছাত্রলীগের
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম (এফএইচ) হলে মোবাইল চোর সন্দেহে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় বৃহস্পতিবার ...
যেভাবে অশান্ত হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম
যেভাবে অশান্ত হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম
অশান্ত চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে দুপক্ষের সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ৪ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় আহত ...
জাতিসংঘে বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের কথা তুলে ধরবেন ড. ইউনূস
জাতিসংঘে বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের কথা তুলে ধরবেন ড. ইউনূস
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে বক্তৃতা করবেন বলে আশা ...
জলাবদ্ধতার কারনে বিদ্যালয় মাঠে আমনের বীজতলা
জলাবদ্ধতার কারনে বিদ্যালয় মাঠে আমনের বীজতলা
অব্যাহত ভারী বর্ষণে সৃষ্ট কৃত্তিম জলাবদ্ধতায় এখনো পানির নীচে ফরিদগঞ্জের ফসলের মাঠ। চলছে আমনের মৌসুম। ঘরে থাকা বীজ ধান নষ্ট ...
৩ ট্রিলিয়ন ডলার হালাল অর্থনীতির সুযোগ: মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসে বাংলাদেশ
৩ ট্রিলিয়ন ডলার হালাল অর্থনীতির সুযোগ: মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসে বাংলাদেশ
আসিয়ান অঞ্চলে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্বের বৃহত্তম হালাল শোকেস হিসেবে পরিচিত মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেস এর ২০তম আসরে ...
ভারত কীভাবে একযোগে নির্বাচনের পরিকল্পনা করছে?
ভারত কীভাবে একযোগে নির্বাচনের পরিকল্পনা করছে?
একযোগে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের লক্ষ্যে আর এক ধাপ এগোল ভারত সরকার। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব অনুমোদিত ...
তিন পার্বত্য জেলার পরিস্থিতি নিয়ে আইএসপিআর এর বিবৃতি
তিন পার্বত্য জেলার পরিস্থিতি নিয়ে আইএসপিআর এর বিবৃতি
তিন পার্বত্য জেলার পরিস্থিতি নিয়ে আইএসপিআর বিবৃতি দিয়েছে। তারা বলেছে- চলমান উত্তেজনা তিন পার্বত্য জেলায় ভয়াবহ দাঙ্গায় রূপ নিতে পারে। ...
শেখ হাসিনাকে নিয়ে ধুম্রজাল
শেখ হাসিনাকে নিয়ে ধুম্রজাল
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে।  তিনি যে কূটনৈতিক পাসপোর্ট নিয়ে পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্র‍য় নিয়েছিলেন, তার ...
১০
খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিতে সংঘর্ষ: তিন জেলার মানুষকে শান্ত থাকার আহ্বান সরকারের
খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিতে সংঘর্ষ: তিন জেলার মানুষকে শান্ত থাকার আহ্বান সরকারের
বাঙালি ও পাহাড়িদের সংঘর্ষের ঘটনায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিন জেলার মানুষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে সরকার। শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে ...
 
জানা গেল কর্মস্থলে অনুপস্থিত পুলিশ সদস্যের সংখ্যা
জানা গেল কর্মস্থলে অনুপস্থিত পুলিশ সদস্যের সংখ্যা
বাংলাদেশ পুলিশের ১৮৭ জন সদস্য এখন পর্যন্ত কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন বলে জানা গেছে। গত ০১ আগস্ট ২০২৪ থেকে মঙ্গলবার (১৭ ...
বাংলাদেশ থেকে বিদ্যুতের বকেয়া আদায়ে ভারতীয় সংস্থাগুলো কী করবে?
বাংলাদেশ থেকে বিদ্যুতের বকেয়া আদায়ে ভারতীয় সংস্থাগুলো কী করবে?
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পালাবদলের মধ্যেই গোটা দেশ যখন এই মুহুর্তে লোডশেডিং আর তীব্র বিদ্যুৎ সংকটে ভুগছে, তখন অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য ...
সোনার দামে নতুন রেকর্ড, ভরি ১২৯৯০২ টাকা
সোনার দামে নতুন রেকর্ড, ভরি ১২৯৯০২ টাকা
দেশের বাজারে সোনার দামে বাড়ানো হয়েছে। সব থেকে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের এক ভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) সোনার ...
বিশ্বের ‘স্মার্টেস্ট’ শহরগুলোতে জীবনযাত্রার ধরন ঠিক কেমন?
বিশ্বের ‘স্মার্টেস্ট’ শহরগুলোতে জীবনযাত্রার ধরন ঠিক কেমন?
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং পরিবেশগত পরিবর্তন পৃথিবীর প্রত্যেকটা দেশের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। শহরগুলো একটা সাসটেইনেবল বা টেঁকসই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ...
কাজে ফিরতে চান শ্রমিকরা, উস্কানিতে তৃতীয় পক্ষ
কাজে ফিরতে চান শ্রমিকরা, উস্কানিতে তৃতীয় পক্ষ
বেতন বৃদ্ধি, বকেয়া পরিশোধ, টিফিন, ছুটি বৃদ্ধি, মাতৃকালীন সময়ে ভারী কাজ না করা, কোম্পানির লভ্যাংশের অংশ প্রদানসহ বেশ কিছু দাবি ...
পোশাক কারখানায় অস্থিরতার ৩ কারণ চিহ্নিত
পোশাক কারখানায় অস্থিরতার ৩ কারণ চিহ্নিত
দেশে তৈরি পোশাক শিল্পে চলমান অস্থিরতা ও শ্রমিক অসন্তোষের জন্য তিন কারণকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো- বহিরাগতদের আক্রমণ-ভাঙচুর, শ্রমিকদের ...
মেট্রোরেল মেরামতে ‘৩৫০ কোটি’ টাকার জায়গায় এখন কত টাকা লাগছে?
মেট্রোরেল মেরামতে ‘৩৫০ কোটি’ টাকার জায়গায় এখন কত টাকা লাগছে?
বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলার সময় হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ মেট্রো স্টেশন সংস্কার করে পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে ...
পেঁয়াজ রপ্তানি নিয়ে ‍সুখবর দিল ভারত
পেঁয়াজ রপ্তানি নিয়ে ‍সুখবর দিল ভারত
পেঁয়াজ উৎপাদন অঞ্চল মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে পেঁয়াজ রপ্তানির ওপরে থাকা কঠোর শর্ত শিথিল করেছে ভারত সরকার।এখন থেকে প্রতি ...
সরকারি জমি দখল, টেন্ডারবাজিতে ‘ক্লিন ইমেজের’ আইভী
সরকারি জমি দখল, টেন্ডারবাজিতে ‘ক্লিন ইমেজের’ আইভী
প্রায় ১৩ বছর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। আওয়ামী লীগের আলোচিত নেতা শামীম ...
১০
আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছিলাম না : মাহফুজ আলম
আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছিলাম না : মাহফুজ আলম
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাফজুল আলম বলেছেন, আমার বিরুদ্ধে একটা ক্যাম্পেইন চলছে। বিশেষ করে ভারতীয় মিডিয়া এবং বিএএল ...
সম্পাদক ও প্রকাশক: ইউসুফ আহমেদ (তুহিন)
প্রকাশক কর্তৃক ৭৯/বি, ব্লক বি, এভিনিউ ১, সেকশান ১২, মিরপুর, ঢাকা ১২১৬ থেকে প্রকাশিত ও ৫২ টয়েনবি সার্কুলার রোড, ঢাকা ১১০০ থেকে মুদ্রিত
বার্তাকক্ষ : +৮৮০১৯১৫৭৮৪২৬৪, ই-মেইল editor@natun-barta.com, Web : www.Natun-Barta.com.com