/ মতামত / স্বাধীন সত্তা রক্ষায় বৃহত্তম জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য
স্বাধীন সত্তা রক্ষায় বৃহত্তম জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশকে নিয়ে চক্রান্ত থেমে নেই। জুলাই-আগষ্টের কষ্টার্জিত সফলতা বিনষ্ট করার এক ও অভিন্ন উদ্দেশ্যে একেক সময় একেক রূপে নানা চক্রান্ত সামনে আসছে। নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে পরাজিত শক্তি ও তার অভিভাবক রাষ্ট্র ভারত।লেলিয়ে দেয়া হয়েছে সেখানকার আজ্ঞাবহ মিডিয়াগুলোকে অবিরত অপপ্রচার চালানো হচ্ছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। উগ্রপন্থী হিন্দুদের নৃশংস হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন চট্টগ্রামের একজন আইনজীবী। অপরদিকে আক্রান্ত হয়েছে ভারতের আগরতলাস্থ উপহাইকমিশন।এহেন জটিল পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার,সকল রাজনৈতিক দল ও দেশপ্রেমিক জনতার সুদৃঢ় ঐক্যের কোন বিকল্প নেই। সকল প্রকার ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন, আত্মমর্যাদাশীল ও বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র হিসেব গড়তে এখন জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য। দীর্ঘ সংগ্রাম ও স্বাধীনতাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে এ দেশের মানুষ। সংগ্রাম ও যুদ্ধে জনসাধারণ যে দৃঢ় সমর্থন ও সহায়তা প্রদান করেছিল, তা-ই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূল শক্তি। এখনও আমাদের চলতে হবে নিজেদের শক্তি ও নিজেদের বুদ্ধিতে চলমান বাস্তবতা বিবেচনা করে।স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের অর্জন কী?অর্থাৎ সাফল্য সমস্যা ও করণীয় নিয়ে ভাবতে হবে।বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে, চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি ব্যবহার করে পৃথিবীব্যাপী মানুষ ভাত-কাপড়ের সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয়েছে। এ ছাড়া অন্য সব সমস্যার সমাধানের ধারায়ও মানুষ কমবেশি উন্নতি সাধন করে চলছে। আগে লোকসংখ্যা কম থাকলেও উৎপাদন এত কম হতো যে অনেক মানুষ পেট ভরে ভাত কিংবা রুটি খেতে পারত না। কাপড়ের অভাবও ছিল ভয়াবহ।শীতের কারণে প্রতিবছর বিভিন্ন দেশে বহু লোক মারা যেত। আমাদের দেশেও মানুষ এই রকম অবস্থার মধ্যেই ছিল। সেই অবস্থা এখন আর নেই। উৎপাদন বেড়েছে। অন্যায়-অবিচারও বেড়েছে। কিন্তু মনের দিক দিয়ে, নৈতিক দিক দিয়ে, মূল্যবোধের দিক দিয়ে মানুষের কোনো উন্নতি হয়নি।সংঘাত-সংঘর্ষ বাড়ছে, একের পর এক যুদ্ধ চলছে। কিছু সমস্যার সমাধান হয়েছে, কিছু নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমাদের দেশের জনগণ জাতীয় সংসদের নির্বাচন করার সামর্থ্যও এখন পর্যন্ত অর্জন করেনি। যারা নানা কৌশলে ক্ষমতাসীন হয়, তারা নানা কুৎসিত উপায় অবলম্বন করে দমননীতি, জেল-জুলুম, গায়েবি মামলা, খুন, গুম ইত্যাদি অবলম্বন করে ক্ষমতায় থেকেছে। দেশের বড় অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে, ব্যাংক গুলোকে ঋণখেলাপি লোকেরা চরম দুর্দশায় ফেলেছে, ইসলামী ব্যাংক এবং অন্যান্য প্রাইভেট ব্যাংক চরম দুর্গতিতে পড়েছে, বৈদেশিক ঋণ নিয়ে রাষ্ট্র দুর্গতিতে ভুগছে। প্রশাসনব্যবস্থাকে দলীয়করণের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় ফেলা হয়েছে। দলীয়করণের পরিণতিতে পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মনোবলহারা। রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থাকে সব দিক দিয়ে খারাপ অবস্থায় রাখা হয়েছে। রাষ্ট্রের সংবিধানকেও প্রগতি বিরোধী রূপ দিয়ে রাখা হয়েছে। চলমান ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। অর্থাৎ রাষ্ট্রব্যবস্থা দুর্নীতির অনুকূল। এ অবস্থায় জনচরিত্রও ভালো নয়। বাংলাদেশে ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষের কামনা-বাসনার সন্ধান করতে গেলে দেখা যায়, মানুষ ভোগবাদী, সুবিধাবাদী।ধনিক-বণিকদের ও ক্ষমতালিপ্সুদের মধ্যে ভোগবাদ ও সুবিধাবাদ প্রবল। সাধারণ মানুষের ও ছাত্র-তরুণদের মন-মানসিকতা গঠিত হয় বহুলাংশে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও শাসকদের দ্বারা।আইনকানুন,বিচারব্যবস্থা,শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি দ্বারা। প্রশাসনব্যবস্থা যদি বহুলাংশে ন্যায়-নিষ্ঠার প্রতিকূল হয়, আইনের শাসন যদি ধনিক-বণিক ও ক্ষমতাবানদের ইচ্ছানুযায়ী পরিচালিত হয়, তাহলে জাতি ও রাষ্ট্র দুর্বল হয়; একসময় প্রবল বিদেশি বড় শক্তির অধীনে চলে যায়। আমাদের দেশের পররাষ্ট্রনীতির বেলায় ভারতের এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভূমিকা মনে রাখতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এবং উন্নতিশীলতার জন্য এই ব্যাপারটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে গেলে মারাত্মক ভুল হবে। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ভারতের দিকে ঝুঁকে গেলেও ভুল হবে। হীন স্বার্থান্বেষীরা ও সুবিধাবাদীরা এই ব্যাপারটি বুঝতে পারলেও না বোঝার ভান করবে এবং জাতীয় স্বার্থ, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিবেচনা না করেই নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করে নেবে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা মনে রাখতে হবে। আজকের পৃথিবীতে একদিকে আছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগী ও অনুগামী যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো, জি-সেভেন; অন্যদিকে আছে রাশিয়া, চীন ও তাদের সহযোগী কিছু রাষ্ট্র। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল কাজ করছে মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে। এগুলো যতটা অর্থনৈতিক, ঠিক ততটাই রাজনৈতিক সংস্থা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ও অঘোষিত কর্মসূচির বাস্তবায়নে এই দুটি সংস্থা কাজ করে থাকে। সুতরাং আমাদের দেশের স্বাধীন সত্তা রক্ষার জন্য বৃহত্তম জাতীয় ঐক্য এখন অপরিহার্য। ১৯৭২ সাল থেকে কোনো সরকারই বৃহত্তম জাতীয় ঐক্যের নীতি গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে ভারতে যেতে হলো বৃহত্তম জাতীয় ঐক্যের প্রতি অবজ্ঞা প্রতিষ্ঠার কারণে।আমাদের দেশের রাজনীতি, রাজনীতিবিদদের,রাজনৈতিক দলগুলোর ও রাজনৈতিক নেতাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। বর্তমানে যে উপদেষ্টা পরিষদ দ্বারা বাংলাদেশ পরিচালিত হচ্ছে, তা নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, অরাজনৈতিক মেধাবী ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত। রাজনীতিবিদদের প্রতি, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে রয়েছে অনাস্থা। এর ফলে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন উপদেষ্টা পরিষদের প্রতি সদয় মনোভাব ব্যক্ত করছে। জনগণ চায়, এই সরকার দ্বারা সর্বজনীন কল্যাণে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উন্নতিশীল করার প্রক্রিয়ার সূচনা হোক। এই উদ্দেশ্যে তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের বাস্তবতা তৈরি করবে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে একটি উন্নতিশীল রাষ্ট্র গঠনের উপযোগী রাজনীতির ধারার সূচনা করে যাবে।নির্দলীয়-নিরপেক্ষ অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারা রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারের জন্য এই সরকার রাষ্ট্রের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোনো কোনো দিক অনুসন্ধান করে দেখছে। রাজনৈতিক মহল থেকে দ্রুত জাতীয় সংসদের নির্বাচন দেওয়ার জন্য দাবি তোলা হচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক জটিলতা হঠাৎ দেখা দেয়নি। পক্ষপাতমুক্ত পর্যবেক্ষণে গেলে দেখা যাবে, ১৯৭২ সালের প্রায় শুরু থেকেই সমস্যা সংকটে রূপ নিয়েছে। যেসব মর্মান্তিক ঘটনা ক্রমাগত ঘটেছে, সেগুলোর কথা স্মরণ করলে এবং কারণ-করণীয় ও ফলাফল ঘটনাপ্রবাহকে বিচার করলে বোঝা যাবে, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে দেশের মানুষ কী অবস্থায় আছে। সব কিছুকেই আমাদের বিচার করতে হবে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় উন্নতির লক্ষ্য নিয়ে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা লেখি কম হয়নি। কিন্তু সেগুলো দ্বারা তো পাঠকের মধ্যে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় উন্নতির কোনো উন্নত চিন্তা-চেতনা দেখা দিচ্ছে না। মনে হয়, আমাদের রাজনীতিবিদরা এবং লেখকরা ফলাফল বিবেচনা না করেই লিখছেন। অথচ একটা দেশের ভাল মন্দ অনেক কিছুই নির্ভর করে সাংবাদিক ও লেখকদের সত্য প্রকাশের মাধ্যমে। এমনটি যদি না হয়, তাহলে এ জাতির স্বাধীনতা কি রক্ষা পাবে? রাজনীতির ও রাজনৈতিক উন্নতির জন্য আদর্শ অপরিহার্য। বাস্তবে দেখা যায়, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ-এসব আদর্শকে এখন অর্থহীন করে ফেলা হয়েছে। এসব আদর্শকে আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে দেখতে হবে এবং আজকের প্রয়োজনে সর্বজনীন কল্যাণের আদর্শ রচনা করতে হবে। সর্বজনীন কল্যাণে নতুন রাজনীতির জন্য এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার পুনর্গঠনের জন্য সব দেশ-কালে তরুণরাই অগ্রযাত্রীর ভূমিকা পালন করে। বাংলা ভাষার দেশেও তা-ই হয়েছে। তরুণরা এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। সর্বজনীন কল্যাণে কাজ করার জন্য প্রবীণদের থেকে এবং বই-পুস্তক থেকে তাদের অনেক কিছু শিখতে হবে। প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের শ্রমের কিছু না কিছু লাঘব হচ্ছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে মানুষ যদি প্রযুক্তির অধীন হয়ে পড়ে, তাহলে সমূহ সর্বনাশ। এ নিয়ে যথাসম্ভব জানতে ও বুঝতে হবে।উদীয়মান রাজনীতিবিদদের মতামত দেশবাসীর মধ্যে প্রচার করা দরকার। তারা নতুন কিছু, ভালো কিছু অবলম্বন করে এগোচ্ছে-শিক্ষিত লোকদের মধ্যে তার প্রচার দরকার। দুই পক্ষের মধ্যে সুসম্পর্ক দরকার। তবে তরুণদের পক্ষ থেকে প্রবীণদের প্রগতিবিমুখ চিন্তার সমালোচনা অপরিহার্য। সমালোচনা মানে নিন্দা নয়-এ কথাও মনে রাখতে হবে। জনশক্তি ও প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার ও কল্যাণকর ব্যবহারে মনোযোগ আনতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, 'সত্যের চিরজয় ও মিথ্যার চিরপরাজয়'। পরিশেষে বলব, মৌলিক সংস্কার সম্পন্ন করে আগামী নির্বাচনের একটা সম্ভাব্য সময়সূচিও দ্রুতই জাতির সামনে আসা উচিত। দেশ নির্বাচনমুখী হলে বিরাজমান আশংকাগুলোও কিছুটা কমতে শুরু করবে বলে অনেকেই মনে করছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার নানা রকম নিত্যনতুন পরিকল্পনা যখন তখন সামনে আসা অস্বাভাবিক কোন বিষয় নয়। তাই সংশ্লিষ্ট সকলকেই সজাগ থাকতে হবে। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |