/ মতামত / অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারে চীন-মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা
অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারে চীন-মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
প্রযুক্তি শিল্পে কে আধিপত্য বিস্তার করবে এই নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন অনেক দিন ধরে প্রতিযোগিতা করে আসছে। একবিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বিকাশে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিতে চীন ও গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নে প্রচুর বিনিয়োগ করছে এবং এর মধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় চীন শুধু প্রতিযোগিতাই করছে না বরং ২০৩০ সালের মধ্যে এই প্রযুক্তিতে বিশ্ব শাসন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ক্ষমতার যে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা চলছে, সেটিকে চলতি শতাব্দীর প্রথমার্ধের একটি সংজ্ঞা নির্ধারণী বৈশিষ্ট্য বলা যেতে পারে। তবে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ঠিক কোন ধরনের সংজ্ঞায় আটকানো উচিত হবে, তা নিয়ে খুব কম লোকই একমত হতে পেরেছেন। কেউ কেউ এটিকে গত শতাব্দীর দুটি বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানি ও ব্রিটেনের মধ্যে শুরু হওয়া দীর্ঘ দ্বন্দ্বের মতো একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলে অভিহিত করেছেন। আবার অন্যরা আশঙ্কা করছেন, খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে স্পার্টা ও এথেন্সের মধ্যে যে আদলে যুদ্ধ হয়েছিল, আমেরিকা ও চীন সেই ধরনের যুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সমস্যা হলো, যুক্তরাষ্ট্র-চীন সংঘাত অনিবার্য-এমন একটি ধারণা সবার মনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাস্তব হয়ে ওঠা একটি ভবিষ্যদ্বাণীতে রূপ নিতে পারে।দীর্ঘস্থায়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিজেই একটি বিভ্রান্তিকর শব্দবন্ধ। ১৯৪৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) ক্ষমতায় আসার পর থেকে চীন-আমেরিকা সম্পর্ক যতগুলো ধাপ পেরিয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে একটু চিন্তা করলে দেখা যায়,১৯৫০-এর দশকে কোরীয় উপদ্বীপে আমেরিকান ও চীনা সেনারা পরস্পরকে হত্যা করেছে। এরপর ১৯৭০-এর দশকে চীনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ঐতিহাসিক সফরের সুবাদে এই দুই দেশ কাছাকাছি এসেছিল। এই সময়টাতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভারসাম্যমূলক জায়গায় আটকে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ঘনিষ্ঠভাবে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে শুরু করে। ১৯৯০-এর দশকে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক যুক্ততা বাড়তে থাকে। এর সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় চীনের অন্তর্ভুক্তিকে সমর্থন দিয়েছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা চীনকে যেভাবে মার্কিন অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামরিক ব্যবস্থার জন্য ধাবমান হুমকি বলে অভিহিত করছেন, ২০১৬ সালের আগে এমনটি ছিল না। ১৮৫৩ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট মিলার্ড ফিলমোরের আদেশে মার্কিন নৌবাহিনীর কমোডর ম্যাথিউ পেরি চারটি যুদ্ধজাহাজ নিয়ে জাপানে অভিযান চালিয়ে ছিলেন। জাপান ২০০ বছর ধরে পশ্চিম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার যে নীতি অনুসরণ করে আসছিল, সেই নীতি থেকে জাপানকে সরে আসতে বাধ্য করাই ছিল এই অভিযানের মূল লক্ষ্য।ম্যাথিউ পেরি টোকিও উপসাগরে পৌঁছানোর পর জাপানের তৎকালীন তোকুগাওয়া শোগুনেতকে আলটিমেটাম দেন: হয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করার জন্য জাপানকে উন্মুক্ত করে দিন, নয়তো কঠোর পরিণতির মুখোমুখি হন। যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘কালো জাহাজ’-এর আগমন জাপানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল। প্রযুক্তিগত দক্ষতার এই চমকে দেওয়া প্রদর্শনী মুখে পড়ে শোগুনেত একান্ত অনিচ্ছায় পেরির দাবি মেনে নিতে রাজি হয়েছিল। পেরির ধমকের মুখে ১৮৫৪ সালের কানাগাওয়া চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর এক বছর পরে শোগুনেত তার প্রথম বাষ্পীয় ইঞ্জিনচালিত যুদ্ধজাহাজ ডাচদের কাছ থেকে বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে পেয়েছিল। এরপর বহু বছর কেটে গেছে। প্রযুক্তিতে সভ্যতা এগিয়ে গেছে। এনার্জি গ্রিড, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন এবং এখন কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা চ্যাটবটের মতো প্রযুক্তি আজ একক ব্যক্তিকেও প্রতিষ্ঠিত করতে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। পেরির অভিযান দেখিয়েছিল, প্রযুক্তি রাষ্ট্রীয় সামরিক সার্বভৌমত্বের মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করতে পারে। তার ধারাবাহিকতায় প্রযুক্তিগত আধিপত্যের সুবাদে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের সেই চিত্র দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের টিকে থাকার সুবাদে আমেরিকার আর্থিক সার্বভৌমত্ব এখনো অক্ষুণ্ন আছে বটে, কিন্তু দেশটির অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব চীনের দ্বারা দিন দিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাচ্ছে। ক্রয়ক্ষমতা সমতার দিক বিবেচনায় চীন ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। চীন এখন ১২০টির বেশি দেশের শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার। এই দুটি পরাশক্তি বর্তমানে সেমিকন্ডাক্টর, এআই, সিন্থেটিক বায়োলজি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং ব্লকচেইনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির নকশা, বিকাশ ও উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করতে তুমুল প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে। অবাক করা বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র বা চীন-কেউই এখন পর্যন্ত সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি। এর কারণ হলো পাঁচ ন্যানোমিটারের ছোট আকারের সেমিকন্ডাক্টর তাইওয়ানের তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (টিএসএমসি) এবং দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং ছাড়া আর কেউ উৎপাদন করতে পারে না। এ অবস্থা বদলে ফেলার জন্য উভয় পরাশক্তি এমন একটি ‘প্রযুক্তি সার্বভৌমত্ব বলয়’ গড়ে তুলতে চাইছে, যেখানে অন্যান্য দেশকেও তাদের সঙ্গে শরিক হতে হবে। পুরোনো ঔপনিবেশিকতার বিপরীতে নতুন এই প্রযুক্তি-উপনিবেশবাদ ভূখণ্ড দখলে বিশ্বাসী নয়। এই উপনিবেশবাদ বিশ্ব অর্থনীতি ও আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে এমন প্রযুক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়কে অগ্রাধিকার দেয়। এই ক্ষমতা অর্জনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ক্রমবর্ধমানভাবে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের সবচেয়ে উদ্ভাবনী এবং জটিল বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছে। চীন অতিগুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালের সরবরাহ শৃঙ্খলব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে,যা দেশটিকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বৈদ্যুতিক যানবাহন উৎপাদনকারী হতে সক্ষম করেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ক্যাডেন্স ডিজাইন সিস্টেম এবং সিনোপসিসের মতো সংস্থাগুলোর সুবাদে চিপ ডিজাইন সফটওয়্যারের দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে। সব মিলিয়ে বিশ্ব এখন প্রযুক্তি ঔপনিবেশিকতার দিকে এগিয়ে চলেছে। বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থার জন্য একটি শক্তিশালী ট্রান্সঅ্যাটলান্টিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা গুরুত্বপূর্ণ। তবে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অন্যান্য এশীয় অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পশ্চিমারা বৈশিক বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের নিয়ম নতুন করে সাজাতে পারে। ফলে প্রযুক্তি শিল্প নিয়ে নতুন মান নির্ধারণ করতে পারে যেটা বৈদেশিক কোম্পানিগুলোর জন্য আরো সুষম খেলার মাঠ নিশ্চিত করবে। যদি গণতান্ত্রিক দেশগুলো একজোট হয়ে কাজ করতে পারে তাহলে চলমান এই শতাব্দীতে চীনের অর্থনীতিকে ভালোভাবেই ছাড়িয়ে যাবে।কারণ চীনের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের চেয়ে কূটনৈতিক ইস্যুগুলো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ভবিষ্যৎ যুক্তরাষ্ট্র-চীন শক্তির ভারসাম্যের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে, প্রযুক্তি ভূমিকা রাকবে তবে সমমনা শক্তির সঙ্গে জোট করা আরো গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হবে। ইউরোপীয়দের নেতৃত্বাধীন আইএমএফ এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার সামর্থ্য অর্জনের লক্ষ্যে চীন যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এটিকে তারই অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। চীন বৈশ্বিক দক্ষিণকে এক করে নিজের নেতৃত্বে নিতে পারবে কি না, তা এখনই বলা যাবে না। আমেরিকা নিশ্চিতভাবেই তেমনটা আশা করে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো অন্যরা ব্রিকস প্লাসকে একটি নতুন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখছে। চীনের এই ক্রমবর্ধমান শক্তিকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা স্পষ্টতই অকার্যকর ও বেশ পিছিয়ে থাকা পদক্ষেপ। গত এক দশক ধরে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রযুক্তি নিয়ে ঠান্ডা যুদ্ধ দেখা যাচ্ছে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে দুই দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। এবার যুক্তরাষ্ট্র ফেরত বিজ্ঞানী ডুয়ান লুমিংয়ের হাত ধরে নতুন কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরিতে সাফল্য লাভ করেছে চীন। কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের দুনিয়াতে বিজ্ঞানী ডুয়ান আলোচিত এক নাম। ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় যোগ দেওয়ার পর প্রায় ১৫ বছর কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ওপরে আলোচিত সব গবেষণায় যুক্ত ছিলেন তিনি। পরে ২০১৮ সালে চীনে ফেরত আসেন এই বিজ্ঞানী। যুক্তরাষ্ট্র ফেরত এই বিজ্ঞানীর হাত ধরেই চীনে তৈরি হলো শক্তিশালী কোয়ান্টাম কম্পিউটার।চীনের সিংগুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারডিসিপ্লিনারি ইনফরমেশন সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত বিজ্ঞানী ডুয়ান লুমিংয়ের নেতৃত্বে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী আয়নভিত্তিক কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করেছেন চীনের বিজ্ঞানীরা। জি-৭-কে আবার জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তেমন উদ্যোগ নেই। ফলে এই গ্রুপের পক্ষে উদীয়মান অথচ শক্তিশালী ব্রিকস প্লাসকে ঠেকানো কঠিন হবে। আর ব্রিকস প্লাসের দুর্দমনীয় গতি বৈশ্বিক দক্ষিণকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে পারে, যা পশ্চিমা ব্যবস্থার যথার্থ বিকল্প শক্তি হয়ে উঠবে। আর সেটি হলে গোটা বিশ্বব্যবস্থারই খোল নলচে বদলে যাবে।সুতরাং প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেভাবে বাড়ছে, তাতে অচিরেই এমন একটি অবস্থা তৈরি হবে, যখন বিশ্বের বাকি দেশগুলো এই দুটোর যেকোনো একটি পক্ষকে বেছে নিতে বাধ্য হবে। এটি প্রযুক্তিগত ঔপনিবেশিকতার একটি নতুন যুগের সূচনা করবে। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |