/ জাতীয় / ট্রাম্প শাসনামলে বাংলাদেশ নিয়ে প্রভাব খাটাতে পারবে ভারত?
ট্রাম্প শাসনামলে বাংলাদেশ নিয়ে প্রভাব খাটাতে পারবে ভারত?
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
ডোনাল্ড ট্রাম্প ৪৭তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওয়াশিংটন স্থানীয় সময় সোমবার (২০ জানুয়ারি) শপথ নেবেন। ট্রাম্পের জয়ের পর থেকে তার প্রশাসন বাংলাদেশকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে, তা নিয়ে চলছে নানামুখী আলোচনা। এক্ষেত্রে সামনে আসছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে মার্কিন হবু প্রেসিডেন্টের উষ্ণ সম্পর্ক। অন্যদিকে, ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উষ্ণ সম্পর্ক। কূটনীতিতে পশ্চিমাদের বিশেষ করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকাকে দিল্লির চোখে দেখার একটি প্রবাদ প্রচলিত। বিগত কয়েক বছরে ঢাকা-ওয়াশিংটনের বহুমুখী সম্পর্ক এ প্রবাদ এখন আর চলে না। তবে বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদল এবং বন্ধু মোদি-ট্রাম্পের সম্পর্ক বিবেচনায় ফের জল্পনা চলছে, ‘ওয়াশিংটন ঢাকাকে দিল্লির চোখে দেখবে।’ ট্রাম্প আমলে ওয়াশিংটনের ঢাকাকে দিল্লির চোখে দেখার বিষয়টি স্পেকুলেশন (জল্পনা) হিসেবে দেখছেন স্থানীয় কূটনীতিকেরা। তাদের ভাষ্য, ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশকে দেখবে তাদের এশিয়া নীতির আলোকে। মার্কিন নির্বাচনের আগ মুহূর্তে সংখ্যালঘু ইস্যুতে ট্রাম্পের বক্তব্য ঘিরে এক ধরনের নেতিবাচক জল্পনা রয়েছে। এটি শুধুই জল্পনা, বাস্তবতা ভিন্ন হবে। স্থানীয় এক কূটনীতিক বলেন, অনেক নেতিবাচক জল্পনা রয়েছে। নির্বাচনের প্রচারণার সঙ্গে সব কিছু মেলানো ঠিক হবে না। নির্বাচনী প্রচারণায় অনেক কৌশল থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে রাতারাতি কোনো পরিবর্তন হবে না। ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আমরা সম্পর্ক ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চাই, দেখছি। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের অনেক বিষয় আছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজস্ব ফোকাস নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। আমাদের দিকে ফোকাস যত কম থাকবে আমরা আমাদের কাজ তত বেশি করতে পারবো। আমাদের এখানে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র গুরত্বপূর্ণ। আমরা সহযোগিতার ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের সমর্থন চাই। ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও বাড়বে। মার্কিন নতুন প্রশাসনের সঙ্গে অর্থনৈতিক খাতে সহযোগিতার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। ট্রাম্প আমলে বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব নিয়ে জ্যৈষ্ঠ এক কূটনীতিক বলেন, আমি মনে করি না, ভারতের প্রভাব থাকবে। এটা এক ধরনের স্পেকুলেশন। আমার মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্মুথলি চলবে। ঢাকাকে ওয়াশিংটন গুরুত্ব দেয় বলে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্বর্তীকালীন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসেবে জ্যৈষ্ঠ কূটনীতিক ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। না হলে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের যাওয়ার পর কিন্তু দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স দিয়ে চলছিল, তাদের নিয়ে নিয়মিত করানো যেত। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টর সময়ে সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের উন্মোচন হবে। হয়তো কিছু অর্থায়ন কমবে। যেমন-জলবায়ু ইস্যুতে অর্থায়ন কমবে, রোহিঙ্গাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে পরিমাণ অর্থায়ন দিয়ে আসছে সেটা কিছুটা কমে আসতে পারে। নির্বাচিত হওয়ার আগে ইউনূস সরকারকে নিয়ে বেশ সমালোচনামূলক মন্তব্য করেছেন ট্রাম্প। গত ৩১ অক্টোবর (২০২৪) এক্সে দেওয়া এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘আমি বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরোচিত সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দেশটিতে দলবদ্ধভাবে তাদের ওপর হামলা ও লুটপাট চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরিভাবে একটা বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে রয়েছে।’ ট্রাম্প আরও লেখেন, ‘আমরা আপনাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করবো। আমার প্রশাসনের সময় ভারত ও আমার ভালো বন্ধু প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে আমাদের বৃহত্তর অংশীদারত্ব আরও জোরদার করবো।’ সম্প্রতি দিল্লি ভিত্তিক অনলাইন ডব্লিউআইওএনকে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটির বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে করা মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এরিক বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন দেখতে চায়, যা বাংলাদেশের জন্য নতুন অধ্যায় শুরু করতে সহায়ক হতে পারে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ঢাকা-ওয়াশিংটনের সম্পর্কের কিছুক্ষেত্রে পরিবর্তন আসার পাশাপাশি কাজ করার ধরনে পরিবর্তন আসতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশকে দেখবে তাদের এশিয়া নীতির আলোকে। তবে বাংলাদেশ ইস্যুতে মোটাদাগে আমূল পরিবর্তন আনবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেন, নতুন মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফেরায় জোর দেবে। এ ছাড়া, মানবাধিকার পরিস্থিতি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় নজর রাখতে তারা। ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশকে দেখবে প্রধানত তাদের এশিয়া নীতির আলোকে। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বেশি বেশি ব্যস্ত থাকবে-এমনটা ভাবা ঠিক হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী চোখ রাখছে, তাদের আগ্রহের অনেক ইস্যু আছে সে জন্য বাংলাদেশের প্রতি তাদের আগ্রহী হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে বলে আমি মনে করি। ভারতের বাংলাদেশে প্রভাব প্রশ্নে সাবেক এ রাষ্ট্রদূত বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে ধারণা করা যেতেই পারে ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে বাংলাদেশে প্রভাব খাটাতে চাইতে পারে। কিন্তু সেটাকে যুক্তরাষ্ট্র কতটা আমলে নেয় সেটাই দেখার বিষয়। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, ভারত কিছু বললেই সেটা যুক্তরাষ্ট্র মেনে নেবে বিষয়টা এমন নয়। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস আছে, রাষ্ট্রদূতরা সাধারণত প্রতিনিয়ত সদর দপ্তরে আপডেট দিয়ে থাকেন; রাষ্ট্রদূতের প্রতিবেদন এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনের ওপরে সব কিছু নির্ভর করবে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ডেমোক্রেটদের সখ্য পুরোনো। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়া ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে শুরু করেছেন প্রথম বিদেশ সফর। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কোনো দেশের শীর্ষ নেতার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের তেমন নজির নেই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন বিরল ঘটনা ঘটেছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ড. ইউনূসকে কাছে পেয়ে বুকে টেনে নেন। হাতে হাত রেখে বলেন, বাংলাদেশের সংস্কারের যে লক্ষ্য নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ঠিক করেছেন, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে সব ধরনের সহযোগিতা করবে হোয়াইট হাউস। দেশ গঠনে হোয়াইট হাউস থেকে ড. ইউনূস যে সহযোগিতার আশ্বাস পেয়েছেন তা ডেমোক্রেটদের কাছ থেকে। এখন হোয়াইট হাউসের দেখভাল করবেন রিপাবলিকানরা। এ ক্ষেত্রে ড. ইউনূস এখন হয়ত আর হোয়াইট হাউসের অবাধ সমর্থন পাবেন না বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে, ১১ জানুয়ারি ঢাকায় দায়িত্ব নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্বর্তীকালীন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন গতকাল রোববার এই প্রথম পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ও পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টার প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে মার্কিন সহযোগিতা অব্যাহত থাকার কথা জানিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স। একইসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার শ্রম খাতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিত করে এ খাতের বৈশ্বিক উদ্বেগগুলো দূর করবে বলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশার কথা জানান ট্রেসি। ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতা নেওয়ার পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে হোঁচট খাবে না বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক সেটা কিন্তু সরকারকেন্দ্রিক হবে না। নতুন সরকার এলে তাদের কিছু বক্তব্য থাকতে পারে, সেটা আমরা দেখব। জল্পনা করার কিছু নাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকার পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে হোঁচট খাবে না। আমরা মনে করি, এটা ভালোভাবে চলবে। চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন হবে বলে আমি মনে করি না। যা আছে, সে রকম থাকবে। তবে কিছুটা শ্লথ গতি হয়ে যেতে পারে। নতুন রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে যে গতির সঞ্চার হয়েছে, সেটা কিছুটা স্তিমিত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সক্রিয়তা কিছুটা কমে আসতে পারে। কারণ, ট্রাম্প আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছুটা ইন্ট্রোভার্ট। তিনি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে চিন্তিত। সেগুলো নিয়ে কাজ করেন, আগেও এমটনাই দেখা গেছে। |