![]() শেখ পরিবারের বিলাসবহুল বাড়িগুলোতে এখন ভূতুড়ে পরিবেশ
নতুন বার্তা, গাজীপুর:
|
![]() গাজীপুর জেলা শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে মৌচাকের তেলিরচালা। সেখানে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ঘেঁষে নান্দনিক বাগানবাড়ি তৈরি করেছিলেন ক্ষমতাচ্যুত ও দেশত্যাগ করা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা। প্রতি বছরই ওই বাংলোয় সপরিবারে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা বেড়াতে আসতেন। সর্বশেষ দুই বোন পিকনিক করতে গত বছরের এপ্রিলে সেখানে বেড়াতে এসেছিলেন। গাজীপুর শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে সিটি করপোরেশনের কানাইয়া এলাকা। সেখানে গড়ে তোলেন শেখ হাসিনার ভাগনি ও সদ্য পদত্যাগ করা ব্রিটিশমন্ত্রী টিউলিপের নামে একটি বাগানবাড়ি। প্রায় ৩৫ বিঘার ওপর নির্মিত বাগানবাড়ির নামকরণ করা হয়েছে টিউলিপের নামে ‘টিউলিপ’স টেরিটরি’। এছাড়া মহানগরীর বাঙ্গালগাছ এলাকায় ২৫ বিঘা ও ফাওকাল এলাকায় ২৩ বিঘা জমির ওপর নির্মাণ করা হয় আরও দুটি বাগানবাড়ি। গাজীপুরে চারটি রিসোর্ট ও বাগানবাড়ির সন্ধান মিলছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা পরিবারের সদস্যদের। বিগত সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন কেনা এসব বাগানবাড়ি করা হয় অবসর সময় কাটানোর জন্য। সরকার পতনের চারটি বাগানবাড়িতে বিক্ষুব্ধ মানুষের হামলার ঘটনাও ঘটে। সেখানে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটে। যুক্তরাজ্যে শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপের বিরুদ্ধে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ ওঠা এবং তার পদত্যাগের পর দেশেও রেহানা পরিবারের সদস্যদের সম্পদের খোঁজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাথমিক অনুসন্ধানে বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য মিলেছে বলে জানা গেছে। স্থানীয় ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, কানাইয়া ও বাঙ্গালগাছ এলাকার এসব বাগানবাড়ি শেখ রেহেনার স্বামী সফিক আহাম্মেদ সিদ্দিক, তার দেবর তরিক আহাম্মেদ সিদ্দিক ও রফিক আহাম্মেদ সিদ্দিকের নামে কেনা। সরেজমিনে দেখা গেছে, গাজীপুর শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে কানাইয়া এলাকা। কাঁচা-পাকা রাস্তা আর সারি সারি গাছপালা। অনেকটা সবুজে ঘেরা এই কানাইয়ায় গড়ে উঠেছে শেখ হাসিনার ভাগনি ও সদ্য পদত্যাগ করা ব্রিটিশমন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকীর নামে একটি বাগানবাড়ি। প্রায় ৩৫ বিঘার ওপর নির্মিত বাগানবাড়িতে নান্দনিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। ডুপ্লেক্স বাড়ি, সান বাঁধানো পুকুরঘাট, কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক জলরাশি বেষ্টিত। নাগরিক জীবনের কোলাহল ছেড়ে অবকাশ যাপনের জন্য সেরা স্থান। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘টিউলিপ টেরিটরি’। মহানগরীর বাঙ্গালগাছ এলাকায় ২৫ বিঘা জমির ওপর বাগান বিলাস, ২৩ বিঘা জমির ওপর ফাওকাল বাগানবাড়ি, ১৫ বিঘা জমির ওপর কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক তেলিরচালা এলাকার বাগানবাড়ি। এলাকার মানুষ এগুলো সবকটি শেখ রেহানার বাগানবাড়ি বলে জানলেও অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এগুলোর মালিকানায় রয়েছে শেখ রেহানার স্বামী শফিক আহমেদ সিদ্দিক, দেবর তারেক আহমেদ সিদ্দিক ও তাদের নিকটতম আত্মীয়রা। টিউলিপ টেরিটরির ম্যানেজার আব্দুর রহমান বলেন, ৩০ বিঘার অধিক জায়গা নিয়ে এই বাগানবাড়ি। এটির মালিক শফিক স্যার। এখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ। এখানে প্রতি বছর দুবার, বিশেষ করে শীতের সময় টিউলিপ আপা, ববি ভাইসহ কয়েকজন আসতেন। এখানে এসে চার-পাঁচদিন থাকতেন। তারা যখন আসতেন সঙ্গে বিপুল সংখ্যক পুলিশ বাগানবাড়ি নজরদারিত রাখতেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুরে চারটি বাগানবাড়িতেই শেখ রেহানা, তার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক, ববিসহ শেখ পরিবারের লোকজন আসতেন। বিশেষ করে শীত মৌসুমে বেশি আসা-যাওয়া হতো। মাঝে মধ্যে জাতীয় পতাকা লাগানো গাড়ি প্রবেশ করতো রাতে। তখন থাকতো বাংলোর চারপাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি। কখনো ভোরেই গাড়িগুলো চলে যেত, কখনো দু-একদিন থাকতো এখানেই। গাজীপুর মহানগরীর ফাওকাল এলাকায় বাংলাদেশ সমরাস্ত্র ও টাকশালের পাশেই ২৩ বিঘা জমি নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বাগানবাড়ি। বিশাল সীমানা প্রাচীরে ঘেরা, ভেতরে নান্দনিক ডুপ্লেক্স বাড়ি। সেটিকে আগে স্থানীয় মানুষজন ডাক্তার বাড়ি হিসেবে চিনতেন। ২০১২ সালে সনাতন ধর্মাবলম্বী স্থানীয় অনিল কুমার ও অক্ষয় কুমার বিশ্বাসের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে কিনে এই বাগানবাড়ি তৈরি করা হয়েছে। ৩৫ লাখ টাকা বিঘা মূল্য ১৪ বিঘা জমি ক্রয় করা হয় এবং কাগজপত্রে সমস্যা থাকায় ৮ বিঘার কোনো দাম দেওয়া হয়নি। এখন সেখানকার বিঘাপ্রতি জমির মূল্য আড়াই কোটি। জমিটি স্বপন মিয়া নামের স্থানীয় প্রভাবশালী এক ব্যবসায়ীর মধ্যস্ততায় কেনেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং শেখ রেহানার দেবর তারিক আহাম্মেদ সিদ্দিক। ওই বাগানবাড়িতে মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রোটোকল নিয়ে ভিআইপিরা আসতেন বলে জানান স্থানীয়রা। নগরীর ফাওকাল এলাকার জমির সাবেক মালিক অক্ষয় কুমার বিশ্বাস বলেন, এটি আমাদের বাপ-চাচার জমি ছিল। পরে আমরা বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলে তারিক আহম্মেদ সিদ্দিক ২০১৫ সালে কিনে নেন। ২৩ বিঘা জমি থাকলেও কাগজপত্র সমস্যা থাকার কারণে ১৪ বিঘার দাম দেয়। বাকি ৮ বিঘার দাম দেয়নি। এখন সেখানে বাংলো বানানোয় জমির দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। মহানগরীর বাঙ্গালগাছ এলাকায় প্রায় ২৫ বিঘা জমিতে বাংলোবাড়ি করা হয়েছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাগান বিলাস’। শত শত গাছ লাগানো বাগান বিলাসটির ভেতরে চমৎকার পরিবেশ। অবকাশ যাপনের জন্য করা হয়েছে তিন রুমের এলটি দোচালা ঘর। পাশেই আরেকটি ছোট ঘর। সামনে বিশাল এক পুকুর, রয়েছে বিল ও পুকুর দেখার জন্য ওয়াচ-টাওয়ার। বাগান বিলাসটি দেখভাল করতেন মো. হৃদয় নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, এটি সবাই জানে শেখ রেহানার বাংলো কিন্তু এটি আসলে তার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলে হুট করে অনেক লোক প্রবেশ করে। এরপর সবকিছু ভাঙচুর করে লুটপাট করে নিয়ে গেছে, যা নিজের চোখেই দেখলেন। অনেক ভিআইপি আসতেন তবে শুনেছি আগে শেখ রেহানা আসতেন আমি আসার পর আসতে দেখিনি। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা থেকে অনেক লোক আসতেন। আমরা কেউ প্রবেশ করতে পারতাম না। অনেক বিচার-শালিস হতো ভেতরে। তবে ভাঙচুর হওয়া ঘরের সামনে বেশ কয়েকটি বিদুৎবিলের কাগজ পাওয়া যায়। সেখানে বাঙ্গালগাছে এই বাগানের মিটারের মালিকের নাম শেখ রেহানার দেবর ও শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা তারিক আহমদ সিদ্দিক। তবে বাংলোর গেটে যে নামফলকটি রয়েছে সেটি তারিক আহমেদ সিদ্দিকের বড় ভাই রফিক আহমেদ সিদ্দিকের নামে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে বাংলাদেশ স্কাউট প্রশিক্ষণের পূর্ব পাশে অবস্থিত ১৫ বিঘা জমির ওপরে অবস্থিত আরেকটি বাংলো রয়েছে। যেটি শেখ রেহানার। প্রতি বছর শেখ রেহানা ও শেখ হাসিনা একান্তে সময় কাটাতে আসতেন। সর্বশেষ গত বছরের এপ্রিল মাসেও দুই বোন এসে অবকাশ যাপন করে গেছেন। বাংলোটি দেখভাল করতেন কালিয়াকৈর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সেলিম আজাদ। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ কায়সার খসরু বলেন, গাজীপুর শেখ রেহেনার পরিবারের বাংলোবাড়িসহ অনেক জমিজমা রয়েছে বলে জানতে পেরেছি। দুদক থেকে এখনো কোনো চিঠি আসেনি। দুদক পত্রের মাধ্যমে জানতে চাইলে আমরা তথ্য প্রমাণসহ প্রতিবেদন পাঠাবো। এছাড়া বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে জানা যাবে। |