![]() সংস্কার অভিযাত্রা কতদূর, নাকি মাঝপথে থুবড়ে পড়বে
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() রাজনৈতিক দল, বিশ্লেষক ও সংস্কার কমিশনের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাদের কেউ কেউ বলছেন, সুপারিশ গুলো সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে কিংবা তাদের মধ্যে যদি ন্যূনতম ঐকমত্য না হয়, তাহলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সুপারিশ শেষ পর্যন্ত কাগজেই থেকে যেতে পারে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য তাদের স্বল্পমেয়াদি অবস্থানের কারণে যেহেতু শুধু প্রস্তাবই পেশ করতে পারবে বলে মনে হয়, তবু তার পরেও জরুরি সমস্যাগুলো সমাধানে জরুরি মনোনিবেশ তাদের করতে হবেই-সে জন্য তাদের একটি প্রধান কাজ হবে আর্থসামাজিক পরিস্থিতির বেঞ্চমার্কগুলো সঠিকভাবে নির্ণয় করা। এছাড়া ঘাড়ের ওপর পড়ে যাওয়া সমস্যা গুলোর সমাধান করে জনগণকে স্বস্তি প্রদানও কিন্তু এ সরকারের দায়িত্ব। তাদের বন্ধুরাও এ মুহূর্তে তাই বলছেন। সুতরাং তাদের মূল দায়িত্ব হবে সঠিক ও স্বল্পসংখ্যক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এছাড়া নানা রকম সৃজনশীল অপ্রচলিত সংস্কার প্রস্তাব বর্তমানে উত্থাপিত হয়েছে সেগুলো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের টাস্কফোর্স ও কমিশনগুলোও কিছু পেশ করেছেন। কিছু সুপারিশ প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। অর্থনীতির অবস্থানের ওপর যে শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয়েছে তার বিভিন্ন তথ্য নিয়েও পক্ষ-বিপক্ষে নানা আলোচনা রয়েছে। তবে এর মানে বিগত সরকারের সবকিছুই ঠিক ছিল না-সেটাও সত্য নয়। সম্প্রতি দুর্নীতি ও বৈষম্য চরমভাবে বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও আসলে কীভাবে চরম দারিদ্র্য হার কমল ও মানব উন্নয়ন সূচকগুলোয় উন্নতি অর্জিত হলো-সেটি বর্তমান উন্নয়নবিদদের তলিয়ে দেখা দরকার। কিছুই অর্জিত হয়নি-এ কথা যেমন সত্য নয়-কিন্তু যেটুকু অর্জন সম্ভব ছিল তা অনেকখানি দুর্নীতি ও বৈষম্যের কারণে অর্জন করা যে সম্ভব হয়নি তা আজ সবাই স্বীকার করেন।সুতরাং স্বভাবতই বোঝা যাচ্ছে আগামী যে বাজেট অন্তর্বর্তী সরকার প্রণয়ন করতে যাচ্ছে তাতে তাদের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে-কীভাবে বৈদেশিক খাতে উদ্বৃত্ত ব্যালান্স তৈরি করে ক্রমবর্ধমান ডলার রিজার্ভ তারা তৈরি করবে বা করার সূচনা করবে। নতুন ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাণিজ্য, বৈদেশিক ঋণ ও বিনিয়োগ নীতি কী হবে? বাজেটে যে প্রচুর রাজস্ব ঘাটতি থাকবে তা কীভাবে পূরণ করবে?ব্যক্তি বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির হারকে যথাসম্ভব ধরে রাখা যায় কীভাবে তার উপায় উদ্ভাবন অর্থাৎ বিনিয়োগ আবহাওয়ার উন্নতি করে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি কীভাবে অব্যাহত রাখবে? মুদ্রাস্ফীতি ও মন্দা দুই-ই কাটিয়ে অর্থনীতিতে কীভাবে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা আনবে? এবং সর্বশেষ, কয়েকটি চিহ্নিত খাতে সুশাসন কীভাবে প্রতিষ্ঠিত করবে? নতুন প্রতিষ্ঠান ও নতুন সৎ ও দক্ষ মানবসম্পদ কোথায় পাবে, যাতে শুধু ভালো আইন বা নীতিই প্রণীত হবে না তা বাস্তবায়িতও হবে। নিঃসন্দেহে এগুলো খুবই চ্যালেঞ্জিং ও পুঞ্জীভূত কঠিন সমস্যা। কিন্তু এগুলোর জন্য যেসব জরুরি নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন-বিশেষত আর্থিক খাত, জ্বালানি খাত, আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় যেসব আশু জরুরি সংস্কার শুরু করা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে তা অন্তত শুরু না করতে পারলে জনগণের মনে প্রয়োজনীয় বিশ্বাস, আস্থা বা স্বস্তি ফিরিয়ে আনা যাবে না এবং গোলযোগ ও সামাজিক বিরোধ আরো বৃদ্ধি পাবে। যার সুস্পষ্ট লক্ষণ এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে। সুশাসনের ও শৃঙ্খলার জন্য যে সমস্যাগুলো জরুরিভাবে মোকাবেলা করা দরকার ছিল সেগুলো কতোটুকু এগুচ্ছে তাও ক্ষতিয়ে দেখা দরকার।যেমন;জুলাই আন্দোলনকালে নিহত-আহতদের একটি সুস্পষ্ট সঠিক তালিকা প্রণয়ন, চিকিৎসা প্রদান এবং পুনর্বাসন। যেসব পুলিশ,শিক্ষা কর্মকর্তা, আমলা,ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য কমবেশি অভিযুক্ত হয়েছেন-তাদের এখন নিরপেক্ষ সুষ্ঠু তালিকা প্রণয়ন করে এদের মধ্যে যারা নির্দেশ পালনে বাধ্য হয়েছিলেন অথবা যাদের অপরাধ লঘু করা যায় তাদের শনাক্ত করে তাদের মব জাস্টিসের মধ্যে ফেলে না দিয়ে একটি সুষ্ঠু ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে। ব্যক্তি বা দলীয় গ্রুপের হাতে, রাস্তাঘাটের শক্তির হাতে আইন না তুলে দিয়ে সুষ্ঠু ও দ্রুত বিচারের পদক্ষেপ নিতে পারলে দেশে কিছুটা শৃঙ্খলা এরই মধ্যে ফিরে আসত। পুলিশও আস্থা নিয়ে কাজে ফিরে আসতে সক্ষম হতো বলে মনে হয়। প্রথম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হঠাৎ বদল কেন হলেন সেটা স্পষ্ট নয়।সংবিধান কমিশনে কেন একজনকে বদলে বিদেশ থেকে আগত একজনকে নিয়োগ দেয়া হলো তাও বোধগম্য নয়। কেন ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তি গুলোকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে তাও বোঝা মুশকিল। মূলধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদদের শক্তিশালী ভূমিকা তৈরি না করে নতুন পার্টি তৈরি করতে চাইলে সেটাও কাম্য নয়। এসব ঘটনাগুলো ছাড়াও আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণগ্রহীতা, শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতা, বিদ্যুৎ খাতে ক্ষতিকর দেশী-বিদেশী চুক্তির কমিশনভোগী হোতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ, বৃহৎ মেগা প্রকল্পের চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ ইত্যাদি যাদের নিয়ে শ্বেতপত্রে সাধারণভাবে উল্লেখ রয়েছে কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই যেখানে হয়তো নাম উল্লেখিত হয়নি, সেগুলোর নাম ও অপরাধ প্রকাশ করে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন ছিল। সর্বোপরি টাকা পাচারের যে বিশাল পরিমাণ শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে সেটি কীভাবে উদ্ধার হবে তা বলা কঠিন। এজন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজন হতে পারে। তবে বিগত সরকারের আমলে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই যেভাবে টাকা পাচার হয়ে গিয়েছিল এবং যে মামলা এখনো চলমান তা থেকে আশা করা মুশকিল যে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দ্রুত উদ্ধার হওয়া সম্ভব। বর্তমান বিদেশী ভাড়া করা কোম্পানি ও দুদকের মাধ্যমে এ প্রচেষ্টা চলছে। মানুষ অপেক্ষা করছে এগুলোর সাফল্যের জন্য। তবে এর ফলে শত্রুদের প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং নতুন বেকারত্ব সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং বিকল্প প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা না করে এদের আঘাত করলে তা হয়তো সামলানো কঠিন হবে। বিশেষত তারা যদি সরকারের মিত্র বাহিনীর মধ্যেই তাদের শ্রেণী মিত্র খুঁজে পান তাহলে রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্য বদলেও যেতে পারে।তাই এসব ব্যাপারে সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে। আশু যে কাজটি এখনো করে ওঠা যায়নি তা হচ্ছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ। পাশাপাশি নিম্নবিত্তদের বিশেষত শিল্প শ্রমিক, কৃষক ও ক্ষুদ্র ও মাঝারি উৎপাদকদের প্রকৃত আয়ের সুরক্ষা প্রদান করে তাদের দ্রব্যমূল্যের আঘাত থেকে বাঁচানোর চেষ্ট করা উচিত। স্বস্তির জন্য এটা জরুরি। বাজারে সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগী কারা-আদৌ তাদের চিহ্নিত করে ভাঙার ক্ষমতা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আছে কিনা। ক্রেতা সমবায় ও বিক্রেতাদের সমবায় তৈরি, রেশন ও ওপেন মার্কেট অপারেশন ও খাদ্যের বিনিময়ে কাজ এবং গ্রাম-শহরে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা স্কিম চালু করা ইত্যাদি সুযোগ এখনো উন্মুক্ত রয়েছে। সৃজনশীল নতুন-পুরনো অনেক সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে-এসব নতুন ধরনের অচিরায়ত কোনো পদক্ষেপ এখনো দৃশ্যমান নয়। তাছাডাও অর্থনীতিতে প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলোর কথা বহুদিন ধরেই আলোচিত হচ্ছে। কীভাবে নিদেনপক্ষে একটি গণতান্ত্রিক অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি গড়ে তোলা যায় তা নিয়েও ভাবতে হবে। বিগত সরকারগুলোর কেউই এসবের গ্রহণ ও বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। প্রশ্ন তাই থেকেই যায় যে এবারো এ রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার না হলে এবং জনগণের মধ্যে শক্তি তৈরি না হলে সে ক্ষেত্রে এবারো সংস্কার অভিযাত্রা কতদূর অগ্রসর হবে, নাকি মাঝপথে থুবড়ে পড়বে। এটাই এখন চিন্তার কিংবা দেখার বিষয়। দুনিয়ার সব দেশেই আমলা আছে। আমলাদেরও কয়েকটি বিশেষ দেশ আছে। যার অন্যতম বাংলাদেশ।আমাদের সংবিধানে আছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ;কিন্তু তারপরও আমলাতন্ত্রের বিষয়টি নানাভাবে নানান সময়ে আলোচনায় এসেছে। আমলাতন্ত্র আমাদের দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য বিশেষ করে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে বড় এক সমস্যা হিসেবে জিইয়ে আছে। অনেক ক্ষেত্রেই বড় রকমের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে বিভাজনের দাগ ক্রমেই মোটা করে চলেছে। প্রজাতন্ত্রের মালিক যদি জনগণই হয়ে থাকেন তাহলে আমলারা জনগণের স্বার্থ যেভাবে আমলে নেয়ার কথা সেভাবে নেন না কেন? কারণ বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমলারাই মূলত অনেক কিছুর কারিগর এবং যুথবদ্ধ।তারা শাসক-প্রশাসক।সাম্প্রতিক আলোচিত সংস্কার প্রশ্নে এসে তারা সেই হিম্মত আবারো দেখিয়ে দিচ্ছেন। কাজকর্মে শাসনের মনোভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তারা অন্যদের সংস্কার করতে চান। নিজেরা সংস্কার হতে চান না। তাদেরই একটা বিশেষ গ্রুপ বিগত স্বৈরাচারকে শক্তি যোগান দিয়েছে। দানবীয় ফ্যাসিস্ট করে তুলেছে। টানা দীর্ঘ সময় টিকিয়ে রেখেছে। শেষতক ছাত্র-গণআন্দোলনে চরম ধাক্কা খেয়েছে। সরকারটি বিদায় নিয়েছে। দেশের মানুষ তাদের কাছ থেকে সেবার পরিবর্তে শোষণের শিকারই হন বেশি। অনেকেই একটা বিষয়ে একমত যে, ১৯৯৬ সালে সাবেক সিএসপি সচিব মহীউদ্দীন খান আলমগীরের জনতার মঞ্চ বানানোর একটা বিহিত হলে পরিস্থিতি হয় তো এ পর্যন্ত আসতো না। আওয়ামী লীগ শাসনামলের অন্যান্য অনিয়মের প্রতিকারে অন্তর্র্বর্তী সরকার উদ্যোগ নিলেও নির্বাচনে জালিয়াতিতে জড়িতদের শাস্তির কথা নেই এখন পর্যন্ত। যদিও আমলা বা প্রশাসন বাদ দিলে দেশ চলবে না। বখে যাওয়া, বেপরোয়া হয়ে ওঠার লাগাম টেনে একটা বন্দোবস্তে আসা এখন সময়ের দাবি। এ সরকার তা না পারলে ভবিষ্যতে আর পারার আশা থাকবে না। কারণ এমন সুযোগ সব সময় আসে না। এ সরকার প্রশাসনকে একটা বন্দোবস্তের জায়গায় এনে দিতে পারলে ভবিষ্যৎ নির্বাচিত সরকার সেটাকে একটা কাঠমোতে আনতে পারবে। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |