/ মতামত / দলীয় রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ফিরে আসুক
দলীয় রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ফিরে আসুক
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
বিশ শতকে গণতন্ত্রের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল বিশ্ব ব্যবস্থায়। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ছিল উন্নয়ন মডেলের একটি মৌলিক উপাদান। এর মধ্যেই জনগণের প্রকৃত মৌলিক অধিকারের বিষয়টি খোঁজা হয়েছিল। তাই দেশে দেশে ছিল গণতন্ত্রের জয়জয়কার। তবে একুশ শতকের পৃথিবীতে গণতন্ত্রের বিপরীতে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থাকে একটি উন্নয়ন মডেল হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র-এমন একটি প্রচারণা সামনে নিয়ে আসা হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয়। ফলে বিশ্বের দেশগুলোয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে এবং পক্ষান্তরে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার রাষ্ট্রের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে এবং বদ্ধ সমাজ ব্যবস্থার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনে মানুষকে জোরপূর্বক বাক্হারা করার চেষ্টা করা হচ্ছে উন্নয়নের নামে। এসব দেশে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে একজন মাত্র শাসকের পদতলে নিয়ে এসে সব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ক্ষুদ্র একটি পরিবার ও চক্রী দলের হাতে কেন্দ্রীভূত করে গণতন্ত্রের কফিনের ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে আধুনিক কর্তৃত্ববাদী শাসনের মিনার। আর এখানে মানুষের সব অধিকার অস্বীকার করে শাসন ব্যবস্থার মিনারের চূড়ায় বসে থাকা শাসকের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে বলপূর্বক চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে জনগণের ওপর। জনগণের সমর্থন আছে কি নেই, সে সম্পর্কে ভ্রূক্ষেপ করা হয় না। স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির আগে সামরিক শাসন ছিল বিশ্বরাজনীতিতে একটি অনিবার্য বাস্তবতা। স্নায়ুযুদ্ধোত্তর রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের প্রবণতা অনেকটা কমে গেলেও তা একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। এখনো আফ্রো-এশিয়ার অনেক দেশেই সামরিক শাসনের উপস্থিতি লক্ষণীয়। সামরিক বাহিনী কোনো কোনো দেশে প্রত্যক্ষভাবে শাসন না করলেও পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। যদিও সামরিক বাহিনীর প্রভাব স্নায়ুুযুদ্ধ কালীন অবস্থা থেকে দুর্বল হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। যাইহোক, আমাদের দেশ এখন যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে আশায় বুক বাঁধার মতো অনেক কিছুই আছে।সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান জাতিকে নতুনভাবে জাগিয়ে তুলেছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে আসা গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সফলতা হচ্ছে, এ আন্দোলন দেশের রাজনীতিবিমুখ সব নাগরিককে প্রবলভাবে রাজনীতি সচেতন নাগরিকে পরিণত করেছে। দীর্ঘ স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট জাতির পুনর্জাগরণ, বিশেষ করে এ দেশের তরুণ সমাজের মানসপটে ঘটে যাওয়া বিপ্লব ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ পুনর্নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে, এমনটাই প্রত্যাশিত। তবে যে গণতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন আমরা দেখি, সেই স্বপ্নের সারথি রাজনৈতিক দলগুলো আসলে কতটা গণতান্ত্রিক? রাজনৈতিক দলগুলোর অন্দরমহলে উঁকি দিলে মোটাদাগে হতাশাজনক চিত্রই চোখে পড়ে। বঙ্গীয় ভূখণ্ড বহু আগেই রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা দূরে ফেলে এলেও দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে এখনও পরিবারতন্ত্রের চর্চা বিদ্যমান। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে এমনকি তৃণমূলের ওয়ার্ড পর্যায়েও বংশানু ক্রমিক ধারার জয়জয়কার। শীর্ষ নেতৃত্বে তো রাজরক্তের বাইরে যাওয়ার নজির একেবারেই বিরল! এসব রাজাধিরাজ শীর্ষ নেতৃত্ব কদাচিৎ গণতান্ত্রিক পথে দল পরিচালনা করেন। বরং দলের মধ্যে প্রচলিত স্বৈর সংস্কৃতিই প্রতিফলিত হয় যখন তারা দেশের শাসনভার হাতে পান। দেশে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল, যারা অতীতে সরকার গঠন করেছিল, প্রতিটি দলে একই চিত্র বিদ্যমান। একক ব্যক্তি ও পরিবারের হাতে দলের সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা। বছরের পর বছর কাউন্সিল না করা; কাউন্সিল করলেও ভোটের পরিবর্তে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের ইচ্ছানুসারে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পছন্দের লোক বসানো; সিদ্ধান্ত গ্রহণে দলের তৃণমূল ও সভাপতি মণ্ডলীর সদস্যদের মতামত দেওয়ার সুযোগ সীমিত করা; শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দিলেই বহিষ্কার-লিখতে গেলে অভিযোগের তালিকা কেবল দীর্ঘতরই হবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা প্রতিটি দলেই নেতৃত্ব দানকারী একক ব্যক্তি ও পরিবারকে এমন পূজনীয় অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে কথা বলারন দুঃসাহস দলের কোনো নেতাকর্মীর নেই। রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রচলিত আইন, যেমন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, নির্বাচন কমিশনের রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন আইনের ধারার নিয়মিত অবমূল্যায়ন করে গেছে দলগুলো। এমনকি নিজ নিজ দলের গঠনতন্ত্র মেনে চলার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক দলগুলোর অনীহা প্রকট। দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ঘাটতিই এর প্রধান কারণ। আইন ও নিয়ম মেনে কোনো দলই পরিচালিত হয় না। কিছু দলের বিরুদ্ধে তো টাকা দিয়ে পদবি বেচাকেনার অভিযোগও রয়েছে। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের বাইরে অন্য দলগুলোর অবস্থাও অভিন্ন। ছোট, বড়, মাঝারি-অধিকাংশ দলই ব্যক্তি ও পরিবার কেন্দ্রিক। দলের নীতিনির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির শাসন বিদ্যমান। জনগণের সঙ্গেও এসব দলের যোগাযোগ সীমিত। বিগত কয়েক দশকে জোটের রাজনীতি মুখ্য হয়ে ওঠায় অনেক দলই রাজনীতিতে টিকে আছে সত্যি,কিন্তু একই কারণে অনেক দল স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে আদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাদের জোটসঙ্গী বড় দলের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে।দেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১১ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট ভাবে বলা আছে- 'প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে'। যদিও জনপ্রতিনিধিরাই গণতন্ত্রের প্রাণ। কাজেই জন প্রতিনিধি যেন সত্যিকার অর্থেই জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে ও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পদ্ধতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয় কিন্ত সেটা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের পাশাপাশি সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলেরও সাংবিধানিক দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি, অর্থ ও বাহুবলের বাইরে গিয়ে নিজ দলের প্রার্থী নির্দিষ্ট এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য।এই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এমনকি, দলের তৃণমূলের কর্মীরাই বা তাঁকে কতটুকু সমর্থন করে,তাও রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্ধারণ করতে হবে। দেশের প্রেক্ষাপটে যেখানে রাজনীতিতে বংশপরম্পরার বিস্তর প্রভাব বিদ্যমান, সেখানে সত্যিকার যোগ্য ও সৎ জনপ্রতিনিধি নির্ধারণ এবং নির্বাচন বেশ জটিল প্রক্রিয়া। দলীয় প্রার্থী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ আসনের সাধারণ মানুষের মতামত নেবে-এমনটা আশা করা দুরূহ। কিন্তু নিজ দলের সাধারণ কর্মীদের ভোটের মাধ্যমেও যদি প্রার্থী নির্বাচন করা হয়; অন্তত দলের মধ্যকার গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সাধারণ জনগণের সামনে উপস্থাপন করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রায় সব রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রেই কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের কথা বলা আছে। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়নেও একই বিধান কাম্য। অথচ প্রায়োগিক বিচারে এসব শুধুই আলঙ্কারিক। দলের নেতৃত্ব বা প্রার্থী মনোনয়ন- সর্বক্ষেত্রে দলের শীর্ষকর্তাদের প্রেসক্রিপশনেই নির্ধারিত হয় কোন এলাকায় কারা পাবেন দলীয় প্রতীক। অধিকাংশ দলই যখন অভিন্ন পদ্ধতিতে প্রার্থী নির্ধারণ করে তখন জনসাধারণের সামনে ভোট দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত বিকল্প থাকে না।ফলে এমন ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জনগণের সত্যিকার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হন। রাষ্ট্রের নির্বাচন প্রক্রিয়া যদি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় তবেই শান্তি ও স্বস্তির আশা করা যায়। কিন্তু সেখানেই যদি গলদ থাকে তাহলে তো গণতন্ত্রের জনপ্রতিনিধিরা সত্যিকার অর্থে জনগণের প্রতিনিধিই থাকেন না! ফেলে আসা গণতন্ত্রের কৃষ্ণপক্ষে বড় এক দলের টিকিট পাওয়া মানেই ছিল কার্যত নির্বাচিত হয়ে যাওয়া, জনগণের ভোট সেখানে গৌণ! পৃথিবীজুড়েই গণতন্ত্রের উত্থান-পতন রয়েছে। প্রযুক্তির নানামুখী পরিবর্তনে গণতন্ত্রও প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। প্রযুক্তি গণতান্ত্রিক শাসনকে যেমন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে, আবার জনবান্ধবও করে তুলছে। অথচ বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখনও সেই মৌলিক অবস্থা অর্থাৎ জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতেই হিমশিম খাচ্ছে! গত জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের ফলে শুরু হওয়া সংস্কার কালে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সামনেও সুযোগ এসেছে নিজ নিজ দলের কার্যপ্রণালি পুনর্মূল্যায়ন ও সংস্কারের। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ভেতরকার গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে দেশের শাসন ব্যবস্থায় সেই একই ব্যর্থতা বারবার প্রতিফলিত হবে। দেশের এই ক্রান্তিকালে রাজনৈতিক দলগুলো সচেতন হবে এবং দলের সর্বস্তরে প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা শুরু করবে, এটিই জনগণের প্রত্যাশা। আরব ও মুসলিম বিশ্ব মনে করছে, পশ্চিমারা নিজেই দেখাচ্ছে যে পৈশাচিক পাশবিকতায় তারা সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। তাঁরা মনে করছেন, যেন গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও উদার মূল্যবোধ একসময় আরব বসন্তকে উদ্দীপ্ত করেছিল, সেসব আসলে পশ্চিমা আধিপত্যের হাতিয়ার। এই অনাস্থা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও প্রতিযোগিতার যুগে মানুষ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সভ্যতার বিকশিত সময় ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগেও মনুষ্য সমাজে সহিংসতা,রক্তপাত,হানাহানি,বিদ্বেষ, প্রতিহিংসাপরায়ণতা আর উন্মাদনার যে চিত্র প্রায় নিত্য ফুটে উঠছে, এতে মানবতা আজ বিপন্ন। পৃথিবীতে মানুষের যা কিছু উদ্যোগ-উদ্যম, সবকিছুই শান্তিতে বেঁচে থাকার লক্ষ্যকে ঘিরে আবর্তিত হয়। পৃথিবী সুখময় না দুঃখময় এ নিয়ে তাত্ত্বিক বিতর্ক হতে পারে কিন্তু এ কথা সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত যে বিশ্বে নিরাপদে বেঁচে থাকার সাধনাতেই মানুষ নিজেকে ব্যস্ত রাখে। দুঃখের বিষয়, আমরা যত সভ্যতার দিকে ধাবিত হচ্ছি, ততই যেন মানবিক গুণাবলি হারিয়ে ফেলছি। বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, আমরা কতটা মানবিকতা ধারণ করতে পারছি। কতটা অন্যের স্বার্থরক্ষা করতে পারছি। তবে আমাদের হতাশ হলে চলবে না। গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখতে আমাদের সবাইকে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করতে হবে। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |